ইউক্রেইনে রুশ অভিযানের এক বছর গড়িয়েছে, যুদ্ধ চলছে এখনও। এর মধ্যে পাশের ছোট দেশ মলদোভায় বাড়ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা।
পূর্ব ইউরোপে ইউক্রেইনের দক্ষিণপশ্চিম সীমান্ত বরাবর মলদোভার অবস্থান। অভিযোগ উঠেছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দেশটিতে একটি অভ্যুত্থান ঘটানোর পেছনে মদদ দিচ্ছেন, যা দেশটিকে চলমান যুদ্ধে টেনে নিতে পারে।
মলদোভার প্রেসিডেন্ট মায়িয়া সান্দু অভিযোগ করেছেন, সাধারণ নাগরিকের বেশে রাশিয়ার ‘ষড়যন্ত্রী’রা এই রাজনৈতিক উত্তেজনার পরিস্থিতি সৃষ্টিতে মদদ দিচ্ছে। সম্প্রতি ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও একই ধরনের সতর্কবার্তা দিয়েছেন।
একই সময়ে রুশ প্রেসিডেন্ট কিইভের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন যে তারা মলদোভায় রুশ নাগরিকদের উপর হামলার পরিকল্পনা করছে।
স্থল সীমান্ত বেষ্টিত মলদোভার একটি অংশে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি রয়েছে এবং আশঙ্কা বাড়ছে যে ইউক্রেইনের ক্রিমিয়ার মতো ওই অঞ্চলটিকেও রাশিয়ার অংশ করে নেওয়ার একটি প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করার চেষ্টায় আছেন পুতিন।
ইউক্রেইনে রাশিয়ার আগ্রাসনের এক বছর পূর্তিতে গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কিইভ সফরের পর পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে প্রেসিডেন্ট সান্দুর সঙ্গে বৈঠক করেন।
হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, মলদোভায় সফর করতে সেদেশের প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণ গ্রহণের বিষয়ে বাইডেন আগ্রহ না দেখালেও দেশটির সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষায় তিনি তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
মলদোভার সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং রাশিয়ার হুমকি হয়ে ওঠা নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন সিএনএনের রব পাইচেটা।
কী ঘটছে মলদোভায়?
ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে জেলেনস্কি সতর্কবার্তা দেন যে মলদোভায় চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে রাশিয়া- এমন গোয়েন্দা তথ্য তাদের হাতে এসেছে।
দেশে রাজনৈতিক সংকট চলার মধ্যেই সম্প্রতি অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতি ও গ্যাসের দাম বেড়ে চলার প্রেক্ষাপটে মলদোভার প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী ডরিন রেসিয়ান দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকারের ইউরোপীয় ইউনিয়ন মুখী নীতি বজায় রাখেন।
কিন্তু তার দায়িত্বগ্রহণের পর থেকেই রুশপন্থি বিক্ষোভকারীরা রাজধানী চিসিনাউতে অবস্থান নিয়েছে, এবং তাদের সমর্থন দিচ্ছে একটি মস্কোপন্থি রাজনৈতিক দল।
এই উত্তেজনার মধ্যেই মলদোভার প্রেসিডেন্ট সান্দু সরাসরি রাশিয়াকে দোষারোপ করেছেন, মস্কো পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে।
সান্দু বলেন, গত শরতে সরকারের পক্ষ থেকে ‘ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে একটি ধারাবাহিক পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল, বিশেষ করে যাদের সামরিক প্রশিক্ষণ রয়েছে এবং যারা সেদেশে সাধারণ নাগরিকের বেশে অবস্থান করে সহিংস বিক্ষোভে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা ও জিম্মি আটকের পরিকল্পনা করছে।
সান্দু দাবি করেন, ‘কথিত বিরোধীদলে’র কর্মী-সমর্থকের ছদ্মবেশে যারা আছে তারা চিসিনাওতে ‘সহিংসতা সৃষ্টির মাধ্যমে’ জোর করে ক্ষমতা পরিবর্তনের চেষ্টা করছে।
অবশ্য সিএনএনের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষভাবে এসব দাবির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
মলদোভার সাবেক উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বর্তমানে চিসিনাউভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর ইউরোপিয়ান পলিসিস অ্যান্ড রিফর্মসের পরিচালক ইউলিয়ান গ্রোজা সিএনএনকে বলেন, “এটা স্পষ্ট যে রাশিয়ার পক্ষ থেকে এসব হুমকি এবং আমাদেরকে এই যুদ্ধে জড়ানোর আশঙ্কা অনেক বেড়ে গেছে।”
তিনি বলেন, “এই যুদ্ধে ইউক্রেইনের পর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশটি হচ্ছে মলদোভা। আমরা এখনও একটি ছোট দেশ, যার অর্থনীতিও দুর্বল এবং এটা অনেক অনেক বেশি চাপ সৃষ্টি করছে।”
রাশিয়ার পরিকল্পনা কী?
সিএনএন লিখেছে, মস্কো নিজেকে ‘নিষ্পাপ’ দাবি করলেও, মলদোভার প্রতি এর পদক্ষেপ ২০১৪ সালের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন তারা ক্রিমিয়াকে নিজের অংশ করে নিয়েছিল এবং এক বছর আগে ইউক্রেইনে সামরিক অভিযান শুরুর পরিস্থিতিও এভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছিল।
রয়টার্স জানিয়েছে, মঙ্গলবার পুতিন ২০১২ সালে জারি করা একটি ডিক্রি বাতিল করেছে, যেটা মলদোভার স্বাধীনতার স্বীকৃতির অংশ ছিল।
এরপর বৃহস্পতিবার রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ইউক্রেইনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে যে তারা অদূর ভবিষ্যতে মলদোভার বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল ত্রান্সনিসত্রিয়ার রুশপন্থি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটি ‘সশস্ত্র উস্কানি’র প্রস্তুতি নিচ্ছে। এক প্রতিবেদনে এমনটাই জানিয়েছে রুশ রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম তাস।
তবে মন্ত্রণালয়ের এই দাবির পক্ষে বিস্তারিত কোনো তথ্য বা নথি দেওয়া হয়নি এবং মলদোভা এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে।
তবে রুশদের এই দাবি পশ্চিমা নেতাদের সতর্ক করে তুলেছে। ঠিক এক বছর আগে পুতিন এই ধরনেরই অভিযোগ তুলেছিলেন, যেখানে দাবি করা হয়েছিলো ইউক্রেইনের দনবাস অঞ্চলের রুশ ভাষীদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন চালাচ্ছে কিইভ, যে অঞ্চলটি ২০১৪ সালেই রাশিয়ার সামরিক সহায়তায় ইউক্রেইনের সরকারের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। আর ওই দাবি নিয়েই দনবাসের লোকদের আত্মরক্ষার অজুহাতে কিইভ অভিমুখে সামরিক অভিযানে নামে মস্কো।
গ্রোজা বলেন, “এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে, আমরা দেখছি যে রাশিয়া অবিরতভাবে প্রচারণা চালিয়ে মলদোভায় তথ্য প্রবাহের জায়গাগুলোতে বিচ্যুতি সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে।
“যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এসব প্রচারণা চালানোর সরঞ্জামগুলোর ব্যবহার রাশিয়া আগের চেয়ে বহুগুণ বাড়িয়েছে এবং জোরালো করেছে। আমরা এখন যা দেখছি তা হল, এখানে মলদোভায় ছদ্ম পরিচয়ে অবস্থানরত রুশ রাজনৈতিক শক্তির পুনরুত্থান।”
পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাতেউৎস মোরাভিয়েকি গত রোববার যুক্তরাষ্ট্রের সিবিএসকে বলেন, “মলদোভায় আমি রুশ বাহিনীর ও রুশ কর্মীদের অনেক আনাগোনা দেখতে পাচ্ছি। ওটা খুবই দুর্বল একটি দেশ এবং তাদের সাহায্য করা দরকার আমাদের।”
মলদোভায় রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি কেন?
মলদোভা নিয়ে রাশিয়ার আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে ত্রান্সনিসত্রিয়া। দেশের পূর্বাংশের এই অঞ্চলটিতে দীর্ঘ সময় ধরে রুশ সেনাদের একটি ঘাঁটি রয়ে গেছে।
দনিয়েস্তার নদীর পূর্ব তীরে ১ হাজার ৩০০ বর্গমাইলের এই ছিটমহলটিতে স্নায়ু যুদ্ধের শেষ দিকে একটি রুশ সামরিক আউটপোস্ট ছিল। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরপরই ত্রান্সনিসত্রিয়া নিজেকে স্বাধীন ভূখণ্ড ঘোষণা করে, কিন্তু মলদোভার বিরোধিতায় স্বাধীন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হওয়া বা রোমানিয়ার সঙ্গে অঙ্গীভূত হওয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়।
পরের বছর মলদোভা স্বাধীন হওয়ার পর রাশিয়া দ্রুত ‘শান্তি রক্ষী’ পাঠানোর নামে ওই অঞ্চলে রুশপন্থিদের ‘স্বার্থ রক্ষায়’ সেনা মোতায়েন করে। মলদোভার বাহিনীর সঙ্গে তাদের যুদ্ধ বেঁধে যায় এবং ১৯৯২ সালে অমীমাংসিত অবস্থাতেই অস্ত্রবিরতি হয়।
আন্তর্জাতিকভাবে ত্রান্সনিসত্রিয়ার কোনো স্বীকৃতি নেই, এমনকী রাশিয়াও এর স্বাধীনতা স্বীকার করে না। কিন্তু মলদোভার সামরিক বাহিনী ওই বিচ্ছিন্ন অংশ থেকে সরে গেছে। ফলে ওই ভূখণ্ড ও এর প্রায় পাঁচ লাখ বাসিন্দা তখন থেকেই এক অচলাবস্থার মধ্যে আটকা পড়ে আছে। বর্তমানে ওই অংশের উপর মলদোভার কোনোই নিয়ন্ত্রণ নেই।
মলদোভার গুরুত্ব কোথায়?
পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে আটকা পড়ে যাওয়া একটি দেশ মলদোভা। সিএনএন বলছে, এর সরকার ও দেশটির বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চায় এবং গত বছর দেশটি ইইউর সদস্যপদ পাওয়ার প্রার্থিতা অর্জন করেছে। কিন্তু সেদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী একটি অংশও রয়েছে, যাদের মধ্যে বিক্ষোভ দানা বাঁধুক বলে চাইছে রাশিয়া।
গত বছর ইউক্রেইনে অভিযান শুরুর পর বেশ কয়েকটি রুশ ক্ষেপণাস্ত্র মলদোভার আকাশসীমা লঙ্ঘন করলে তা নিয়ে উত্তেজনারও সৃষ্টি হয়। ফেব্রুয়ারির শুরুতেও এমন ঘটনা ঘটেছে।
গত বছর এপ্রিলে ত্রান্সনিসত্রিয়ায় একটি ধারাবাহিক বিস্ফোরণের ঘটনার পর উদ্বেগ দেখা দেয় যে পুতিন হয়ত ওই অঞ্চলকেও তার সামরিক অভিযানের অংশ করে নিতে পারেন।
ওই সময় ইউক্রেইনের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে রুশ সামরিক বাহিনীর দ্রুত অগ্রগতিও এসব আশঙ্কা উসকে দেয়।
মলদোভার কর্মকর্তারা বারবারই পশ্চিমা দেশগুলোকে বলে আসছেন যে তাদের দেশটি হয়ত পুতিনের তালিকায় পরবর্তী লক্ষ্য হতে যাচ্ছে।
গত মাসে মলদোভার নিরাপত্তা বাহিনী সতর্ক করেছে যে ২০২৩ সালে রাশিয়া তাদের দেশের পূর্বাংশে অভিযান চালাতে পারে বলে ‘বড় ঝুঁকি’ রয়েছে। মলদোভা নেটোভুক্ত দেশ না হওয়ায় পুতিনের এজেন্ডায় তাদের থাকার আশঙ্কা আরও বেড়েছে।
ইউক্রেইনের দক্ষিণাঞ্চলকে কেন্দ্র করে রাশিয়া বসন্তে অভিযান পরিচালনা করলে তারা হয়ত আবারও ইউক্রেইনের ওদেসা বন্দর অভিমুখে অগ্রসর হতে পারে, এবং এরপর ত্রান্সনিসত্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি স্থল সেতু সৃষ্টির মাধ্যমে ইউক্রেইনের দক্ষিণাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। আর এমনটি ঘটলে এর মাধ্যমে রুশ সেনারা নেটো অঞ্চলের আরও কাছে চলে যাবে।