ভারতে তৈরি কফসিরাপ সেবনে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ায় শিশুমৃত্যুর ঘটনায় এ সিরাপগুলোর উৎপাদন ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিয়মবিধির কার্যকারিতা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে।
Published : 12 Oct 2022, 09:27 PM
ভারতে বানানো চারটি কফ সিরাপ সেবনে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ায় প্রায় ৭০ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ওষুধগুলো পরীক্ষায় সেগুলোতে অনুনমোদিত মাত্রার ডাইইথিলিন গ্লাইসল ও ইথিলিন গ্লাইসল পাওয়া গেছে।
ভারতের মেইডেন ফার্মাসিউটিকেলের বানানো কফ সিরাপ চারটি হল: প্রোমেথাজাইন ওরাল সল্যুশন, কোফেক্সমালিন বেবি কফ সিরাপ, ম্যাকফ বেবি কফ সিরাপ ও ম্যাগ্রিপ এন কোল্ড সিরাপ।
এই সিরাপগুলোর উৎপাদন ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিয়মবিধির কার্যকারিতা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হওয়ার মধ্যে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এসব সিরাপ বিক্রি বন্ধ রাখতে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দিয়েছে এবং মেইডেন ফার্মাসিউটিক্যাল ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে নিয়ে এ বিষয়ে ‘আরও তদন্তের’ ঘোষণা দিয়েছে।
ঠিক কী ঘটেছিল গাম্বিয়ায়? এতগুলো শিশুর মৃত্যুর দায় আসলে কার? বিবিসি এক প্রতিবেদনে বিষয়টি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছে।
গাম্বিয়ায় কী সমস্যা হয়েছিল?
গত সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চারটি ব্র্যান্ডের কফ সিরাপ নিয়ে বৈশ্বিক সতর্কতা জারি করে বলেছে, সেগুলোর সঙ্গে কিডনি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্পর্ক থাকতে পারে।
গাম্বিয়ায় হঠাৎ করেই শিশুদের মধ্যে মারাত্মক কিডনি জটিলতা সংক্রান্ত অসুস্থতা দেখা দিয়েছে এবং অনেক শিশু মারা গেছে এমন খবর পাওয়ার পর ডব্লিউএইচও ওই সতর্কতা জারি করে।
পরে পরীক্ষাগারে ওই সিরাপগুলো পরীক্ষা করে সেগুলোতে অনুনমোদিত মাত্রার ডাইইথিলিন গ্লাইসল ও ইথিলিন গ্লাইসল পাওয়া গেছে বলে বলে জানায় ডব্লিউএইচও। অতিরিক্ত মাত্রার ডাইইথিলিন গ্লাইসল ও ইথিলিন গ্লাইসল মানুষের জন্য ক্ষতিকারক এবং শরীরে নেওয়ার পর তা মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এবং কফ সিরাপগুলো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মেইডেন ফার্মাসিউটিকেল জানিয়ে, ওই কফ সিরাপগুলো শুধুমাত্র গাম্বিয়ায় রপ্তানি করা হয়েছে।
মেইডেন ফার্মাসিউটিকেল সম্পর্কে কী জানা যায়?
মেইডেন ফার্মাসিউটিক্যাল বলেছে, তারা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মান বজায় রেখে ওষুধ প্রস্তুত করে। যদিও তাদের তৈরি কিছু ওষুধ ভারতেই জাতীয় বা রাজ্য পর্যায়ে মান নিয়ন্ত্রণের পরীক্ষায় উৎরাতে পারেনি।
এই কোম্পানির ওষুধ নিয়ে সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী:
#এই কোম্পানির একটি সিরাপ রাজ্য পর্যায়ের মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার পর ২০১১ সালে বিহার রাজ্যে মেইডেন ফার্মাসিউটিকালকে কালো তালিকাভূক্ত করা হয়।
#ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করায় ২০১৮ সালে ভারতের জাতীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করে।
#এই কোম্পানির ওষুধ ২০২০ সালে জম্মু ও কাশ্মীরে মান-নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়।
#সর্বশেষ ২০২২ সালে মেইডেন ফার্মাসিউটিক্যালের ওষুধ কেরালা রাজ্যে মান নিয়ন্ত্রণের পরীক্ষায় চার চারবার ব্যর্থ হয়।
হরিয়ানা রাজ্যের এই ওষুধ কোম্পানিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, গাম্বিয়ায় শিশু মৃত্যুর খবর পেয়ে তারা ‘হতবাক’ হয়েছে। কারণ, তারা ‘খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে ভারতের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং হরিয়ানা রাজ্যের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সব ধরনের প্রোটোকল অনুসরণ করে’।
এ বিষয়ে বিবিসি থেকে হরিয়ানা রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী অনিল ভিজকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘যে কফ সিরাপগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলো পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। যদি সেখানে কোনো ভুল বা অনিয়ম পাওয়া যায় তবে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
ভারতে ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষা কতটা কার্যকর?
ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ ওষুধ উৎপাদনকারী দেশ। দেশটি মূলত জেনেরিক ওষুধ উৎপাদন করে। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং এশিয়া মহাদেশের বাকি অংশে সবচেয়ে বেশি ওষুধ সরবরাহকারী দেশ ভারত।
ভারতে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কঠোর মান-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং উৎপদান কার্যক্রম মেনে চলতে হবে।
তারপরও ভারতের ওষুধ কোম্পানিগুলোকে নানা সমালোচনা মোকাবেলা করতে হয়। এমনকী কিছু কিছু কোম্পানির ওষুধের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের না হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিসট্রেশনের (এফপিএ) মত কয়েকটি দেশের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ভারতের ওষুধ নিষিদ্ধ করেছে।
ভারতের ফার্মাসিউটিকাল শিল্পের একটি বিশ্লেষণে, তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর জন্য কম অর্থায়ন এবং বিশুদ্ধতার মানদণ্ড মেনে চলা নিশ্চিত করতে আগ্রহের অভাবের সাথে মূল সমস্যা হিসাবে ওষুধের মান-নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে আইনগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা না থাকার এবং সেগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
গণস্বাস্থ্য সুরক্ষার অধিকার নিয়ে কাজ করছেন এমন একজন দিনেশ ঠাকুর আরো একটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ভারতে ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করলে তার সাজা তুলনামূলক কম। এজন্য মাত্র ২০ হাজার রুপির মত জরিমানা এবং সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে।
গাম্বিয়ায় শিশুমৃত্যু: ভারতে বানানো ৪ কাশির সিরাপ নিয়ে ডব্লিউএইচওর সতর্কতা
‘‘যদি না নিম্ন-মানের ওষুধ এবং সে কারণে মৃত্যুর মধ্যে সরাসরি যোগসূত্র স্থাপনের দায়ে কাউকে অভিযুক্ত করা হয় তবে সাধারনত এটুকু শাস্তিই হয়।”
এছাড়াও, ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে মান নির্ধারণ করে দিয়েছে তা যেসব দেশের জাতীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা মেনে চলে ভারত তার অন্তর্ভুক্ত নয়।
মান যাচাই করা কী উচিত ছিল না গাম্বিয়ার?
গাম্বিয়ার ঘটনায় ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত শুরু করা হয়েছে। তবে মন্ত্রণালয় থেকে এও বলা হয়েছে, ‘‘সাধারণত আমদানিকারক দেশ তাদের আমদানিকৃত পণ্য পরীক্ষা করে এবং গুণগতমান নিয়ে নিজেরা সন্তুষ্ট হতে পারছে কিনা তা যাচাই করে দেখে।”
ওদিকে গাম্বিয়ার ওষুধ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মার্কিউ জাননেহ কইরা বলেছেন, তারা কফ সিরাপের পরিবর্তে ম্যালেরিয়ার ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক এবং ব্যাথ নাশক ওষুধ পরীক্ষায় অগ্রাধিকার দেয়।
তার এ বক্তব্যের বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে বিবিসি সংস্থাটির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু তারা কোনও সাড়া দেয়নি।
গাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আদামা ব্যারো প্রতিজ্ঞা করে বলেছেন, যে কারণে হৃদয়বিদারক এ ঘটনা ঘটেছে তিনি ‘তার শেষ দেখে ছাড়বেন’। একইসঙ্গে তিনি ‘ওষুধ ও খাদ্যের মান যাচাইয়ের জন্য’ জাতীয় পর্যায়ে একটি মান নিয়ন্ত্রক পরীক্ষাগার নির্মাণের ঘোষণাও দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘‘গাম্বিয়া নিম্নমানের আমদানি বন্ধ করতে সুরক্ষা ব্যবস্থা নেবে।”
আন্তর্জাতিক মানবিক চিকিৎসা সংস্থা এমএসএফ- এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা চায় যেসব দেশের কাছে ওষুধের মান যাচাইয়ের পর্যাপ্ত সক্ষমতা আছে তারা গাম্বিয়ার মত নিম্ন আয়ের দেশকে এ বিষয়ে সহায়তা করুক।
‘‘এটি শুধুমাত্র ওষুধ আমদানিকারক দেশের উপর সব দায় চাপানো বিষয় নয়,” বলেছে তারা।
গাম্বিয়ার ঘটনার পর এরইমধ্যে নাইজেরিয়া সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। দেশটির জাতীয় ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড কন্ট্রোল থেকে ভারত ছাড়ার আগে অনুমোদিত এজেন্টদের দিয়ে ফার্মাসিউটিক্যালসের সব আমদানি পণ্য পরীক্ষা করে তারপর তা পাঠাতে বলেছে।