এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে আপাতত গাজায় ইসরায়েলি ধ্বংসযজ্ঞ থামার পাশাপাশি হামাসের হাতে জিম্মি ইসরায়েলি এবং ইসরায়েলের হাতে বন্দি ফিলিস্তিনিদের মুক্তির পথও খুলবে।
Published : 16 Jan 2025, 05:20 PM
ফিলিস্তিনি দল হামাস এবং ইসরায়েল একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে গাজায় ৪৬০ দিনের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধের অবসানের আশা জেগেছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, কাতার মিশর ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় বুধবার রাতে দুই পক্ষ সমঝোতায় পৌঁছায়।
কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান বিন জসিম আল থানি বলেছেন, ঐকমত্য অনুযায়ী এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর রোববার থেকে। তবে চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে ইসরায়েল ও হামাসের সঙ্গে আরো কাজ বাকি।
ইসরায়েল বলেছে, আরো কিছু বিষয় চূড়ান্ত হওয়া এখনো বাকি। আর এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য দেশটির মন্ত্রিসভার অনুমোদন লাগবে, বৃহস্পতিবারই সেখানে ভোটাভুটি হতে পারে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ৪৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল।
আল-জাজিরা বলছে, এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে আপাতত গাজায় ইসরায়েলি ধ্বংসযজ্ঞ থামার পাশাপাশি হামাসের হাতে জিম্মি ইসরায়েলি এবং ইসরায়েলের হাতে বন্দি ফিলিস্তিনিদের মুক্তির পথও খুলবে।
এই চুক্তি বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের বাড়িতে ফেরারও সুযোগ দেবে, যদিও ইসরায়েলি বাহিনীর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পর তাদের বেশিরভাগের বাড়ি আর অবশিষ্ট নেই।
প্রথম পর্যায়
যুদ্ধবিরতির প্রাথমিক ধাপটি ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হবে। এর মধ্যে সীমিত পরিসরে বন্দি বিনিময় চলবে, গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের আংশিক প্রত্যাহার করা হবে এবং গাজায় পৌঁছানো হবে মানবিক সাহায্য।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলার সময় আটক নারী, শিশু ও পঞ্চাশোর্ধ বেসামরিক নাগরিকসহ ৩৩ জন ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে। বিনিময়ে, ইসরায়েল এই পর্যায়ে আরও বেশি সংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে, যার মধ্যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিও রয়েছে। মুক্তির সম্ভাব্য তালিকায় প্রায় এক হাজার ফিলিস্তিনি রয়েছেন, যারা সেই ৭ অক্টোবরের পর আটক হয়েছিলেন।
বন্দি বিনিময় চলার মধ্যেই গাজার জনবসতিগুলো থেকে ইসরায়েলি বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়া হবে। তবে গাজা সীমান্তের ৭০০ মিটারের মধ্যেই তারা থাকবে।
তবে গাজা ভূখণ্ডের মাঝ দিয়ে যাওয়ার নেতজারিম করিডোর থেকে এখনই সৈন্য প্রত্যাহার করবে না ইসরায়েল। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে সৈন্য সরানো হতে পারে।
গাজার অবরুদ্ধ উত্তরাঞ্চল থেকে বেসামরিক নাগরিকদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেবে ইসরায়েল। সেই সঙ্গে প্রতিদিন ৬০০ ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দেবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ওই এলাকায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে ইতোমধ্যে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো।
ইসরায়েল আহত ফিলিস্তিনিদের চিকিৎসার জন্য গাজা উপত্যকা ত্যাগ করার অনুমতি দেবে এবং যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায়ের বাস্তবায়ন শুরুর সাত দিন পর মিশরের সঙ্গে রাফাহ ক্রসিং খুলে দেবে।
মিশর ও গাজার সীমান্তবর্তী ফিলাডেলফি করিডোরেও ইসরায়েলি সেনা উপস্থিতি কমানো হবে। আর চুক্তি কার্যকর হওয়ার ৫০তম দিনের মধ্যে সেখান থেকে পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার কর হবে।
প্রথম পর্যায়ের পর কী হবে?
যুদ্ধবিরতি কার্যকরের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে কী কী হবে, সে বিষয়ে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে নীতিগত ঐকমত্য হলেও প্রথম পর্যায়ের ছয় সপ্তাহের মধ্যে বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ওই আলোচনায় প্রথম পর্যায়ের ছয় সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও যুদ্ধবিরতি অব্যাহত থাকবে।
তবে ইসরায়েল বলেছে, প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনামাফিক শেষ হলে এবং হামাসের হাতে জিম্মি ইসরায়েলিরা মুক্ত হয়ে গেলে তারপর যে তারা ফের গাজায় আক্রমণ চালাবে না, সেরকম কোনো লিখিত নিশ্চয়তা তারা দেবে না।
তবে মিশরীয় একটি সূত্র বলেছে, যুদ্ধবিরতির আলোচনায় জড়িত তিন মধ্যস্থতাকারী দেশ - মিশর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্র হামাসকে মৌখিকভাবে নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, আলোচনা অব্যাহত থাকবে এবং তারা এমন একটি চুক্তির জন্য চাপ দেবে, যাতে প্রাথমিক ছয় সপ্তাহের সময়সীমা শেষ হওয়ার আগে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের বাস্তবায়ন নিশ্চিত হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য কী পরিকল্পনা?
হামাস যদি নিশ্চিত হয় যে, যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় পর্যায় শুরুর জন্য সব শর্ত পূরণ করা হয়েছে, তাহলে তাদের হাতে বন্দি বাকি ইসরায়েলিদের তারা মুক্তি দেবে, যাদের বেশিরভাগেই সেনা সদস্য। অন্যদিকে ইসরায়েলও তাদের কারাগারে বন্দি ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দেবে। সেই সঙ্গে ইসরায়েল গাজা থেকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করবে।
অবশ্য যুদ্ধবিরতির এই শর্তগুলো ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভার অনেক অতি-ডানপন্থি সদস্যের ঘোষিত অবস্থানের সাথে সাংঘর্ষিক। এমনকি নেতানিয়াহুর নিজেও অতীতে বহুবার গাজায় সংঘাত দীর্ঘায়িত হওয়ার জন্য হামাসের উপস্থিতিকে দায়ী করেছেন। যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে হলে নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভা তা অনুমোদন করতে হবে।
তৃতীয় পর্যায়
যুদ্ধবিরতির তৃতীয় ধাপে কী হবে, তার বিস্তারিত এখনো অস্পষ্ট।
দ্বিতীয় ধাপের শর্ত পূরণ হলে তৃতীয় ধাপে মৃত বন্দিদের দেহ হস্তান্তর করা হবে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে গাজায় তিন থেকে পাঁচ বছরের একটি পুনর্গঠন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু হবে।
যুদ্ধবিরতি শুরুর পর গাজা কার মাধ্যমে পরিচালিত হবে, তা নিয়ে এখনো কোনো সমঝোতা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র বলছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের একটি ‘পরিবর্তিত কাঠামোর’ হাতে ওই দায়িত্ব দেওয়া উচিত।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন মঙ্গলবার বলেছেন, যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন এবং গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক অংশীদাররা একটি অন্তর্বর্তী প্রশাসনকে আহ্বান জানাতে পারে। অন্য অংশীদাররা, বিশেষ করে আরব রাষ্ট্রগুলো, স্বল্পমেয়াদে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাহিনী পাঠাতে পারে।
এই ধরনের পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য, সৌদি আরবসহ আরব রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন প্রয়োজন। কিন্তু সৌদি আরব বলে আসছে, এ প্রকল্পকে তারা কেবল তখনই সমর্থন দেবে, যদি এর লক্ষ্য হয় স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।