মোদীর ভারতে সংবাদমাধ্যম কি স্বাধীনতা হারাচ্ছে?

সরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের দ্বারা ‘হয়রানির’ শিকার হওয়া ছাড়াও সরকারের সমালোচনা করে খবর প্রকাশের কারণে সরকারি বিজ্ঞাপন না পাওয়ার অভিযোগও উঠেছে।

রয়টার্স
Published : 4 March 2023, 02:32 PM
Updated : 4 March 2023, 02:32 PM

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে একটি ‘বিতর্কিত’ তথ্যচিত্র নির্মাণ এবং তা প্রদর্শনের পর ভারতে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির দুইটি কার্যালয়ে আয়কর কর্মকর্তাদের অভিযানের পর দেশটিতে সংবাদমাধ্যম এবং সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সময় সকাল ১১টার দিকে ভারতের আয়কর বিভাগের প্রায় ২০ জন কর্মকর্তা ও পুলিশ রাজধানী দিল্লিতে বিবিসির কার্যালয়ে উপস্থিত হন এবং কর্মীদের তাদের কম্পিউটারের কাছ থেকে সরে যেতে এবং মোবাইল ফোন তাদের হাতে তুলে দিতে নির্দেশ দেন।

কাছাকাছি সময়ে ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ে বিবিসির অন্য একটি কার্যালয়েও হাজির হন আয়কর বিভাগের কর্মকর্তারা।

আয়কর বিভাগ থেকে অবশ্য একে অভিযান নয় বরং ‘জরিপ’ নাম দেওয়া হয়। তাদের ব্যাখ্যা ছিল, বারবার অনুরোধ করার পরও বিবিসি কর্তৃপক্ষ ভারতে তাদের আয়-ব্যয় এবং কর সংক্রান্ত তথ্য সঠিকভাবে তাদের কাছে উপস্থাপন করছিল না।

আর বিবিসি কর্তৃপক্ষ বলেছিল, তারা কর কর্মকর্তাদের পূর্ণ সহযোগিতা করে যাচ্ছে। তাদের সংবাদকর্মীরা ‘নিরপেক্ষ থেকে ভয়ডরহীন ভাবে’ সংবাদ উপস্থাপন অব্যাহত রাখবে।

বিবিসির কার্যালয়ে অভিযানের তিন সপ্তাহ আগে ২০০২ সালে ভারতের গুজরাটে হিন্দ-মুসলিম দাঙ্গা নিয়ে একটি তথ্যচিত্র যুক্তরাজ্যে প্রদর্শন করা হয়। বিবিসির তৈরি ওই তথ্যচিত্রে গুজরাট দাঙ্গায় মোদীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। ওই সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মোদী।

‘ইন্ডিয়া: দ্য মোদী কোশ্চেন’ নামের তথ্যচিত্রটিকে বিতর্কিত কাহিনী ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বানানো ‘অপপ্রচার’ বলে অ্যাখ্যা দিয়ে ভারতে সেটির প্রদর্শন নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেটি দেখানো ও শেয়ার করায় উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ভারত সরকার।

তথ্যচিত্রটি এখন পর্যন্ত শুধু যুক্তরাজ্যে প্রদর্শন করা হয়েছে।

ওই তথ্যচিত্রের প্রদর্শন নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অঙ্গনও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল।

তারপরই বিবিসির কার্যালয়ে কর কর্মকর্তাদের হানা দেওয়ার ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই মোদী সরকারের অধিনে ভারতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ বিষয়ে ভারতের আটজন সাংবাদিক, শিল্প নির্বাহী এবং গণমাধ্যম বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলেছে।

তারা বলেন, সম্প্রতি কিছু সংবাদমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করে সংবাদ প্রকাশ করার কারণে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার দ্বারা ‍অভিযানের নামে হেনেস্তার শিকার হয়েছে। তাদের সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে না এবং কয়েকজন সাংবাদিক গ্রেপ্তারও হয়েছেন।

স্বাধীন অনলাইন মিডিয়া গ্রুপ ‘নিউজলন্ড্রি’র প্রধাননির্বাহী অভিনন্দন সেখরি বলেন, ‘‘ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার স্বর্ণযুগ কখনই ছিল না। কিন্তু বর্তমানে যে অবস্থায়, সেটাও কখনো ছিল না।”

মোদী সরকারকে নিয়ে সমালোচনামূলক খবর প্রকাশ করায় ভারতের আয়কর কর্মকর্তারা ২০২১ সালে দুইবার ‘নিউজলন্ড্রির’ কার্যালয়ে অভিযান চালিয়েছিল।

এছাড়া, অভিনন্দনের বিরুদ্ধে কর ফাঁকি এবং কর মূল্যায়ন প্রতিবেদন জাল করার অভিযোগে কর বিভাগ থেকে একটি ফৌজদারি মামলাও করা হয়। গত নভেম্বরে দিল্লির একজন বিচারক অবশ্য ওই অভিযোগ খারিজ করে দেন।

Also Read: মোদীকে নিয়ে বিবিসি’র তথ্যচিত্র: মুক্ত গণমাধ্যমের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র

Also Read: এবার মোদীকে নিয়ে বিবিসি’র তথ্যচিত্র প্রদর্শনের ঘোষণা ভারতীয় শিক্ষার্থীদের

Also Read: বিবিসির বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগ ভারতের আয়কর বিভাগের

পরে অভিনন্দন তার মৌলিক অধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর হামলার অভিযোগ এনে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। দিল্লি হাইকোর্টে যে মামলার শুনানি চলছে।

এ বিষয়ে ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা কাঞ্চন গুপ্তা বলেন, ‘‘বিবিসি ভারতে দুটি প্রাইভেট কোম্পানির অধীনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। অন্য যেকোনো বিদেশি কোম্পানির মতো তাদেরও যাচাই-বাছাইয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে এবং কর আইন তাদের উপরও প্রযোজ্য।”

রয়টার্সের কাছে এ কর্মকর্তা আরো দাবি করেন, মোদীকে নিয়ে ওই তথ্যচিত্র প্রদর্শনের আগেই আয়কর বিভাগ থেকে বিবিসিকে ১০টির বেশি নোটিস পাঠানো হয়েছিল।

তবে রয়টার্স স্বাধীনভাবে এ তথ্য যাচাই করতে পারেনি। কর অধিদপ্তর এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

২০১৪ সালে ভারতে প্রধানমন্ত্রী হন মোদী। তারপর ভারত ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স’ এ ১৪০তম অবস্থান থেকে নিচে নামতে শুরু করে। এছাড়া, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স এর তালিকায় গত বছর দেশটির অবস্থান ছিল ১৫০তম। তালিকায় এত নিচে আগে কখনো নামেনি দেশটি।

ভারত সরকার থেকে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স এর ওই তালিকা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা সংস্থাটির মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বলেছে, ভারতে একটি প্রাণবন্ত ও স্বাধীন গণমাধ্যম ব্যবস্থা রয়েছে।

সরকারি উদেষ্টা কাঞ্চন গুপ্তা সরকারের সমালোচনা করে সংবাদ প্রকাশের কারণে কোনো সংবাদমাধ্যমকে টার্গেট করার এবং সরকারি বিজ্ঞাপন না দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন। বলেন, ‘‘সরকার থেকে বারবার বলে দেওয়া হয়েছে, সংবাদ প্রচারের কারণে কোনো সাংবাদিককে হয়রানি করা অগ্রহণযোগ্য এবং বেআইনি।

তবে ‘দ্য এডিটরস গিল্ড অফ ইন্ডিয়া’ থেকে বলা হয়, ‘‘সংবাদ সংস্থাকে ভয় দেখানো এবং হয়রানি করার জন্য সরকারি সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করার যে প্রবণতা ভারতে রয়েছে, বিবিসির কার্যালয়ে অভিযান তারই অংশ।’’

২০২১ সালে সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে আয়কর কর্মকর্তাদের এরকম আরো চারটি অভিযানের কথা তারা উল্লেখ করেন।

২০২১ ‍সালের জুলাই মাসে ‘দৈনিক ভাস্কর’ এর কার্যালয়ে অভিযান চালান কর কর্মকর্তারা। অভিযোগ ছিল, সার্কুলেশনের দিকে দিয়ে ভারতের সর্ববৃহৎ এই পত্রিকাটি তাদের ৭০০ কোটি রুপি আয়ের উপর কর ফাঁকি দিয়েছে।

‘দৈনিক ভাস্কর’ কর্তৃপক্ষ কর কর্মকর্তাদের ওই অভিযোগের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্ত হন এবং মামলাটি এখনো চলছে।

ডিবি কর্পোরেশনের ‍অংশ ওই পত্রিকাটিতে কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় সরকারের অব্যবস্থাপনা এবং এই মহামারীতে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা গোপন করা নিয়ে ধারাবাহিক খবর প্রকাশ পায়।

সরকার থেকে অব্যবস্থাপনা এবং মৃত্যুর সংখ্যা গোপন করার অভিযোগ অস্বীকার করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পত্রিকাটির একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী রয়টার্সকে বলেন, শুধু পত্রিকা অফিসে আয়কর অধিদপ্তর থেকে অভিযানই নয় বরং কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে তাদের পত্রিকায় কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি নিয়ন্ত্রিত ছয়টি রাজ্য থেকে সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

Also Read: বিবিসির দিল্লি-মুম্বাই কার্যালয়ে দ্বিতীয় দিনের মত কর কর্মকর্তাদের অভিযান

Also Read: ভারতে টুইটার-ইউটিউবে মোদীকে নিয়ে বিবিসির তথ্যচিত্র না দেখাতে নির্দেশ

‘‘২০২২ সালের অগাস্ট ‍মাস পর্যন্ত যা অব্যাহত ছিল। এবং এ কারণে পত্রিকাটিকে ১০০ কোটি রুপির বেশি লোকসান গুণতে হয়েছে।”

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স থেকে বলা হয়, ভারতে বহু মানুষ এখনো পত্রিকা পড়েন। কিন্তু তারপরও দেশটির অনকে সংবাদ সংস্থা ঠিকঠাকমত সরকারি বিজ্ঞাপন না পাওয়ায় অর্থনৈতিকভাবে চাপে রয়েছে।

এছাড়া, মোদী ঘনিষ্ঠ ধনকুবেরদের কিছু মিডিয়া গ্রুপ অধিগ্রহণ করার ঘটনাকে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স থেকে ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীন কণ্ঠস্বরকে নিরব করে দেওয়ার প্রচেষ্টাও বলা হয়েছে।

ভারতের পার্লামেন্টে সরকারের পক্ষ থেকে গত বছর দেওয়া এক বিবৃতিতে জানানো হয়, দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছাপা পত্রিকা ও ইলেক্ট্রোনিক সংবাদমাধ্যমকে সাড়ে ছয় হাজার কোটি রুপির বিজ্ঞাপন দিয়েছে।

যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার বিজ্ঞাপন ব্যয় কমিয়েছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে সরকার ব্যয় কমায়নি বলে দাবি করেন কাঞ্চন গুপ্তা।

বলেন, ‘‘গণমাধ্যমকে অর্থায়নের ক্ষেত্রে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। আমরা এমন কোনো সংবাদমাধ্যম চাই না যারা আমাদের কাছ থেকে অর্থ পেতে আমাদের প্রতি অনুগত থাকে বা আমাদের পক্ষে খবর প্রচার করেন।”

খবর প্রকাশের কারণে শুধু সংবাদমাধ্যমকে নয় বরং সাংবাদিকদেরও হয়রানি ও গ্রেপ্তার হতে হয়।

কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) এর তথ্যানুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে অন্তত সাত জন সাংবাদিককে তাদের প্রকাশিত খবরের কারণে কারাগারে যেতে হয়। যা দেশটিতে গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক গ্রেপ্তারের ঘটনা।