অর্থনীতি, গর্ভপাত, অভিবাসন এবং স্বাস্থ্যসেবা– এই চার বিষয়ে ঘুরপাক খেয়েছে ভোটারদের আলোচনা।
Published : 05 Nov 2024, 12:42 AM
যুক্তরাষ্ট্রে এবছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারের কেন্দ্রে থাকা মূল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে অভিবাসনকে ছাড়িয়ে ভোটারদের মনে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্থান করে নিয়েছে গর্ভপাত।
নভেম্বরের নির্বাচনকে সামনে রেখে গত ১৬ মাস ধরে ‘রেডফিল্ড অ্যান্ড উইল্টন স্ট্র্যাটেজিস’ পরিচালিত একাধিক জরিপে অংশগ্রহণকারীদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, “২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আপনি কাকে ভোট দেবেন তা নির্ধারণ করবেন কীভাবে?”
জরিপে মোট ২৪টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছিল। এর মধ্যে মাত্র চারটি বিষয়ই বারবার বেছে নিয়েছেন জরিপে অংশ নেওয়া ভোটারদের প্রতি ৫ জনে দুইজনের বেশি জন।
এই প্রধান ৪ টি নির্বাচনী বিষয় হল- অর্থনীতি, গর্ভপাত, অভিবাসন এবং স্বাস্থ্যসেবা।
২০২৩ সালের জুলাই থেকে পরিচালিত প্রতিটি জরিপে ভোটারদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী বিষয় হিসাবে স্থান পেয়ে এসেছে অর্থনীতি। প্রায় ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা এ বিষয়কেই বেশি গুরুত্ব দেয়।
দ্বিতীয় গুরুরত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উঠে আসার পথে ছিল গর্ভপাত এবং অভিবাসন। তবে গর্ভপাতের বিষয়টি সম্প্রতি কয়েকমাসে ভোটারদের মনে গুরুত্বের দিক থেকে অভিবাসনকে ছাড়িয়ে গেছে।
২০২৩ সালের জুলাইয়ের প্রথম জরিপে ২১ শতাংশ উত্তরদাতা গর্ভপাতকে মূল গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন। আর ২০২৪ সালের অক্টোবরের সর্বশেষ জরিপে অংশ নেওয়া ৩৮ শতাংশ ভোটার গর্ভপাতকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
যদিও এর আগে ২০২৩ সালের জুলাইয়ের প্রথম জরিপে অংশ নেওয়া ৩০ শতাংশ উত্তরদাতা অভিবাসনকে মূল বিষয় হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন। আবার ২০২৪ সালের অক্টোবরের সর্বশেষ জরিপেও ৩৬ শতাংশ উত্তরদাতা অভিবাসনকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
জরিপে অংশ নেওয়া পুরুষ ভোটারদের কাছে অভিবাসন দ্বিতীয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এবং গর্ভপাত নারীদের কাছে দ্বিতীয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসাবে স্থান পেয়েছে।
এই প্রতিবেদন নিউজউইক ট্র্যাকার পোলিংয়ের অংশ। এই জরিপে যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারদের গত ১৬ মাস ধরে গর্ভপাত, অভিবাসন এবং ইউক্রেইন যুদ্ধের মতো বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন করা হয়।
২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত নিউজউইক-এর পক্ষ থেকে রেডফিল্ড অ্যান্ড উইল্টন স্ট্র্যাটেজিস পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে ১৯টি জরিপ পরিচালনা করা হয়। জরিপে মোট ৩৪,৮০০ যোগ্য ভোটারকে ২০২৪ সালের নির্বাচনের মূল বিষয়গুলি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়।
নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ভোটাররা ততই প্রেসিডেন্ট হিসেবে তারা কাকে নির্বাচন করবে সেটি নিয়ে জোরাল চিন্তাভাবনা করছে। জর্জিয়া, মিশিগান, পেনসিলভানিয়া ও অ্যারিজোনার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটলগ্রাউন্ড রাজ্যগুলোতে শেষ পর্যন্ত মাত্র কয়েক হাজার ভোটের ব্যবধানে নির্বাচনের ফল উলটে যেতে পারে বলে জনমত জরিপে আভাস পাওয়া গেছে।
পেনসিলভেইনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ক্যারি কোগলিয়ানিজ নিউজউইক-কে বলেন, “এ ধরনের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনও প্রার্থীই অর্থনীতি, প্রজনন অধিকার, অভিবাসন, গণতন্ত্র বা আইনের শাসন যাই হোক না কেন, কোনও বিষয়কেই গুরুত্ব না দিয়ে পারছেন না।”
প্রতি মাসে তিনজন ভোটারের মধ্যে একজনের জন্য স্বাস্থ্যসেবা একটি প্রধান সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল। ২০২৩ সালে পরিচালিত জরিপে স্বাস্থ্যসেবা দ্বিতীয় স্থান অর্জন করলেও ২০২৪ সালের সর্বশেষ বেশ কয়েকটি জরিপে গুরুত্বের দিক থেকে চতুর্থ স্থান পেয়েছে।
রেডফিল্ড অ্যান্ড উইল্টন স্ট্র্যাটেজিস এর গবেষণা পরিচালক ফিলিপ ভ্যান শেলটিঙ্গা নিউজউইক-কে বলেন, "জো বাইডেন এবং কমলা হ্যারিস উভয়েরই অভিবাসনের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব হ্রাস করার প্রচেষ্টা প্রাথমিকভাবে সফল হলেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। গুরুত্বের দিক থেকে অভিবাসন এ বছরের শুরুর দিকে দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ স্থানে চলে গিয়েছিল। পরে সেটি আবার গর্ভপাতের সঙ্গে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে।
তিনি আরও বলেন, “হ্যারিসের প্রচার গর্ভপাতের বিষয়টিকে জোরালো করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। বিশেষত নারী এবং তরুণ ভোটারদের মধ্যে।” যা হোক, গর্ভপাত এখন হ্যারিস সমর্থক ভোটারদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
হ্যারিস এবং ট্রাম্প তাদের নির্বাচনি প্রচারে গর্ভপাত নিয়ে বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
কমলা হ্যারিস গর্ভপাতের অধিকারকে তার প্রচারাভিযানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছেন এবং তিনি এ নিয়ে আইন প্রণয়নের পক্ষে যুক্তি দিয়ে চলেছেন, যা দেশব্যাপী প্রজনন অধিকার নিশ্চিত করবে।
কল হার ড্যাডি পডকাস্টে হ্যারিস হোস্ট অ্যালেক্স কুপারকে বলেন, “নারীদের প্রজনন অধিকার সম্পর্কে সরকারের কথা বলা উচিত না। এটা তাদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়।”
হ্যারিস বলেন, “আমার সবচেয়ে আপত্তি হচ্ছে, যারা এই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছে ,তারা তাদের ক্ষমতা এবং অবস্থান জাহির করতে চাইছে। তারা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করছে।”
অন্যাদিকে, ট্রাম্প গর্ভপাতের বিষয়ে কথা বলা অনেকটাই এড়িয়ে গেছেন। ট্রাম্প বলেছেন,প্রতিটি রাজ্যের আলাদা আলাদাভাবে গর্ভপাতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার থাকার পক্ষে তিনি।
প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ট্রাম্প তিনজন বিচারপতিকে সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ করেছিলেন। তারা ২০২২ সালের জুনে 'রো বনাম ওয়েড’ মামলার রায়ে গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকার বাতিলে ভূমিকা পালন করেন। তবে হোয়াইট হাউজে ফিরতে পারলে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করার আইন নিয়ে কাজ করবেন, এমন কথা ট্রাম্প অস্বীকার করেছেন।
নভেম্বরে ১০ টি রাজ্যে প্রজনন অধিকারের বিষয়গুলো ব্যালটে থাকবে। এমনকি যেসব রাজ্যে গর্ভপাত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ সেসব রাজ্যেও থাকবে।
অক্টোবরের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের ট্রাম্প সমর্থকদের মাত্র ২০ শতাংশ গর্ভপাতকে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী ইস্যু হিসেবে দেখছেন। অন্যদিকে হ্যারিস সমর্থকদের ৫৮ শতাংশ এটিকে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে দেখছেন।
গর্ভপাত অধিকার বিষয়ক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘রিপ্রোডাক্টিভ ফ্রিডম ফর অল’-এর রাজনৈতিক পরিচালক সিলভিনা অ্যালারকন নিউজউইক-কে বলেন, “আমাদের পরিবার শুরু হওয়া বা বেড়ে উঠবে কিনা বা সেটি কখন হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত আমরাই নেব। এই বিষয়টি ভোটারদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।”
তিনি আরও বলেন, "দুজনের প্রচারণার মধ্যে কোনও মিল নেই, এবং তারা দায়িত্ব গ্রহণের পরে কী করতে চায়, তা স্পষ্ট।”
অর্থনীতি এখনও 'প্রধান ইস্যু'
জরিপে দেখা গেছে, সব বয়সের পুরুষ ও নারী ভোটারসহ সব জনগোষ্ঠীর ভোটারেরই অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ সবচেয়ে বেশি।
পেনসিলভেইনিয়ার ‘মুহলেনবার্গ কলেজ ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ওপিনিয়ন’ এর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং পোলিং সংস্থার পরিচালক ক্রিস্টোফার বোরিক বলেছেন, “নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারদের জন্য অর্থনৈতিক বিষয়গুলো চিরকালই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক বছর গুলতে উচ্চ স্তরের মুদ্রাস্ফীতি এই উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।”
এর আগে ট্রাম্প তার প্রেসিডেন্সির সময়কার শক্তিশালী অর্থনীতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অর্থনৈতিক বিষয়গুলো পরিচালনা করার জন্য নিজেকে সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রার্থী হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। বোরিক নিউজউইক-কে বলেন, “উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে বর্তমান প্রশাসনের ওপর দোষ চাপিয়ে ট্রাম্পের এগিয়ে যাওয়ার একটি সুযোগ রয়েছে।”
তার মতে, "হ্যারিসের আরও চ্যালেঞ্জিং বিষয় নিয়ে কথা বলা উচিত ছিল। মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস সহ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে তার মেয়াদকালে তিনি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে যেসব শক্তিশালী পদক্ষেপ নিয়েছেন, এবারের নির্বাচনী প্রচারে সেগুলো উপস্থাপন করা উচিত ছিল।”
হ্যারিস যে নির্বাচনের আগে অর্থনীতিতে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আনতে সফল হয়েছেন, সেটা প্রচার করেও জনগণের কাছে ভোট চাইতে পারতেন। গ্যাসের দাম কমেছে এবং অগাস্টে মুদ্রাস্ফীতি তিন বছরের সর্বনিম্ন ২ দশমিক ৫ শতাংশে নেমেছে। বর্তমান বেকারত্বের হারও সর্বনিম্ন ৪ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
প্রজন্মান্তরে অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো
ভোটের ফলে ইস্যু অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে প্রজন্মগত পার্থক্যও তুলে ধরা হয়েছে জরিপে। বয়স্ক ভোটাররা অভিবাসনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে।
প্রায় এক-চতুর্থাংশ জেনারেশন জেড (১৮-২৬ বছর বয়সী) এবং সহস্রাব্দ (২৭-৪২ বছর বয়সী) অভিবাসনকে তাদের প্রধান সমস্যাগুলোর তালিকায় ঠাঁই দিয়েছে। আর বুমার প্রজন্মের (৫৯-৭৫ বছর বয়সী) প্রায় অর্ধেক মানুষ প্রতিবারই অভিবাসনকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
জেনারেশন জেড এবং মিলেনিয়াল ভোটারদের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ থেকে এক-চতুর্থাংশ তাদের শীর্ষ নির্বাচনী ইস্যুগুলির মধ্যে সাধারনত সবসময়ই আবাসনকে গুরুত্ব দেয়। সেই তুলনায় জরিপে দেখা গেছে, নভেম্বরে ভোট দেওয়ার সময় বুমার প্রজন্মের প্রতি ১০ জনের মধ্যে মাত্র একজন আবাসনকে বিবেচনায় নেবেন।