‘রেললাইনে রক্তের স্রোতে ছিন্নভিন্ন লাশ, কখনও ভুলব না’

উড়িষ্যায় ট্রেন দুর্ঘটনার পর সারি সারি লাশ আর অন্ধকারে ভেসে আসা আর্তনাদে ভড়কে গেছেন উদ্ধার কাজে হাত বাড়ানো ব্যক্তিরাও।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 June 2023, 07:50 AM
Updated : 3 June 2023, 07:50 AM

“তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ বিকট শব্দের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন আমার উপড়ে এসে হুড়মুড়িয়ে পড়ে; কোনোভাবে সেখান থেকে বের হয়ে দেখি অনেকে আটকে আছে বেশকিছু কোচের নিচে, যাদের গগণবিদারী আর্তনাদ আর চিৎকার কেবল চারদিকে,” বলছিলেন ভারতে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া করমণ্ডল এক্সপ্রেসের যাত্রী স্বপন কুমার।

স্বপনের মতো অনেকে ভয়াবহ সেই মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছেন শুক্রবার রাতে; সারি সারি লাশ আর অন্ধকারে ভেসে আসা আর্তনাদে ভড়কে গেছেন উদ্ধার কাজে হাত বাড়ানো ব্যক্তিরাও।

ভারতের উড়িষ্যায় বালেশ্বরের ওই ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ২৮৮ জনে দাঁড়িয়েছে এবং ৮৫০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন বলে দেশটির এক সরকারি কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া করমণ্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনের আরেক যাত্রী টুইটে লিখেছেন, “সেখান থেকে অক্ষত ফিরতে পেরে আমি চির কৃতজ্ঞ। সম্ভবত এটি ভারতের সবচেয়ে বড় ট্রেন দুর্ঘটনা।”

এনডিটিভি জানিয়েছে, অনুভব দাস নামের সেই যাত্রী লিখেন, “বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসের তিনটি সাধারণ কোচ সম্পূর্ণভাবে লাইনচ্যুত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া করমণ্ডল এক্সপ্রেসের জেনারেল, স্লিপার, এসি থ্রি টায়ার এবং এসি টু টায়ারসহ প্রায় ১৩টি কোচ ‘সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়েছে।”

তিনি নিজেই ২০০-২৫০ এরও বেশি জনকে মৃত দেখেছেন বলে দাবি করেছেন অনুভব দাস।

“ট্রেনে থাকা পরিবারগুলো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। রেললাইনে রক্তের স্রোত আর অঙ্গহীন লাশ। এটি এমন এক দৃশ্য, যা আমি কখনও ভুলব না। ভগবান পরিবারগুলোকে সাহায্য করুন। তাদের প্রতি আমার সমবেদনা।”

Also Read: উড়িষ্যায় ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু ২০০ ছাড়াল, বাংলাদেশিদের জন্য হটলাইন চালু কলকাতায়

Also Read: উড়িষ্যার ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা কীভাবে ঘটল?

Also Read: করমণ্ডল এক্সপ্রেসের যাত্রীর মুখে দুর্ঘটনার বয়ান

Also Read: উড়িষ্যায় ট্রেন দুর্ঘটনা: আড়াইশর বেশি মৃত্যু, উদ্ধার অভিযান শেষ

দুর্ঘটনার যে বর্ণনা পাওয়া গেছে তা অনুযায়ী, করমণ্ডল এক্সপ্রেস পেছন থেকে ধাক্কা দেয় একটি মালগাড়িকে। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনটি সেই মালগাড়ির উপরে উঠে যায়। ২৩টি বগির মধ্যে ১৫টি লাইন থেকে ছিটকে পড়ে পাশের ডাউন লাইনে। সেই লাইন দিয়ে তখন আসছিল বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের লাইনচ্যুত বগিগুলো গিয়ে পড়ে সেই লাইনের উপর। বেঙ্গালুরু-হাওড়া ট্রেনটির দুটি কামরাও তখন লাইনচ্যুত হয়।

‘কী বাঁচা যে বেঁচেছি, তা শুধু আমিই জানি’

ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় বেঁচে গেছেন কৃষ্ণপদ মণ্ডল এবং তার চাচা প্রশান্ত মণ্ডল; কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা খুঁজে পেয়েছে তাদের, জেনেছে তাদের অভিজ্ঞতা।

করমণ্ডল এক্সপ্রেসের যাত্রী কৃষ্ণপদ বলেন, “মুহূর্তের মধ্যে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমার গায়ে তখন এসে পড়েছে আরও কয়েক জন। দমবন্ধ হয়ে আসছিল। বুঝলাম, আমাদের কামরাটি উল্টে গিয়েছে পুরো। দুর্ঘটনায় পড়েছি।”

কলকাতা হাওড়া থেকে দ্রুতগামী এই ট্রেনে উঠেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এই বাঙালি, যাচ্ছিলেন চেন্নাই।

দুর্ঘটনার বর্ণনায় কৃষ্ণপদ বলেন, “হঠাৎই বিকট একটা ঝাঁকুনি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের কামরা এক দিকে হেলে পড়তে থাকে। এস ৪ কামরা এতটাই কাত হয়ে যায় যে খোলা দরজা গলে বাইরে পড়ে যান দু-তিন জন। ওদের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। বুঝতে পারছি, আমিও হেলে পড়ছি খোলা দরজার দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোহার দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে যায়। আমি গিয়ে পড়ি সেই দরজার উপর। এক মুহূর্ত আগে পড়লে আমিও ট্রেন থেকে বাইরে পড়ে যেতাম। কী বাঁচা যে বেঁচেছি, তা শুধু আমিই জানি।

“সেই মুহূর্তে চার দিক থেকে কেবল চিৎকার আর আর্তনাদের শব্দ। হঠাৎ খেয়াল হল, কাকা কোথায়? খুঁজতে যে যাব, তারও উপায় নেই। কাঁধে, হাতে, পায়ে, কপালের কোণে চোট পেয়েছি। আর যে ভাবে পড়ে আছি, একা ওঠার সাধ্য নেই।”

‘সবকিছু কাঁপছিল’

দুর্ঘটনার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ভয়ঙ্কর সেই মুহূর্তের চিত্র তুলে ধরেছেন অনেকে, যাদের একজন দিনমজুর সঞ্জয় মুখিয়া।

এনডিটিভি জানিয়েছে, করমণ্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনে চেন্নাই যাচ্ছিলেন বিহারের বাসিন্দা সঞ্জয়। কিন্তু ট্রেনের টয়লেটে যাওয়ার পরই হঠাৎ বিশাল ঝাঁকুনি অনুভব করেন।

“সবকিছু কাঁপছিল। বুঝতে পারছিলাম, ট্রেনটি কাত হয়ে উল্টে যাচ্ছে।”

ওই ঘটনায় সঞ্জয় আহত হয়েছেন। তবে ঘটনার পরপরই উদ্ধার পান তিনি।

‘ঘাড়ের ওপর এসে পড়ে ১০-১৫ জন’

এনডিটিভির কাছে সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে আহত এক যাত্রী বলেন, “বগিটি যখন লাইন থেকে পড়ে যায় তখনই জেগে যাই। আমার গায়ের ওপর এসে পড়ে ১০-১৫ জন মানুষ। মাথা ও ঘাড়ে ব্যাথায় কাবু হয়ে গেছিলাম।”

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ট্রেন থেকে যখন কোনো রকমে বের হয়ে আসি তখন চারপাশে মানুষের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অঙ্গ পড়ে থাকতে দেখি। কারও হাত এখানে, কারও পা ওদিকে। অনেকের মুখমণ্ডল একেবারে থেতলে গেছে।

তিনটি কোচে ২৬ জনের একটি বড় দলের সঙ্গে কেরালার দিকে যাচ্ছিলেন মোহাম্মদ আকিব; তাদের দলের বেশিরভাগই ছাত্র।

আকিব বলেন, “আমরা এস-৪, এস-৩, এস-২ কোচের ভেতরে ছিলাম। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ শুনতে পাই। এরপর কোচগুলো উল্টে যায়। তবে আমরা সবাই নিরাপদ ছিলাম।”

বিধ্বস্ত কোচের জানালা দিয়ে দলটিকে বের করে আনা হয়। আকিবল বলেন, “আমরা ভাগ্যবান যে বেঁচে আছি। আমরা এখন কোথাও যেতে চাই না, বিহারে ফিরে যেতে চাই।”

রক্তের মধ্যে পড়ে কবিতার খাতা

করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনাস্থলে চাপ চাপ রক্ত, রক্তমাখা দেহের স্তূপ, এদিক-সেদিক ছড়িয়ে ছেঁড়া জামাকাপড়, খাবার, ব্যাগপত্র, বাচ্চাদের খেলনা; সেগুলোর সঙ্গে পড়ে আছে একটি কবিতার খাতাও।

প্রিয়জনকে উদ্দেশ্য করে সেখানে লেখা- ‘অল্প অল্প মেঘ থেকে হালকা হালকা বৃষ্টি হয়, ছোট্ট ছোট্ট গল্প থেকে ভালবাসা সৃষ্টি হয়....’।

আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, কবিতাটি কে লিখেছেন, কার জন্য লিখেছেন, তার বিন্দুবিসর্গ জানার উপায় এই মুহূর্তে নেই। তার বয়স কত, তাও জানার উপায় নেই। অপটু হাতে, সুন্দর করে নকশার কারসাজিও রয়েছে কবিতার লাইনের মাঝে মাঝে। হয়ত কবিতার খাতার মালিক দুর্ঘটনার কবলে পড়া ট্রেনটিতেই ছিলেন। দুর্ঘটনার অভিঘাত এতটাই বেশি ছিল যে, সেই কবিতার খাতা ছিটকে এসে পড়েছে ভাঙা লাইনে।

রেললাইনে লাশের স্তূপ

ঘটনাস্থলের বর্ণনায় কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা জানিয়েছে, সবকিছু কেমন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। ট্রেনের কামরা একটার ওপর আরেকটা উঠে গেছে, কোনোটা উল্টে গেছে। চাকাগুলো উপরের দিকে। কয়েকটা পাশের নয়ানজুলিতে পড়ে। মালগাড়ির উপরে উঠে পড়েছে আস্ত একটা ইঞ্জিন। যেন উড়ে গিয়ে ঘাড়ের উপর চড়ে বসেছে! রেললাইনে সিমেন্টের স্লিপারগুলি ভেঙেচুরে, লোহার রড বেরিয়ে গেছে। উপড়ে গেছে বিদ্যুতের খুঁটি। ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহগুলো ঢাকা সাদা কাপড়ে, তার মধ্যেই ভেসে আসে কান্নার আওয়াজ, চিৎকার, আর্তনাদ। আর সবকিছু ছাপিয়ে যায় অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন।

করমণ্ডল এক্সপ্রেস যাচ্ছিল শালিমার থেকে চেন্নাই। আর অন্য ট্রেনটি বেঙ্গালুরু থেকে হাওড়া যাচ্ছিল। তবে মালগাড়িটির গতিবিধি নিয়ে কারও কোনো ধারণাই নেই। কোথা থেকে এল, কোথায় যাচ্ছিল, কেউ কিছু জানেন না।

তবে স্থানীয়দের কেউ আনন্দবাজারকে বলেছেন, এই মালগাড়িটিকেই পিছন থেকে ধাক্কা মারে করমণ্ডল এক্সপ্রেস। ইঞ্জিন উঠে যায় মালগাড়ির উপর। লাইনচ্যুত হয়ে একাধিক কামরা পাশের ডাউন লাইনে আসা হাওড়াগামী ট্রেনের ওপর গিয়ে পড়ে।

করমণ্ডল এক্সপ্রেসের প্যান্ট্রি কারের সাতজন সহকর্মীর কারও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুরের শিমুলিয়া গ্রামের গৌরহরি মান্না বলেন, “সবে প্যান্ট্রি থেকে চা নিয়ে বেরিয়েছি, স্লিপার ক্লাসে যাব বিক্রি করতে, হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। ছিটকে পড়লাম ফ্লোরেই। কীভাবে, কী হলো, কিছুই জানি না। আমার ভাগ্নে তার একটু আগেই এসি কোচে গিয়েছিল স্ন্যাক্স নিয়ে। এখনও ওকে পাইনি।’’

মৃত্যুর মিছিলেই চুরি

দুর্ঘটনাস্থলের ভয়াবহ চিত্রের মধ্যেই আশেপাশের এলাকার অনেকে যেমন ছুটে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন, কেউ আবার হতাহত যাত্রীদের বিভিন্ন জিনিসপত্র চুরি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

আনন্দবাজার লিখেছে, কেউ মোবাইল খুঁজে পাচ্ছেন না। কেউ পচ্ছে না ব্যাগপত্র। এক নারীর গলার হার ছিনতাই হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন। তবে ঘটনাস্থলে এক পুলিশ সদস্য এমন অভিযোগের ব্যাপারে বলেন, ‘এই সময় কেউ এমনটা করবে, এটা ভাবতেও কষ্ট হয়’।

শুক্রবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টার দিকে ওই দুর্ঘটনাটি ঘটে। দুপুর ৩টার দিকে হাওড়ার নিকটবর্তী শালিমার স্টেশন থেকে ছাড়ে চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেস। এটি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে উড়িষ্যার বালেশ্বরে পৌঁছায়, আধ ঘণ্টা পর বাহানগা বাজারের কাছে ২৩ কামরার ট্রেনটি দুর্ঘটনায় পড়ে।

ভয়াবহ ওই ট্রেন দুর্ঘটনায় ভারতের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে শোক জানিয়েছেন। হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা এসেছে।

প্রধানমন্ত্রীর ন্যাশনাল রিলিফ ফান্ড থেকে নিহত পরিবারের জন্য ২ লাখ রুপি করে ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে আহতদের ৫০ হাজার রুপি দেওয়া হবে।