ইসরায়েলের এই অভিযানে উচ্চ মূল্য চুকাতে হচ্ছে গাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের। যুদ্ধে এরইমধ্যে ৩৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। ছোট্ট এই ভূখণ্ডটি দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে।
Published : 07 Apr 2024, 08:22 AM
গতবছর ৭ অক্টোবর হামাসের নজিরবিহীন হামলার শিকার হওয়ার পর ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র এই সংগঠনটিকে ‘গুঁড়িয়ে দেওয়ার এবং নিশ্চিহ্ন করে ফেলার’ প্রতিজ্ঞা নিয়ে গাজার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইসরায়েল। যাতে হামাস আর কোনো দিন দেশটির জন্য হুমকি হয়ে উঠতে না পারে।
গাজায় ইসরায়েলের সেই অভিযানের ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। এ ছয় মাসে ৩৩ হাজারের বেশি বেসামরিক ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের একটি বড় অংশ নারী ও শিশু। গাজার বেশিরভাগ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। গাজার প্রায় ২৩ লাখ মানুষের সবাই বাস্তুচ্যুত, অনাহারে দিন কাটাচ্ছে এবং ছোট্ট এই ভূখণ্ডটিতে দুর্ভিক্ষ আসন্ন।
ইসরায়েলের দাবি, তাদের অভিযানে হাজার হাজার হামাস যোদ্ধা নিহত হয়েছে। সেইসঙ্গে তারা গাজায় হামাসের ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের বেশিরভাগটাই ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়েছে। এই সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেই সবার চোখের আড়ালে হামলা চালাতো হামাস।
এই যে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) ‘হামাসকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে এবং সব জিম্মিদের মুক্ত করে আনার’ প্রতিজ্ঞা করে গাজা যুদ্ধ শুরু করেছিল, সে যুদ্ধে নিজেদের লক্ষ্য পূরণে তারা ঠিক কত দূর অগ্রসর হয়েছে?
বিবিসি আইডিএফ-র বিবৃতি, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের পোস্ট এবং ইসরায়েল যেসব প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের লক্ষ্যে অবিচল রয়েছে সেগুলো যাচাই এবং মূল্যায়ন করে দেখেছে।
এখন পর্যন্ত কতজন হামাস নেতা নিহত হয়েছেন?
আইডিএফ কামান্ডারদের বরাত দিয়ে প্রকাশ করা বিভিন্ন সংবাদ অনুযায়ী ৭ অক্টোবরের আগে গাজায় হামাসের ৩০ হাজার যোদ্ধা রয়েছে বলে ধারণা করা হত।
তবে ইসমাইল হানিয়েহ-র মত হামাসের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই বিদেশে অবস্থান করেন। হামাসের সশস্ত্র বাহিনীর নেতারা অবশ্য গাজার ভেতরেই থাকেন বলে ধারণা করা হয়।
সম্প্রতি এক বিবৃতিতে আইডিএফ দাবি করেছে, গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তারা হামাসের প্রায় ১৩ হাজার যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। যদিও কিভাবে তারা এই হিসাব করেছে সে বিষয়ে কিছু জানায়নি।
শুধু সংখ্যা নয় বরং ইসরায়েল বেশ কয়েকজন হামাস নেতার নামও উল্লেখ করেছে যাদের তারা অভিযানে হত্যা করার দাবি করেছে।
বিবিসি জানায়, গত অক্টোবর থেকে আইডিএফ মোট ১১৩ জন হামাস নেতার নাম উল্লেখ করেছে। যাদের হত্যা করা হয়েছে বলে তারা দাবি করেছে। এদের বেশিরভাগকেই যুদ্ধের প্রথম তিন মাসে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় এ বছর মার্চ মাস পর্যন্ত শেষ তিন মাসে আইডিএফ হামাসের কোনো জ্যেষ্ঠ নেতাকে গাজায় হত্যা করার খবর দেয়নি।
গত ২৬ মার্চ আইডিএফ হামাসের সামরিক শাখার ডেপুটি কমান্ডার মারওয়ান ঈসাকে হত্যা করার কথা জানায়। যার নাম ইসরায়েলের ‘মোস্ট ওয়ানটেড’ তালিকায় ছিল এবং গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনিই হামাসের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ নেতা যাকে ইসরায়েলি বাহিনী হত্যা করেছে বলে দাবি করেছে। যদিও হামাস মারওয়ান ঈসা নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেনি। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য বলেছে, তাদের বিশ্বাস মারওয়ান ঈসা নিহত হয়েছেন।
আইডিএফ এরকম কয়েকজনের নামও প্রকাশ করেছে। বলেছে, এরা হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা যারা তাদের অভিযানে নিহত হয়েছে।
আইডিএফ যে নামগুলো প্রকাশ করেছে তারা আসলেই হামাসের সদস্য ছিল কিনা তা যাচাই করা সম্ভব না বলে জানিয়েছে বিবিসি।
বলেছে, আইডিএফ গাজা যুদ্ধে নিহত হামাস নেতাদের নামের যে তালিকা প্রকাশ করেছে সেখানে একটি নাম মোস্তফা থুরাইয়া। যিনি আদতে একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ছিলেন। গত জানুয়ারিতে দক্ষিণ গাজায় দায়িত্ব পালনের সময় তার গাড়িতে হামলা চালায় ইসরায়েল।
বিবিসি ওই তালিকায় ভুয়া নাম পাওয়ার কথাও জানিয়েছে।
গাজার বাইরে হামাসের রাজনৈতিক নেতা সালেহ আল-আরৌরি গাজাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর নিহত হয়েছেন। গত জানুয়ারিতে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে একটি বিস্ফোরণে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর উপ প্রধান সালেহ আল-আরৌরিসহ চারজন নিহত হন। ইসরায়েল থেকে ড্রোনের মাধ্যমে ওই হামলা চালানো হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়।
এ বিষয়ে বিবিসি কয়েকজন বিশেষজ্ঞর সঙ্গে কথা বলেছে এবং তারা বলেছেন, ইয়াহিয়া সিনওয়ারসহ গাজায় হামাসের পরিচিত অনেক নেতাই এখনো জীবিত আছেন বলে তাদের বিশ্বাস।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষক মিরাভ জোন্সজেইন বিবিসিকে বলেন, “আইডিএফ এখনো হামাস নেতৃত্বের শীর্ষে থাকা নেতাদের নাগাল পায়নি।
“উভয়ই প্রধান নেতাদের কাছে যাওয়ার প্রতীকী স্তরে এবং হামাসকে ভূখণ্ডের অধিকারী হিসাবে প্রতিস্থাপনের স্তরেও, এটি এমন কিছু যা এখনও তারা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি।”
কতজন জিম্মি এখনও গাজায় রয়ে গেছেন?
ইসরায়েল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়া তথ্যানুযায়ী গত ৭ অক্টোবর হামাস দেশটি থেকে ২৫৩ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যায়।
তাদের মধ্যে:
# গত নভেম্বরে ছয় দিনের যুদ্ধবিরতির সময় বন্দি বিনিময় চুক্তিতে ১০৯ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস।
# তিন জিম্মিকে সরাসরি সামরিক অভিযানের মাধ্যমে মুক্ত করে এনেছে ইসরায়েলি বাহিনী।
# ১২ জিম্মির মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। তাদের মধ্যে তিন জন ইসরায়েলের অভিযানে সময় তাদের গুলিতে নিহত হয়েছে।
# শনিবার ইলাদ কাৎজির নামে আরেক জিম্মির মৃতদেহ উদ্ধারের কথা জানিয়েছে ইসরায়েল। যিনি গাজার আরেক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক জিহাদের হাতে বন্দি ছিলেন।
এখনও বেঁচে থাকা জিম্মিদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী ১৮ বছর এবং সবচেয়ে বেশি ৮৫ বছরের ব্যক্তিরা রয়েছেন।
বাকি ১২৯ জিম্মির মধ্যে অন্তত ৩৪ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েল।
অন্যদিকে হামাস বলেছে, নিহত জিম্মির সংখ্যা আরও বেশি। এজন্য তারা আইডিএফ-র আকাশ হামলাকে দায়ী করেছে।
যদিও কারও দাবিই যাচাই করার কোনো উপায় নেই বলে জানিয়েছে বিবিসি।
ইসরায়েলি জিম্মিদের মধ্যে চার বছর ও ৯ মাসের দুইটি শিশুও ছিল। যারা মারা গেছে বলে শোনা যায়। তবে সে খবর নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
হামাসের সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের কতটুকু ধ্বংস হয়েছে?
হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার প্রতিজ্ঞার অংশ হিসেবে ইসরায়েল গাজায় হামাসের ভূগর্ভস্থ বিস্তৃত সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক ধ্বংস করার প্রতিজ্ঞাও করেছে। ওই সব সুড়ঙ্গ দিয়ে পণ্য এবং মানুষ যাতায়াত করতো।
আইডিএফ মুখপাত্র জনাথন কনরিকাস গত অক্টোবরে বলেছিলেন, “যদি গাজা স্ট্রিপের কথা ভাবেন তবে সেটির এক স্তর বেসামরিকদের জন্য এবং অন্য আরেকটি স্তর হামাসের জন্য। আমরা হামাসের তৈরি ওই দ্বিতীয় স্তরে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি।”
আর যুদ্ধ শুরুর আগে হামাস বলেছিল, তাদের সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের দৈর্ঘ্য প্রায় পাঁচশ কিলোমিটার।
বিবিসি থেকে আইডিএফ কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তারা কতগুলো সুড়ঙ্গ এবং মোট সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কের কত শতাংশ ধ্বংস করতে পেরেছে। জবাবে তারা বলেন, তাদের সেনাবাহিনী গাজায় সন্ত্রাসীদের অবকাঠামোর একটি বড় অংশ ধ্বংস করেছে।
আইডিএফ মাঝেমধ্যেই হামাসের বিভিন্ন সুড়ঙ্গের ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করে। সেগুলোতে তারা প্রবেশ করেছে। যেমন: গত বছর নভেম্বরে তারা একটি সুড়ঙ্গের ভিডিও প্রকাশ করে বলে সেটি গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল-শিফার নিচে অবস্থিত। যেটি হামাসের কমান্ড সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
আইডিএফ এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মাধ্যমে সুড়ঙ্গ নিয়ে যেসব তথ্য প্রকাশ করেছে তা এক জায়গায় করে হিসাব নিকাশ করেও এর পরিষ্কার কোনো চিত্র পায়নি বিবিসি।
ইসরায়েলের অভিযানের উচ্চ মূল্য চুকাতে হচ্ছে:
ইসরায়েলের এই অভিযানে উচ্চ মূল্য চুকাতে হচ্ছে গাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের। যুদ্ধে এরইমধ্যে ৩৩ হাজারের বেশি বেসামরিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিহতের যে চিত্র প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে নিহতদের মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি নারী ও শিশু।
হামাসের অবকাঠামো ধ্বংস করার নামে ইসরায়েল যেভাবে নির্বিচারে আকাশ হামলা চালিয়েছে তাতে গাজার অধিকাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত এবং গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। জাতিসংঘের হিসাব মতে গাজার ভেতরেই ১৭ লাখের বেশি মানুষ শরণার্থী হয়ে পড়েছেন।
আবাসিক এলাকাগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, রাস্তা-ঘাট, বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয়ে গেছে, কৃষিজমি লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।
কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গাজার ৫৬ শতাংশের বেশি ভবন হয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।
কিন্তু গাজা যুদ্ধের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও ইসরায়েল এ যুদ্ধে তাদের লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছে কিনা তার স্পষ্ট কোনো চিত্র এখনও পাওয়া যায়নি।