বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদক রাশিয়া শিগগিরই তাদের বিবেচনায় ‘অবন্ধু’ দেশগুলোর কাছে রপ্তানি করা জ্বালানির মূল্য নিজেদের মুদ্রা রুবলে নিতে যাচ্ছে।
Published : 24 Mar 2022, 01:59 PM
বুধবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারি কর্মকর্তাদেরকে রাশিয়ার মুদ্রায় মূল্য পরিশোধের উপায় বের করতে এক সপ্তাহ সময় বেঁধে দিয়েছেন।
রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি গ্যাজপ্রমকেও এ নির্দেশনার সঙ্গে সমন্বয় করে তাদের চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
মস্কোর নতুন এ পদক্ষেপে মূলত দেশটির গ্যাসের ক্রেতা ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিই বড় ধরনের ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছে।
ইউরোপ তার গ্যাসের ৪০ শতাংশই নেয় রাশিয়ার কাছ থেকে। এ জ্বালানি বাবদ তাদের প্রতিদিন ২০ থেকে ৮০ কোটি ইউরো মূল্য পরিশোধ করতে হয়; এতদিন তারা তা ইউরো বা ডলারে দিয়ে আসছিল।
কেন এই পরিবর্তন?
ইউক্রেইনে গত মাসে রাশিয়ার হামলার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডা এরই মধ্যে মস্কোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও জ্বালানি আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে; ইউরোপীয় ইউনিয়নও মস্কোর ওপর এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে।
এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে রাশিয়া গ্যাসের মুল্য রুবলে নেওয়ার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রাশিয়া যদি তার গ্যাসের মূল্য রুবলে পায়, সেক্ষেত্রে দেশটি পশ্চিমাদের দেওয়া বেশকিছু অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটাতে পারবে।
নরওয়েভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রিস্ট্যাড এনার্জির তথ্য মতে, রাশিয়ার গ্যাস কেনার প্রায় সব চুক্তিতেই মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে এতদিন পর্যন্ত ডলার বা ইউরোরই প্রাধান্য ছিল। নতুন ঘোষণা কার্যকর হলে এই প্রাধান্য কমে যাবে।
মস্কো তাদের ভাষায় ইউক্রেইনে ‘বিশেষ অভিযান’ শুরু করার পর পশ্চিমাদের একের পর এক নিষেধাজ্ঞার তোড়ে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের মান ডলারের বিপরীতে ৮৫ শতাংশ পড়ে গিয়েছিল। তবে কয়েকদিন পর থেকেই রুবল একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করে; সর্বশেষ বুধবার প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘোষণার পর মুদ্রাটির মানের ব্যাপক উল্লম্ফন দেখা যায়।
এই পরিবর্তনে সমস্যা কোথায়?
ঘর উষ্ণ রাখা ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউরোপ অনেকাংশেই রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল; যে কারণে রাশিয়ার জ্বালানি খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরাই দ্বিধাবিভক্ত।
বুধবার পুতিনের ঘোষণার পর ইউরোপে গ্যাসের পাইকারি মূল্যে ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে।
পাইপলাইন অপারেটর গ্যাসকেইডের তথ্য অনুযায়ী, জার্মানি থেকে পোল্যান্ডে ইয়ামাল-ইউরোপ পাইপলাইনের মাধ্যমে যাওয়া পূর্বমুখী গ্যাসের চাপও অনেকখানি কমে গেছে।
রুবলে লেনদেন এখনই সম্ভব?
আইন বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন যেসব চুক্তি আছে সেগুলোর শর্ত একপাক্ষিকভাবে বদলে ফেলার ক্ষমতা রাশিয়ার আছে বলে তারা মনে করছেন না।
“চুক্তি দুই পক্ষের মধ্যে হয়, এক্ষেত্রে সাধারণত মার্কিন ডলার বা ইউরো ব্যবহৃত হতো। এখন এক পক্ষ যদি বলে. ‘না, তোমাকে এভাবে মূল্য পরিশোধ করতে হবে’, সেক্ষেত্রে কোনো চুক্তিই থাকে না,” বলেছেন সিডনির ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির জননীতি ও শাসন ইনস্টিটিউটের মুখ্য অর্থনীতিক টিম হারকোর্ট।
হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবসার পরামর্শদাতা সুসান সাকমার বলছেন, “এই দাবি কতোটা জোরালো তা স্পষ্ট নয়।”
বুধবার যেভাবে রুবল-ডলার বিনিময়ে ঊর্ধ্বগতি এবং ইউরোপে পাইকারি গ্যাস মূল্যে উল্লম্ফন দেখা গেছে সম্ভবত সেটাই পুতিনের উদ্দেশ্য বলে মনে করছেন সাকমার।
“এটা (রুবলে মূল্য পরিশোধ) কার্যকরে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। এই সময়ের মধ্যে পুতিন দাম বাড়িয়ে দিতে পারেন। তেমনটা হলে তা তার স্বার্থ ভালোভাবেই পূরণ করবে,” বলেছেন তিনি।
কোনো কায়দা কি আছে?
বুলগেরিয়ার জ্বালানিমন্ত্রী আলেক্সান্ডার নিকোলোভ বলেছেন, সোফিয়ার এক ক্রেতা পক্ষ রুবলে লেনদেন সামলাতে পারবে।
“এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিকে সামনে রেখে সব ধরনের পদক্ষেপের জন্যই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি আমরা; এই পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। তাই বিদ্যমান চুক্তির অধীনে মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে কোনো ঝুঁকি নেই,” বলেছেন তিনি।
রিস্ট্যাডের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্লদিও গালিমবার্টি বলেছেন, “যেন রুবলে অর্থ পরিশোধ করা লাগে সেরকম নতুন চুক্তি রাশিয়ার পক্ষে করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারকে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রুবল রাখতে হবে বা খোলা বাজার থেকে রাশিয়ার মুদ্রা কিনতে হবে।”
দীর্ঘমেয়াদে কী প্রভাব পড়বে?
রাশিয়া, চীন, ইরান ও অন্যরা বিশ্ব বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের আধিপত্যে ও ওয়াশিংটন যেভাবে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করে তাতে বড় ধরনের আঘাত হানবে।
রাশিয়ার ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপ বিদেশি ঋণ শোধ ও আমদানি কমানোর সক্ষমতায় চাপ সৃষ্টি করতে পারে, এর কারণে তার অর্থনীতি আরও সঙ্কুচিত হতে পারে, বলেছেন ক্যাপিটাল ইকোনমিকস ইমার্জিং ইউরোপের অর্থনীতিবিদ লিয়াম পিচ।
তবে সব চ্যালেঞ্জ টপকে রাশিয়া যদি সফলভাবে মুল্য পরিশোধের মুদ্রায় আনা বদল বহাল রাখতে পারে, তাহলে তা বিশ্ব বাণিজ্যে ডলারের প্রভাব হ্রাসে বড় ধরনের ভুমিকা রাখবে; বাড়বে রুবল, ইউয়ান বা অন্য মুদ্রায় লেনদেনের চল।
এমনটা হলে দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণগ্রহণ ও ব্যয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।