জেসিন্ডা অরডার্ন: বিদায় নিচ্ছেন ‘সহানুভূতিশীল’ এক নেতা

ক্রাইস্টচার্চ হত্যাকাণ্ডের পর জানানো প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজের সহানুভূতিশীল নেতৃত্বের ধরন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অরডার্ন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Jan 2023, 11:35 AM
Updated : 19 Jan 2023, 11:35 AM

প্রধানমন্ত্রিত্বকালে জেসিন্ডা অরডার্ন ছোট্ট নিউ জিল্যান্ডকে বিশ্বের দরবারে বামধারার রাজনীতি ও নারী নেতৃত্বের আইকন হিসেবে তুলে ধরেছিলেন।

২০১৯ সালে ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে এক উগ্রবাদী নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে ৫১ জনকে হত্যা ও ৪০ জনকে আহত করার পর জানানো প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজের সহানুভূতিশীল নেতৃত্বের ধরন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ৪২ বছর বয়সী এ নারী।

জাতিসংঘের বৈঠকে শিশু কোলে হাজির হওয়া কিংবা মুসলিমদের লক্ষ্য করে চালানো ওই হত্যাযজ্ঞের পর হিজাব পরে যেভাবে বিশ্ববাসীর মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিলেন, প্রায় একইভাবে তিনি বৃহস্পতিবার তিন সপ্তাহের মধ্যে পদত্যাগের নাটকীয় ঘোষণা দিয়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে স্থান করে নিয়েছেন।

এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে নিউ জিল্যান্ডের সবচেয়ে কমবয়সী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অরডার্ন তার ঘটনাবহুল শাসনকাল বারবারই ‘শক্ত হও, দয়ালু হও’ মন্ত্র আওড়ালেও তার উদার নেতৃত্ব এবং সংকট মোকাবেলার দক্ষতা প্রায়সময়ই তার সরকারের দুর্বলতা ঢাকতে পারেনি বলে লিখেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। 

একাধারে ব্যক্তিত্ববান ও সহজে আকৃষ্ট করার ক্ষমতাসম্পন্ন অরডার্নের প্রতিকূল সময়েও হাসতে পারা এবং হৃদয় থেকে উৎসারিত কথা বলতে পারার দক্ষতা ‘বিজয়ী হওয়ার ফর্মূলায়’ পরিণত হলে লেবার পার্টির এ নেতা ২০১৭ সালে নিউ জিল্যান্ডের ক্ষমতায় বসেন।

২০২০ সালে তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে পুনরায় ক্ষমতাসীন হলে নিউ জিল্যান্ডে কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবার বিশুদ্ধ বামধারার একটি সরকারের আবির্ভাব ঘটে। 

তার পাঁচ বছরের নেতৃত্বকালে নিউ জিল্যান্ড অভূতপূর্ব সব ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ২০১৯ সালে এক শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীর হাতে ক্রাইস্টচার্চে অর্ধশতাধিক মুসলিম মুসল্লীর হত্যাকাণ্ড, হোয়াইট আইল্যান্ড আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত আর তার পরের বছর থেকে মহামারী।

“আমার ধারণা, আমি নিউ জিল্যান্ডকে এমন এক বিশ্বাস দিতে পেরেছি, যেখানে আপনি শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি দয়ালু, সহানুভূতিপরায়ণ হলেও দৃঢ়সঙ্কল্পবদ্ধ, আশাবাদী এবং একইসঙ্গে লক্ষ্যে নিবদ্ধ হতে পারবেন।

“আপনি আপনার নিজের ধরনের নেতা হতে পারবেন, যিনি জানবেন, কখন কী করতে হবে,” পদত্যাগের আবেগঘন ঘোষণায় বলেন অরডার্ন।

ক্রাইস্টচার্চে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীর ওই হামলাকে ‘সন্ত্রাসী ঘটনা’ অ্যাখ্যা দিয়ে, হিজাব পরে মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করে, নিউ জিল্যান্ড যে ‘শোকে একতাবদ্ধ’ তা জানিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রশংসা আদায় করে নিয়েছিলেন তিনি।

ওই হত্যাকাণ্ডের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আধা-স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নিষিদ্ধ এবং অন্য ধরনের বন্দুক ব্যবহারে বিধিনিষেধও আরোপ করতে পেরেছিলেন তিনি; প্রতিবছর অসংখ্য নির্বিচার হত্যাকাণ্ড দেখার পরও যা এখন পর্যন্ত করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র।

অনলাইনে ঘৃণা ও বিদ্বেষের ইতি টানতে বৈশ্বিক প্রচারণা শুরুর পর থেকে তাকে প্রায়শই অনলাইনে কট্টর ডানপন্থিদের আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে।

অর্ধেকের বেশি নারী সদস্য আর সর্বোচ্চ সংখ্যক আদিবাসী মাউরি আইনপ্রণেতাদের নিয়ে গঠিত নিউ জিল্যান্ডের সবচেয়ে বৈচিত্রপূর্ণ পার্লামেন্টের সভাপতিত্ব করে অরডার্ন ২০২০ সালে ফের বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনামে উঠে আসেন।

দৃশ্যপটে কোভিড হাজির হওয়ার পর, প্রথম যে বিশ্বনেতারা সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে দেশবাসীকে বাঁচাতে ‘শূন্য-সহনশীলতার কৌশল’ নিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন তাদের একজন। 

তার এ পদক্ষেপের ফলে নিউ জিল্যান্ডে কোভিডে মৃত্যু বিশ্বের বহু উন্নত দেশের তুলনায় অনেক কম দেখা গেছে।

তবে একজনের সংক্রমণ ধরা পড়লেই দেশজুড়ে লকডাউন দেওয়াসহ তার এ ধরনের ‘আগেভাগে, দৃঢ়ভাবে’ কাজ করার দৃষ্টিভঙ্গি সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।

সে কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার জনপ্রিয়তা বাড়লেও, দেশে তার রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; সংকট সামলানো ও উদারতার বাইরে নিজের নেতৃত্বের দক্ষতা প্রমাণেও তিনি প্রায়শই হিমশিম খেয়েছেন।

আবাসন সংকট, জীবনযাপনের বাড়ন্ত খরচ, বন্ধকি সুদের হারবৃদ্ধি এবং অপরাধ নিয়ে বাড়তে থাকা উদ্বেগের কারণে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তার জনপ্রিয়তা অনেকখানি পড়ে গেছে; অবশ্য তারপরও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে অনেক বেশি জনপ্রিয়।

নেতৃত্ব হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দেওয়া অরডার্নের সাশ্রয়ী দামে আবাসন কর্মসূচি এখন ভুলত্রুটি অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নেওয়া ব্যবস্থার অগ্রগতিও ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে।

মাত্র ৩৭ বছর বয়সে, বিশ্বের সবচেয়ে কমবয়সী নারী সরকারপ্রধান হয়ে বৈশ্বিক অঙ্গনে আবির্ভাব ঘটেছিল তার।

‘জেসিন্ডাম্যানিয়ার’ ঢেউয়ে ভাসা নিউ জিল্যান্ডে নারীর অধিকার, শিশু দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক অসাম্য নির্মূলের লক্ষ্যে ধারাবাহিক আবেগঘন প্রচারণা চালিয়ে যান তিনি।

একটি খ্রীস্টান মরমন পরিবারে মা এবং পুলিশ কর্মকর্তা বাবার সঙ্গে বেড়ে উঠলেও সমকামিদের নিয়ে অবস্থানকে কেন্দ্র করে চলতি শতকের প্রথমদিকেই ওই বিশ্বাস ত্যাগ করেন অরডার্ন; এরপর থেকে নিজেকে ‘অজ্ঞেয়বাদী’ হিসেবেই পরিচয় দিয়েছেন তিনি।

লেবার পার্টির নেতা হওয়ার কয়েকঘণ্টা পর ‘কবে সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন’ এমন প্রশ্নের জবাবে এ রাজনীতিক বলেছিলেন, “২০১৭ সালেও কর্মক্ষেত্রে কোনো নারীকে এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে, এমনটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।” 

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ৮ মাস পর কন্যা শিশুর জন্ম দেন তিনি, হন প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে সন্তান জন্ম দেওয়া দ্বিতীয় নারী। তার আগে পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মা হয়েছিলেন।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে, তিন মাসেরও কম বয়সী সন্তান নেভে তে আরোহা’কে নিয়ে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনেও যোগ দেন তিনি। 

অনেকেই প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার গর্ভধারণ ও মাতৃত্বকালীন ছুটিকে নারী নেতৃত্বের অগ্রগতির প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন; এর ধারাবাহিকতায় বিশ্বজুড়ে ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সানা মারিনের মতো প্রগতিশীল নারী নেতৃত্বের ঢেউও দেখা যায়।

নভেম্বরে ওয়েলিংটনে মারিনের সঙ্গে এক বৈঠকের পর ‘কেবল নারী ও কমবয়সী হওয়ায় এই বৈঠক কিনা’ এমন প্রশ্নে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন অরডার্ন।

বলেছিলেন,“বারাক ওবামা ও জন কি-র বৈঠকের পর তারা সমবয়সী বলে বৈঠক করেছেন এমন প্রশ্ন কেউ কখনো করেছিল কিনা ভাবছি। দুই নারীর বৈঠকে বসার একমাত্র কারণ তাদের নারী পরিচয় নয়।”

আরও খবর:

Also Read: প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ছেন নিউ জিল্যান্ডের জেসিন্ডা অরডার্ন