অনেক উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা ও নাটকীয়তার ভরা এক আইনি লড়াইয়ের পর অবশেষ মুক্ত জীবনে ফিরছেন উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাসাঞ্জ।
Published : 25 Jun 2024, 12:20 PM
যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচরবৃত্তি আইন লঙ্ঘনের একটি অপরাধে দোষ স্বীকার করে নেওয়ার চুক্তিতে উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ যুক্তরাজ্যের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
চুক্তি অনুযায়ী অ্যাসাঞ্জকে চলতি সপ্তাহে প্রশান্ত মহাসাগরীয় নর্দান মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জে মার্কিন একটি আদালতে হাজির হতে হবে। অ্যাসাঞ্জ বুধবার সকালেই এই আদালতে হাজির হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কৃত ‘অপরাধের’ জন্য মারিয়ানার মার্কিন আদালত অ্যাসাঞ্জকে ৬২ মাসের কারাদণ্ড দেবে বলে জানা গেছে। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাজ্যে কারাবন্দি থাকার সময়কে তার সাজা খাটা হিসেবে গণ্য করা হবে। ফলে তাকে আর কারাগারে যেতে হবে না এবং অস্ট্রেলিয়ায় নিজ বাড়িতে ফেরার অনুমতি দেওয়া হবে।
অনেক উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা ও নাটকীয়তার ভরা এক আইনি লড়াইয়ের পর অবশেষ মুক্ত জীবনে ফিরছেন রাষ্ট্রীয় বহু গোপন তথ্য ফাঁস করে যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশের সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেওয়া প্রতিষ্ঠান উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অ্যাসাঞ্জের জীবন ও তার আইনি লড়াইয়ের ঘটনাগুলো নিচে তুলে ধরা হল।
জুলাই, ১৯৭১- অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের সমুদ্রতীরবর্তী শহর টাউন্সভিলে জন্ম হয় অ্যাসাঞ্জের। তার বাবা-মা থিয়েটারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অ্যাসাঞ্জ কিশোর বয়সেই একজন কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে খ্যাতি পান।
১৯৯৫- হ্যাকিংয়ের দায়ে জরিমানার মুখোমুখি হন। একই অপরাধ আবার করবেন না শর্তে কারাদণ্ড এড়ান।
২০০৬- উইকিলিকস প্রতিষ্ঠা করেন। গোপনীয় ও সংবেদনশীল তথ্য ফাঁসকারীদের জন্য একটি ইন্টারনেটভিত্তিক ‘ডেড লেটার ড্রপ’ তৈরি করেন।
৫ এপ্রিল, ২০১০- উইকিলিকস যুক্তরাষ্ট্রের একটি হেলিকপ্টার থেকে ফাঁস হওয়া একটি ভিডিও প্রকাশ করে, তাতে একটি বিমান হামলায় রয়টার্সের দুই সাংবাদিকসহ বেসামরিকদের হত্যা করতে দেখা যায়।
২৫ জুলাই, ২০১০- উইকিলিকস ৯১ হাজারেরও বেশি নথি প্রকাশ করে যার বেশিরভাগই আফগান যুদ্ধ সম্পর্কিত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রতিবেদন।
অগাস্ট, ২০১০- সুইডেনের আইন কর্মকর্তার দপ্তর ধর্ষণ ও যৌন হেনেস্তার অভিযোগে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এই অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেন অ্যাসাঞ্জ।
অক্টোবর, ২০১০- ইরাক যুদ্ধের ধারাবিবরণীসহ ৪ লাখ সামরিক ফাইল প্রকাশ করে উইকিলিকস। পরে মাসে এটি যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার কূটনৈতিক বার্তা প্রকাশ করে। এগুলোতে বিদেশি নেতাদের অকপট মতামত ও নিরাপত্তা হুমকির স্থূল মূল্যায়নও ছিল।
১৮ নভেম্বর, ২০১০- সুইডেনের একটি আদালত যৌন অপরাধের অভিযোগে অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়। যৌন অপরাধের কথা অস্বীকার করেন অ্যাসাঞ্জ।
ডিসেম্বর, ২০১০- ইউরোপীয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ভিত্তিতে লন্ডনে গ্রেপ্তার হন অ্যাসাঞ্জ কিন্তু জামিনে মুক্তি পান।
ফেব্রুয়ারি, ২০১১- লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার হাকিম আদালত অ্যাসাঞ্জকে সুইডেনের কাছে প্রত্যর্পণের আদেশ দেয়। এর বিরুদ্ধে আপিল করেন অ্যাসাঞ্জ।
মে, ২০১২- আপিলের জবাবে যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট অ্যাসাঞ্জকে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি করার জন্য সুইডেনে প্রত্যর্পণের রায় দেয়।
১৪ জুন, ২০১২- ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্ট অ্যাসাঞ্জের চূড়ান্ত আপিলও বাতিল করে। এর পাঁচ দিন পর অ্যাসাঞ্জ লন্ডনের একুয়েডর দূতাবাসে আশ্রয় নেন এবং রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। অগাস্টে রাজনৈতিক আশ্রয় মঞ্জুর করে একুয়েডর।
এপ্রিল, ২০১৭- যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তার করা যুক্তরাষ্ট্রর জন্য একটি ‘অগ্রাধিকার’।
১৯ মে, ২০১৭- অ্যাসাঞ্জ একুয়েডরের দূতাবাসে থাকায় আর এগোনো সম্ভব না উল্লেখ করে সুইডেনের কৌঁসুলিরা তাদের তদন্ত বন্ধ করে দেন।
নভেম্বর, ২০১৮- যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ তার বিরুদ্ধে গোপনে অভিযোগ গঠন করেছে প্রকাশ পায়।
১১ এপ্রিল, ২০১৯- একুয়েডর অ্যাসাঞ্জের রাজনৈতিক আশ্রয় বাতিল করে। এরপর অ্যাসাঞ্জকে দূতাবাস থেকে বের করে গ্রেপ্তার করা হয়।
১ মে, ২০১৯- জামিনের শর্ত লঙ্ঘন করায় ব্রিটিশ একটি আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ৫০ সপ্তাহের কারাদণ্ড দেয়। এই দণ্ড শেষ হওয়ার প্রত্যর্পণ শুনানির জন্য তাকে কারাগারেই আটকে রাখা হয়।
১৩ মে, ২০১৯- সুইডেনের কৌঁসুলিরা তাদের তদন্ত আবার শুরু করে আর জানায় তারা অ্যাসাঞ্জের প্রত্যর্পণ চাইবে।
১১ জুন, ২০১৯- যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটেনের কাছে অ্যাসাঞ্জের প্রত্যর্পণের দাবি জানায়।
১৯ নভেম্বর, ২০১৯- সুইডেনের কৌঁসুলিরা তাদের তদন্ত বন্ধ করেন। তারা জানান, যেসব তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে তা অভিযোগ গঠনের জন্য যথেষ্ট নয়।
২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০- লন্ডনের একটি আদালতে প্রত্যর্পণ শুনানির প্রথম অংশ শুরু হয়।
৪ জানুয়ারি, ২০২১- একজন ব্রিটিশ বিচারক রায় দেন, অ্যাসাঞ্জকে ফৌজদারি অভিযোগ মোকাবেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হাতে প্রত্যর্পণ করা উচিত হবে না। তিনি বলেন, অ্যাসাঞ্জ মানসিক সমস্যায় ভুগছেন এবং আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকতে পারেন।
১০ ডিসেম্বর, ২০২১ – এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জিতে যায় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাসাঞ্জকে যেভাবে কারাগারে রাখা হবে সেই মার্কিন প্যাকেজের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে আদালত।
১৪ মার্চ, ২০২২- ব্রিটেনের সুপ্রিম কোর্ট যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অ্যাসাঞ্জকে আপিল করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করে।
২৩ মার্চ, ২০২২- অ্যাসাঞ্জ তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী ও তার দুই সন্তানের মা স্টেলা মরিসকে বিয়ে করেন। ব্রিটেনের একটি উচ্চ নিরাপত্তার কারাগারের ভেতরে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়।
১৭ জুন, ২০২২- ব্রিটেন অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রত্যর্পণের আদেশ দেয়। অ্যাসাঞ্জ আপিল করার চেষ্টা করেন।
জুন, ২০২৩- অ্যাসাঞ্জের আপিল করার কোনো আইনি সুযোগ নেই বলে রায় দেন লন্ডন হাই কোর্টের একজন বিচারক।
২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪- অ্যাসাঞ্জ প্রত্যপর্ণ ঠেকোনো চেষ্টা শুরু করেন, যাকে তার সমর্থকর বলেছিলেন ‘শেষ চেষ্টা’।
২৬ মার্চ, ২০২৪ – অ্যাসাঞ্জকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে না, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই নিশ্চয়তা দাবি করে ব্রিটিশ আদালত প্রত্যর্পণ স্থগিত করে।
২০ মে, ২০২৪- ব্রিটিশ হাইকোর্ট অ্যাসাঞ্জকে তার প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে পূর্ণ আপিল করার অনুমতি দেয় এই যুক্তিতে যে, যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিক না হওয়ার কারণে বিদেশি নাগরিক হিসেবে বিচারে সে হয়তো মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনী অনুযায়ী বাক স্বাধীনতার অধিকারের ওপর নির্ভর করতে পারবে না।
২৪ জুন, ২০২৪- যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ ও অ্যাসাঞ্জ একটি চুক্তির কথা প্রকাশ করেন যেখানে একটি ফৌজদারি অপরাধে তিনি দোষ স্বীকার করে নেবেন এবং এ পর্যন্ত যে সময় তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন তাকেই তার সাজা হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
আরও পড়ুন:
উইকিলিকস: যুক্তরাষ্ট্রে দোষ স্বীকারের শর্তে মুক্ত জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ