লাদাখ সংঘর্ষের ৪ বছর পর দুই সরকারপ্রধান নিজেদের মধ্যে বৈঠকে বসলেন রাশিয়ার কাজানে ব্রিকস সম্মেলনের ফাঁকে।
Published : 24 Oct 2024, 08:44 PM
লাদাখ সীমান্তে ভারত ও চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের চারবছর পর দুই দেশের নেতা শেষ পর্যন্ত বৈঠক করলেন।
২০২০ সালে লাদাখে ওই সংঘর্ষের পর থেকেই চীন-ভারত সম্পর্ক একরকম তলানিতে ঠেকেছিল। তারপর এই প্রথম বুধবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নিজেদের মধ্যে বৈঠকে বসলেন রাশিয়ায় কাজানে আয়োজিত ব্রিকস সম্মেলনের ফাঁকে।
দুই পক্ষই লাদাখে সমঝোতা হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার কয়েকদিন পরে এই বৈঠক হল। বুধবার মোদী এবং শি দুইজনই এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং দুই দেশের মধ্যে সংলাপ শুরুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
দুই দেশ এই বোঝাপড়ায় পৌঁছল কি করে?
বিরোধের বিষয়গুলো সমাধানের জন্য ভারত ও চীনের নেতা তাদের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যকার বৈঠক ডেকেছিলেন আগের একটি দিনে।
কয়েক দশকের উত্তেজনায় চীন-ভারত সম্পর্ক প্রভাবিত হয়েছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, ভালভাবে চিহ্নিত না থাকা ৩,৪৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিরোধপূর্ণ সীমান্ত। সীমানা রেখা্ ভালভাবে চিহ্নিত না থাকায় চীন ও ভারতের সেনারা অনেক জায়গাতেই মুখোমুখি হয়ে যায় এবং সময় সময় সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।
ভারত ও চীনের মধ্যে ১৯৬২ সালে সীমানা নিয়ে বিরোধ থেকে যুদ্ধের সূত্রপাত হযয়েছিল। যুদ্ধে চীনের কাছে ভারত পরাজিত হয়। চীন তিব্বত দখল করার পর ভারতের বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ ও আকসাই চীনকে চীনের অন্তর্ভুক্ত এলাকা বলে দাবী করে বেইজিং। এভাবে যে সীমান্ত সমস্যা শুরু হয় তা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের পট প্রস্তুত করে।
২০১৯ সালে ভারত সংবিধানের ৩৭০ আর্টিকেল বিলুপ্ত করে ভারত-শাসিত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিলে চীন এর নিন্দা জানিয়েছিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে। বৃহত্তর কাশ্মীর অঞ্চলের পূর্বাংশে আছে লাদাখ, যার কিছু অংশ দাবি করে আসছে চীন।
২০২০ সালে গালওয়ান উপত্যকায় ভারত-চীন সেনাদের মধ্যকার সংঘাতটাই ছিল কয়েক দশকের মধ্যে দুই পক্ষে সবচেয়ে বাজে সংঘাত। সেই সংঘাতে ২০ জন ভারতীয় সেনা এবং চার চীনা সেনা নিহত হয়েছিল।
ওই বছরের শেষদিকে দুই দেশ বিরোধপূর্ণ সীমান্তের কিছু এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় এবং উত্তেজনা প্রশমনের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু পরিস্থিতি উত্তেজনাকরই রয়ে যায়। ২০২১ সালে উত্তরের সিকিম এবং ২০২২ সালে সীমান্তের তাওয়াং সেক্টরে দুই পক্ষের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল।
সামরিক অচলাবস্থার কারণে ভারত ও চীনের মধ্যকার ব্যবসাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভারত তাদের দেশে চীনের বিনিয়োগ খতিয়ে দেখা বাড়িয়েছে এবং টিকটকসহ চীনের কয়েকটি জনপ্রিয় মোবাইল অ্যাপ নিষিদ্ধ করেছে। চীনে সরাসরি যাত্রীবাহী ফ্লাইটও বন্ধ করেছে ভারত।
নরেন্দ্র মোদী ও শি জিনপিংয়ের মধ্যে বুধবারের বৈঠকটি ২০১৯ সালের অক্টোবরের পর প্রথম বৈঠক। এর আগে ২০২২ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে জি২০ সম্মেলনে দুই নেতা বৈঠক করেন। এর কয়েক মাস পর চীন জানায়, বৈঠকে দুই নেতা
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে একমত হয়েছিলেন।
২০২৩ সালের ব্রিকস সম্মেলনের ফাঁকেও চীন ও ভারতের নেতা অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছিলেন জোহানেসবার্গে। সেই বৈঠকে তারা সীমান্ত থেকে সেনা সরিয়ে নিতে রাজি হয়েছিলেন। একই বছরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-এর সঙ্গে বৈঠক করেন কাজাখস্তানে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলনের ফাঁকে। তারা আলোচনা আরও জোরদার করতেও রাজি হন।
গতমাসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেছেন, সীমান্তে সেনা সরানোর বিষয়টি প্রায় ৭৫ শতাংশ সমাধান করা হয়ে গেছে। এর কয়েকদিন পর দুই পক্ষ থেকেই সিভিল আ্যভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বৈঠক করে এবং সরাসরি যাত্রীবাহী ফ্লাইট আগাম শুরু করা নিয়ে আলোচনা করে।
ব্লুমবার্গসহ কয়েকটি গণমাধ্যম সংগঠন খবর দিয়েছে যে, ভারতের ব্যবসায়ীরা সরকারের ওপর চাপ তৈরি করেছে চীনের ওপর থেকে কড়াকড়ি শিথিলের জন্য। কারণ, এই কড়াকড়ির ফলে ভারতের উৎপাদন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যদিও ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সিতারমণ বলেছেন, চীনের ব্যবসার ওপর থেকে কড়াকড়ি শিথিলের ব্যাপারে ভারত সতর্ক থাকবে।
এ সপ্তাহের শুরুতে কি ঘোষণা এসেছে?
ভারত ও চীনের মধ্যে কূটনৈতিক ও সামরিক পর্যায়ের আলোচনায় একটি বড় ‘অগ্রগতি’ অর্জিত হয় গত সোমবার। এর ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই দুই নেতার মধ্যে বৈঠক হল।
সোমবারের আলোচনায় ‘টহলদারির সীমানা’ নির্ধারণ নিয়ে পূর্ব লাদাখের বিভিন্ন টহলস্থলে চীনের সঙ্গে সমঝোতা হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকর। আলোচনায় স্থির হয়েছিল, দুই দেশের মধ্যেকার প্রকৃত সীমান্তরেখা বা এলএসি-তে ২০২০ সালের সংঘাতের ঘটনার আগে দু’পক্ষ যেভাবে সীমান্তে টহল দিত ঠিক সেই অবস্থাতেই আবার ফিরে যাওয়া হবে।
“এর মধ্য দিয়ে সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টিও (মুখোমুখি অবস্থান থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকায় মোতায়েন সেনাবাহিনীর পিছিয়ে যাওয়া) সম্পন্ন হয়েছে” বলেও জানিয়েছিলেন জয়শঙ্কর।
ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান বলেছেন, দুই দেশ এখন আস্থা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। দুপক্ষের মধ্যে সত্যিকারের অগ্রগতি অর্জিত হয় মাত্র চারদিন আগে দুই দেশের বিতর্কিত সীমান্তে টহলের বিষয়ে চুক্তিতে সম্মত হওয়ার মধ্য দিয়ে।
চুক্তিটির বিষয়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সুনির্দিষ্ট কোনও মন্তব্য করেননি। তবে দুই পক্ষ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে সমাধানে পৌঁছেছে বলে মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে।
মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মূখপাত্র লিন জিয়ান বলেছেন, চীন এই অগ্রগতির প্রশংসা করেছে এবং তারা ভারতের সঙ্গে এই সব বিষয়ে সমঝোতার জন্য কাজ করে যাবে।
আর রাশিয়ার কাজানে বুধবারের বৈঠকে পূর্ব লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি)-য় সংঘাতের অবসান ঘটাতে দ্বিপাক্ষীয় সমঝোতাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং চীনের প্রেডিসেন্ট শি জিনপিং দুইজনই স্বাগত জানিয়েছেন।
বৈঠকের পর মোদী বলেন, ‘‘আমরা বিশ্বাস করি, ভারত-চীন সম্পর্ক কেবল আমাদের জনগণের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’’ সেই সঙ্গে তার মন্তব্য, ‘‘পারস্পরিক বিশ্বাস, শ্রদ্ধা এবং সংবেদনশীলতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পথনির্দেশিকা স্থির করবে।’’
অন্য দিকে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেন, ‘‘চিন এবং ভারত উভয়ই প্রাচীন সভ্যতা, প্রধান উন্নয়নশীল দেশ এবং গ্লোবাল সাউথের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। দু’দেশের উন্নয়নের স্বার্থেই আমাদের মধ্যে মতবিরোধের ক্ষেত্রগুলো সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।’’
এরপর কী?
ভারতের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, মোদী এবং শি ঘোষণা করেছেন যে, তাদের বিশেষ প্রতিনিধিরা সীমান্ত প্রশ্নে একটি সুষ্ঠূ, যৌক্তিক এবং পারস্পরিকভাবে গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করতে বৈঠক করবে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তাদের মন্ত্রীরা এবং অন্যান্য কর্মকর্তারাও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুনর্গঠন এবং স্থিতিশীল করতে কাজ করবেন।
দুই নেতাই ভাল সম্পর্ক বজায় রাখা নিয়ে কথা বলেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, দুই দেশেরই অগ্রাধিকারের বিষয় হওয়া উচিত সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।
ব্রিকস সম্মেলনে অংশ নিয়েছে ৩৬ টি দেশের নেতারা। তারা বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্যের মুদ্রা হিসাবে ডলারের ওপর গ্লোবাল সাউথের নির্ভরশীলতা কমানোর উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। বৈঠকে ছিলেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসও।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদীকে বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই বৈঠক নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করছে। তিনি বলেন, দিল্লি এবং চীনকে অবশ্যই উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে একতা বাড়ানোর পাশাপাশি বহু মেরুকরণ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কে গণতন্ত্র চালুতে অবদান রাখায় দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হবে।
“চীন এবং ভারত উভয়ই প্রাচীন সভ্যতার দেশ, প্রধান উন্নয়নশীল দেশ এবং গ্লোবাল সাউথের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আমাদের দুই দেশই নিজ নিজ আধুনিকায়ন কর্মসূচির একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আছে,” বলেন তিনি।