জনপ্রিয়তা হারিয়ে হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করলেও তিনি মানবিক কাজের মাধ্যমে সুনাম পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন, যা তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়।
Published : 30 Dec 2024, 09:36 AM
শতবছরের জীবন পার করে বিদায় নিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট, শান্তিতে নোবেলজয়ী জিমি কার্টার।
রোববার বিকালে জর্জিয়ার প্লেইনসে নিজ বাড়িতে তিনি মারা যান বলে জানিয়েছে তার প্রতিষ্ঠিত কার্টার সেন্টার।
বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভাষায়, জিমি কার্টার ছিলেন ‘অসাধারণ এক নেতা’।
একসময়ের বাদামচাষি কার্টার ইতিহাসের যে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি দিন বেঁচে ছিলেন; গেল অক্টোবরেই তিনি জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন করেন।
এই ডেমোক্র্যাট ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যখন অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সংকটে জর্জরিত ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
বিবিসি লিখেছে, জনপ্রিয়তা হারিয়ে হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করলেও তিনি মানবিক কাজের মাধ্যমে সুনাম পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন, যা তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়।
তার ছেলে চিপ কার্টার এক বিবৃতিতে বলেন, "আমার বাবা ছিলেন একজন বীর, কেবল আমার কাছে নয়, শান্তি, মানবাধিকার ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় বিশ্বাসী সবার কাছে।
"তিনি যেভাবে মানুষকে একত্রিত করেছিলেন, তাতে পুরো বিশ্ব আমাদের পরিবার হয়ে উঠেছে। এই ঐক্য ধরে রেখে তার স্মৃতিকে সম্মান জানানোর জন্য আমরা আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।"
কার্টার প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে জর্জিয়ার গভর্নর, মার্কিন নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট এবং কৃষক হিসেবে কাজ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি চার সন্তান রেখে গেছেন।
তার স্ত্রী রোসালিন গত বছরের নভেম্বরে মারা যান, তাদের বৈবাহিক জীবন ছিল ৭৭ বছরের।
বিবিসি লিখেছে, ২০১৮ সালে ৯৪ বছর বয়সে মারা যান জর্জ হার্বার্ট ওয়াকার বুশ, তখন পর্যন্ত তিনিই ছিলেন সবচেয়ে দীর্ঘজীবী মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
ক্যান্সারে আক্রান্ত কার্টার গত বছর তার চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, তার বদলে বাড়িতে হসপিস কেয়ার নিতে শুরু করেছিলেন।
কার্টারকে ‘একজন প্রিয় বন্ধু’ এবং ‘নীতি ও আস্থার মানুষ’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন এক বিবৃতিতে বলেছেন, “তিনি দেখিয়েছেন যে আমরা একটি মহান জাতি, কারণ আমরা ভালো মানুষ- ভদ্র ও সম্মানিত, সাহসী এবং সহানুভূতিশীল, নম্র এবং শক্তিশালী।”
যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প সোশাল মিডিয়ায় লিখেছেন, "আমাদের দেশের এক সংকটকালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিমিকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল এবং সব আমেরিকানের জীবনমান উন্নত করতে তিনি তার ক্ষমতার মধ্যে সবকিছু করেছিলেন। এজন্য আমরা সবাই তার কাছে ঋণী।”
বিবিসি লিখেছে, কার্টারের প্রেসিডেন্সি স্মরণীয় হয়ে থাকবে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট এবং দেশের বাইরের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য। এর মধ্যে ইরানে জিম্মি সংকটও ছিল, যার অবসান ঘটেছিল আট আমেরিকানের প্রাণক্ষয়ের মধ্য দিয়ে।
১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্প ডেভিডে মিশর ও ইসরায়েলের মধ্যে ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন হয়, যাকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির বড় বিজয় হিসেবে দেখা হয়।
কিন্তু দুই বছর বাদেই সেই অবদানের কথা ভুলে যেতে বসেন আমেরিকানরা, বিপুল ভোটে তারা রিপাবলিকান রোনাল্ড রিগ্যানকে বেছে নেন।
১৯৮০ সালের সেই নির্বাচনে কার্টারের ভরাডুবি হয়। ওয়াশিংটন ডিসির পাশাপাশি মাত্র ছয়টি অঙ্গরাজ্যে তিনি জয় পেয়েছিলেন।
এমন বড় পরাজয়ের পর রিপাবলিকনারা প্রায়ই ‘অদক্ষ নেতৃত্বের’ উদাহরণ দিতে গিয়ে কার্টারের কথা বলতেন।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, কার্টারের দলের অনেকেও তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। তারাও বলতে থাকেন, ডেমোক্রেটিক রাজনীতির যে ব্র্যান্ড, কার্টারের প্রেসিডেন্সিতে তার প্রতিফলন ঘটেনি।
বিবিসি লিখেছে, ডানপন্থিদের অনেকে এখনো কার্টারের প্রেসিডেন্সির বছরগুলো নিয়ে উপহাস করলেও পরের কয়েক দশকের তার মানবিক প্রচেষ্টা এবং সাধারণ জীবনধারা অনেক আমেরিকানের জন্য একটি নতুন উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে।
কার্টারই প্রথম ও একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি হোয়াইট হাউজ ছাড়ার পর র্যাঞ্চ স্টাইলের দুই বেডরুমের বাড়িতে ফেরেন, যেখানে রাজনৈতিক জীবনের আগে থাকতেন তিনি।
অধিকাংশ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিদায়ের পর যা করেন– বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে মোটা অর্থের বিনিময়ে বক্তৃতা দেওয়া এবং স্মৃতিকথা প্রকাশের জন্য বিপুল অংকের বিনিময়ে প্রকাশকের সঙ্গে চুক্তি করা– সেই পথে যাননি কার্টার।
২০১৮ সালে ওয়াশিংটন পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এও বলেছিলেন, সত্যিকার অর্থে তিনি কখনো ধনী হতে চাননি।
তার বদলে বাকি জীবন তিনি কাটিয়েছেন বিশ্বকে বৈষম্য ও ব্যাধি থেকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টায়।
শান্তি ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতে তিনি সারথি হিসেবে বেছে নেন নেলসন ম্যান্ডেলাকে, প্রতিষ্ঠা করেন দ্য এলডার্স।
সাবেক এ প্রেসিডেন্ট প্রতিষ্ঠিত কার্টার সেন্টার বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে কাজ করে।
তৃতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০০২ সালে নোবেল পুরস্কার গ্রহণের সময় কার্টার বলেছিলেন, “সবচেয়ে গুরুতর ও সর্বজনীন সমস্যা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ও দরিদ্রতম মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান।”
কার্টারের মানবিক, পরিবেশগত ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও তার স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এক বিবৃতিতে বলেছেন, "একটি উন্নত, ন্যায্য বিশ্বের জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন।
"বিশ্বাসের ওপর ভর করে প্রেসিডেন্ট কার্টার অন্যদের সেবা করার জন্য বেঁচে ছিলেন শেষ দিন পর্যন্ত।"
কার্টারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, “শিষ্টাচার, মর্যাদা, ন্যায়বিচার ও সেবার জীবনযাপনের অর্থ কী- তা তিনি আমাদের শিখিয়েছেন। “
রিপাবলিকান সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেছেন, “কার্টার অফিসকে মর্যাদা দিয়েছিলেন এবং আরও ভালো বিশ্ব গড়ার জন্য প্রেসিডেন্সি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রচেষ্টা থেমে যায়নি।”
ওয়াশিংটন ডিসিতে কার্টারের রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।