গাজা সিটির আল-শুজাইয়ার ছোট্ট একটি তাঁবুর সামনে ঝুলছে সাদা হাতে লেখা সাইনবোর্ড- ‘নূর’স সেলুন’, যার যাত্রা শুরু তিন সপ্তাহ আগে।
Published : 10 Mar 2025, 10:24 PM
গাজা সিটির পূর্বাঞ্চলে আল-শুজাইয়া এলাকায় ধ্বংসস্তূপের পাশে একটুকরো নীল তাঁবু- সেই তাঁবুতেই গড়ে উঠেছে নূরের বিউটি পার্লার। নেই সাজানো আয়না কিংবা জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশ, তবে আছে স্বপ্ন আর সৌন্দর্যচর্চার একটুখানি প্রশান্তি। যুদ্ধের ভয়াবহতা, বোমার ধ্বংসযজ্ঞ আর প্রিয়জন হারানোর বেদনাতেও গাজার নারীরা নিজেদের যত্ন নিতে ভুলছেন না।
৩৯ বছর বয়সী আমানি দোয়াইমা এসেছেন, তার ১৬ বছর বয়সী মেয়ে আয়াকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি চান ভ্রু ঠিক করতে, আর আয়া চায় মুখের মেকআপ। কারণ, ইফতারের পর এক ছোট পারিবারিক অনুষ্ঠানে তারা যোগ দেবেন।
“আমার ভাইঝির বিয়ে,” বলেন আমানি। “এ উপলক্ষে আমরা কনের জন্য এক ঘরোয়া আয়োজন করছি,” বলেন তিনি।
যুদ্ধবিধ্বস্ত নগরীতে এক মুহূর্তের প্রশান্তির জন্য নারীদের এই ঠিকানার গল্পই এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে আল-জাজিরা।
নূরের সেলুন
নূর আল-ঘামারি তিন সপ্তাহ আগে গাজায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া ফুটপাথে এই পার্লারের যাত্রা শুরু করেন। তার এই তাঁবু পার্লারের সামনে ঝুলছে সাদা হাতে লেখা সাইনবোর্ড- ‘নূর’স সেলুন’।
এর ভেতরে একটিমাত্র টেবিল রাখা আছে। সেই টেবিলের ওপর রাখা আছে একটি ভাঙা আয়না, রূপচর্চার কিছু প্রসাধনী, ময়েশ্চারাইজার এবং কিছু মেকআপ সামগ্রী।
সেলুন মালিক নূর আল-ঘামারি নার্সিং কলেজ ছেড়ে রূপচর্চার প্রতি ভালোবাসা থেকে এ উদ্যোগ নিয়েছেন। মূলত তিনি ও তার পরিবার দক্ষিণে আশ্রয় নেওয়ার পর আবার উত্তরে ফিরে এসে এই সেলুন খোলেন।
আমানি ও আয়াকে স্বাগত জানিয়ে নূর কাজ শুরু করেন। “যেদিন থেকে পার্লার খুলেছি, অনেক নারী এসেছেন, যাদের জীবনযুদ্ধের গল্প হৃদয়বিদারক, কেউ হারিয়েছে মা-বাবা, ভাই-বোন, কেউ আবার হারিয়েছে ভালোবাসার মানুষকে। কেউ সব হারিয়ে নিঃস্ব, অনেকেই এসেছেন ক্লান্ত হয়ে, তাদের মুখ থেকে যেন জীবনের আলো নিভে গেছে,” আল-জাজিরাকে বললেন নূর।
এই যুদ্ধের মাঝে সৌন্দর্য চর্চার বিষয়টি অদ্ভুত মনে হতে পারে, তবে আমানি ও নূর দুজনেই মনে করেন, এটি নারীদের জন্য মানসিক স্বস্তির একটি উপায়। “নারীরা আসছেন তাঁবু থেকে, শরণার্থী শিবিরের গাদাগাদি পরিবেশ থেকে, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসবাসের ক্লান্তি নিয়ে। আমি চাই, তারা অন্তত কিছুটা স্বস্তি পান, নিজেদের একটু হালকা অনুভব করেন।”
আমানি বলেন, “যুদ্ধের প্রথম দিকে রূপচর্চার কথা ভাবারই সময় ছিল না। কিন্তু পরে, যখন আমি দেইর আল-বালাহতে ছিলাম, সেখানকার একটি পার্লারে যাওয়া শুরু করি। নিজের যত্ন নেওয়ার পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি অনুভব করতাম, আমার মন ভালো হয়ে যাচ্ছে। আমাদের চারপাশের দুঃখ-কষ্টের শেষ নেই, কিন্তু সৌন্দর্যচর্চা কিছুক্ষণের জন্য হলেও সে দুঃখ ভুলিয়ে দেয়।”
যুদ্ধের মাঝে সৌন্দর্য
নূর মনে করেন, গাজার নারীরা এ যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছেন, তারা হারিয়েছেন ঘরবাড়ি, নিরাপত্তা, এমনকি নিজেদের যত্ন নেওয়ার সুযোগও।
“আমি দেখেছি, অনেক নারীর ত্বক রোদে পুড়ে গেছে, কারণ, তারা দিনের পর দিন তাঁবুতে বাস করছেন। কাঠের আগুনে রান্না করছেন, কাপড় ধুচ্ছেন, ভারী পানির পাত্র বহন করছেন। পাশাপাশি, শরণার্থী শিবিরে তাদের কোনও গোপনীয়তা নেই, বোমা হামলা আর ধ্বংসযজ্ঞের আতঙ্ক তো রয়েছেই।”
তবুও, তিনি লক্ষ্য করেছেন, অনেক নারী সৌন্দর্যচর্চাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। “অনেকেই আসেন, যাদের সামান্য একটি অবাঞ্ছিত লোমও সহ্য হয় না। কেউ প্রতি সপ্তাহে আসেন, কেউ মাঝে মাঝে।”
নূর এক তরুণীর কথা বলেন, যার পরিবার—মা-বাবা ও সব ভাইবোন—একটি বিমান হামলায় নিহত হয়েছিল। সেই শোকের ভারে সে নিজেকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছিল। “আমি তাকে সম্পূর্ণ ট্রিটমেন্ট দিলাম—ভ্রু ঠিক করলাম, চুল কাটলাম, এমনকি একবারের জন্য ফ্রি ফেস ম্যাসাজ ও মাস্ক দিলাম। আয়নায় নিজের মুখ দেখে সে আনন্দে কেঁদে ফেলল।”
স্বপ্ন আঁকড়ে থাকা
গাজায় ঠিক তখনই ইসরায়েলের হামলা শুরু হয়, যখন নূর ইট-মর্টারের বিউটি সেলুন খোলার স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের কারণে তার জীবন, পরিকল্পনা সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যায়। দক্ষিণে পালিয়ে যাওয়ার পর দুই মাস শুধু বেঁচে থাকার লড়াই নিয়েই ভাবতে হয়েছে তাকে।
নূর বলেন, "কয়েক মাস পর, যখন আমরা শরণার্থী শিবিরে কিছুটা স্থিতিশীল হলাম, তখন শুনতে পেলাম নারীরা বলছে, ‘ইশ, যদি কাছাকাছি একটা পার্লার থাকত, তাহলে একটু যত্ন নেওয়া যেত।’ তখন আমি বললাম, ‘আমি তো বিউটিশিয়ান!’"
এই কথা শোনার পর আশেপাশের নারীরা যেন তাকে আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করলেন। কেউ তার কাছে এলেন, আবার তিনি নিজেই অনেকের তাঁবুতে গিয়ে তাদের যত্ন নিলেন। এখন, তার এই কাজ তার পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করছে, যদিও তিনি বেশি অর্থ নিতে পারেন না। “আমি এখানকার বাস্তবতা জানি, তাই কম দাম নেই,” বললেন তিনি।
'যুদ্ধ আমাদের বুড়িয়ে দিয়েছে'
আমানির ভ্রু ঠিক করে দেওয়ার পর তিনি নূরের কাছে জানতে চাইলেন, তার চুল রং করা যাবে কি না। কিন্তু নূর পারলেন না। তিনি তখন জানালেন, “এই এলাকায় পানি নেই। চুল রঙ করতে পানির দরকার হয়, আর আমার তাবু তো ধ্বংসস্তূপের মধ্যে, এখানে পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, কিছুই নেই।”
নূরের কথা শুনে আমানি হতাশ হয়ে তার চুলে হাত বুলালেন; বিষন্ন হাসি হেসে বললেন, “আগে আমার কয়েকটা মাত্র পাকা চুল ছিল। এখন পুরো মাথায় ছড়িয়ে গেছে। এই যুদ্ধ আমাদের বুড়িয়ে দিয়েছে।”
নূর এরপর আয়ার সঙ্গে কথা বলেন তার পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে মেকআপ ঠিক করার জন্য। আমানি বলেন, “আমি চাই, আমার মেয়ে বুঝুক যে নিজেকে যত্ন করা সবসময় গুরুত্বপূর্ণ। পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন। আমি চাই, সে কিছুটা আনন্দ পাক।”
আয়ার মেকাপ যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখন নূর কাজ করতে করতেই নিজের বোনা স্বপ্নের কথা বলছিলেন।
“সবচেয়ে বেশি চাই—এ যুদ্ধটা শেষ হোক। তাহলে আমার সেলুনটা বড় করতে পারব, একটা ঠিকঠাক জায়গায় নিতে পারব, আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারব," বলেন তিনি।
কিন্তু নারীদের জন্য নূরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হল: “নিজের যত্ন নিন, যেভাবেই হোক। জীবন খুব ছোট।”