Published : 02 Aug 2022, 04:42 PM
ফাটল ধরেছে প্রায় দুই দশকের অ্যাপল-চীন জুটিতে। মহামারীর লকডাউন আর নাজুক সরবরাহ ব্যবস্থার জেরে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে উভয়ের জন্যই লাভজনক ব্যবসায়িক সম্পর্ক।
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন কেবল অ্যাপল পণ্যের বৃহত্তম উৎপাদক নয়, অ্যাপল পণ্যের একটা বড় অংশ বিক্রিও হয় দেশটির বাজারে।
এমন লাভজনক ব্যবসায়িক সম্পর্কের দৃশ্যপটে দুই পক্ষের সাম্প্রতিক টানাপোড়েনের মূলে চীনের ‘জিরো-কোভিড’ নীতিমালার ভূমিকা রয়েছে বলে জানিয়েছে সিএনএন।
বছরের শুরুতেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শহরে কঠোর লকডাউন আরোপ করেছিল চীন। লকডাউনে বন্ধ ছিল বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারখানা, যার মধ্যে আছে ফক্সকন আর পেগাট্রনও। চীনে অ্যাপলের জন্য হার্ডওয়্যার উৎপাদনে শীর্ষে আছে এই দুটি কোম্পানি।
কারখানাগুলো বন্ধ থাকায় থমকে গিয়েছিল বিশ্বব্যাপী অ্যাপলের পণ্য সরববরাহ ব্যবস্থা।
এপ্রিল মাসে কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের সময় অ্যাপল প্রধান টিম কুক সতর্ক করে দিয়েছিলেন, চীনে সরবরাহ জটিলতার কারণে পরের প্রান্তিকে আর্থিক ক্ষতির আকার হতে পারে আটশ কোটি ডলার।
চীনের ওপর নির্ভরশীলতা অ্যাপলের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ানোর প্রথম ঘটনা নয় এটি। মহামারী শুরু হওয়ার এক বছর আগেই যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধে আইফোনের বিক্রি কমার আশঙ্কা জানিয়েছিল অ্যাপল। চুক্তিভিত্তিক নির্মাতাদের চীনের কারখানাগুলোয় কাজের পরিবেশ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কঠোর সমালোচনার মুখেও পড়েছে অ্যাপল।
কিন্তু পরিস্থিতি যতোই খারাপ হোক না কেন, অ্যাপল অদূর ভবিষ্যতে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক চ্ছিন্ন করতে পারবে না বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।
এ প্রসঙ্গে সাপ্লাই চেইন ফার্ম ‘এলএমএ কনসাল্টিং গ্রুপ’-এর প্রধান নির্বাহী লিসা অ্যান্ডারসনের মত, “প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদকরা যে চীন ছাড়তে চায় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্থ হওয়ার ঝুঁকি তারা আর নিতে পারছে না। আর ক্রেতাদের সেবা দেওয়ার সক্ষমতার ওপর আরও ভালো নিয়ন্ত্রণ চায় তারা। কিন্তু চীনের উৎপাদন সক্ষমতা অন্য কোথাও পাওয়াও সহজ হবে না। ওই পরিবর্তনের জন্য সময় ও বিনিয়োগ দুটোই লাগবে।”
সমকক্ষ পাওয়া কঠিন
অ্যাপলে টিক কুকের উপস্থিতির একটা বড় সময়জুড়ে চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছেন তিনি। কুক ১৯৯৮ সালে অ্যাপলে যোগ দেওয়ার কয়েক বছর পরেই চীনে হার্ডওয়্যার উৎপাদন শুরু করে অ্যাপল। প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) হিসেবে অ্যাপলের বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা নির্মাণেও বড় ভূমিকা রেখেছেন তিনি।
আর প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর কুক চীনের নির্মাণ কারখানা পরিদর্শনে গেছেন একাধিকবার।
প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক থাকলেও প্রতিষ্ঠান হিসেবে অ্যাপল বিকল্প বিবেচনা করে দেখছে বলে উঠে এসেছে সিএনএনের প্রতিবেদনে। বছরের শুরুতেই মার্কিন দৈনিক ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল এক প্রতিবেদনে লিখেছিল, ভিয়েতনাম ও ভারতের মতো দেশগুলোতে উৎপাদন বাড়ানোর কথা ভাবছে অ্যাপল। ওই প্রতিবেদনেও কারণ হিসেবে চীনের কঠোর কোভিড নীতিমালার কথা উল্লেখ করেছিল দৈনিকটি।
এ প্রসঙ্গে অ্যাপলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো উত্তর পায়নি সিএনএন।
কিন্তু দ্বিতীয় প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের সময়ে প্রধান নির্বাহী টিম কুক জোর দিয়েছেন বিশ্ববাজারে দিকেই। “আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থা সত্যিই বৈশ্বিক পর্যায়ের এবং সবখানেই আমাদের পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। আমরা সাপ্লাই চেইন আরও অপটিমাইজ করার চেষ্টা চালিয়ে যাবো। আমরা প্রতিদিন নতুন কিছু শিখছি এবং পরিবর্তন আনছি,” আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে বক্তব্যে বলেছেন কুক।
অন্যদিকে, নিজ দেশে কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে, সরবরাহ ও উৎপাদন ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে চীন। দেশটির সরবরাহ ব্যবস্থার ‘বাস্তুতন্ত্র’ বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশে পুননির্মাণের চেষ্টা করলে সেটি কঠিন কাজ হবে বলে মন্তব্য করেছে সিএনএন।
এ প্রসঙ্গে ২০১৫ সালের এক সাক্ষাৎকারে কুক বলেছিলেন, “আপনি যদি যুক্তরাষ্ট্রের সকল যন্ত্রাংশ এবং ডাই নির্মাতাকে ডেকে আনেন তবে তাদের সম্ভবত এই ঘরেই রাখতে পারবেন। কিন্তু চীনে এর জন্য আপনার কয়েকটা ফুটবল মাঠ লাগবে।”
এ প্রসঙ্গে বাজার বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান আইডিসির ‘ডিভাইস রিচার্স’ বিভাগের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ব্রায়ান মা বলেছেন, ‘চীনের বাইরে পণ্য নির্মাণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চাপ বেড়েছে সাম্প্রতিক সময়ে’। কিন্তু কাজটি সহজ হবে না; নির্মাতাদের চীনের থাকার পেছনে একটা বড় কারণ হাতের নাগালে থাকা কাঁচামালের উৎস।
“আমি নিশ্চিত যে, নির্মাতারা তাদের সকল সুযোগ বিবেচনা করে দেখবেন; বিশেষ করে স্থানীয় উৎপাদনের বেলায় নির্মাতাদের সামনে ঝুলন্ত সরকারি ভর্তুকির কারণে। কিন্তু তার সঙ্গে যদি পুরো সরবরাহ ব্যবস্থা তৎপর না হয়, তবে কাঁচামাল নির্মাণ কারখানায় নেওয়াই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়,” যোগ করেন তিনি।
স্থানীয় বাজারটিও ছোট নয়
যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অ্যাপল পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার চীন। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে আইফোন নির্মাতার জন্য।
চীনের স্থানীয় স্মার্টফোন বাজারে ১৮ শতাংশ আছে অ্যাপলের দখলে। আর অ্যাপল পণ্যের বৈশ্বিক বাজারকে বিবেচনায় নিলে তার এক-চতুর্থাংশই চীনে বলে জানিয়েছেন বাজারবিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ক্যানালিসের সাংহাইভিত্তিক স্মার্টফোনের বাজার বিশ্লেষক অ্যাম্বার লিউ।
ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়ার ‘ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি’ প্রকল্পের পরিচালক গ্যাড অ্যালনের মতে, অল্প কথায় বললে ‘চীনেই বাজারের পরিধি বাড়ানোর সুযোগ’ রয়েছে অ্যাপলের জন্য।
চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রাখার জন্য অ্যাপলের কাছে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। অন্যথায় অ্যাপলকে চীন সরকারের রোষানলে পড়তে হতে পারে বলেও সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে, জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে চীনের ক্রেতাদের জন্য নতুন আইফোন মডেলে ছয়শ ইউয়ান (৮৯ ডলার) করে ছাড় দিয়েছে অ্যাপল। অ্যাপলের জন্য নতুন পণ্যে ছাড় দেওয়ার ঘটনা নেহাতই বিরল।
চীনের স্থানীয় বাজারে আইফোনের চাহিদা কমার কারণেই অ্যাপল এই ছাড় দিচ্ছে– এমন আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ।
ঝুঁকি থাকছেই
চীনের কঠোর কোভিড নীতিমালাই অ্যাপলের জন্য একমাত্র ঝুঁকি নয় বলে জানিয়েছে সিএনএন; আছে ভূরাজনৈতিক কলহের বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কাও।
তাইওয়ান নিয়ে ‘উত্তপ্ত’ বাক্য বিনিময় চলছে বেইজিং এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে। স্বায়ত্তশাসিত দ্বীপটিকে নিজ সীমানার অংশ হিসেবে দাবি করে আসছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান ভ্রমণ নিয়ে নতুন মাত্রা পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের রাজনৈতিক বিবাদ।
অন্যদিকে, অ্যাপলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ফক্সকন, পেগাট্রন আর উইসট্রনের মূল কার্যালয় তাইওয়ানেই অবস্থিত; বিশ্বব্যাপী সেমিকন্ডাক্টর ব্যবসার হাব হিসেবে পরিচিত তাইওয়ান।
তাইওয়ান প্রসঙ্গে ব্যবসায়িক কৌশলগত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘ডেন্টনস গ্লোবাল অ্যাডভাইজর’-এর জ্যেষ্ঠ ভাইস-প্রেসিডেন্ট পল ট্রিওলো বলেন, “কোভিড লকডাউনের কারণে কিছু কোম্পানি উৎপাদন কারখানার অবস্থানে বৈচিত্র আনতে বাধ্য হলেও, ‘জিরো-কোভিড’ নীতিমালায় চীন দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।”
কিন্তু তাইওয়ানে গুরুতর কিছু ঘটলে, সেটি ‘ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হিসেবে চীনের ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে দাঁড়াবে’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
“সামরিক সংঘাতের ফলে তাইওয়ানকেন্দ্রীক সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হলে অ্যাপলের ব্যবসার ওপর তার ব্যাপক প্রভাব পড়বে,” যোগ করেন ট্রিওলো।
তাই, আপাতত অ্যাপলের চীনের সঙ্গে সম্পর্ক চ্ছিন্ন করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
আর গ্যাড অ্যালনের বলছেন, “গত কয়েক বছর ধরেই চীনে খরচ বেড়েছে। গত বছরে যা হয়েছে তাতে দেশটিতে অস্থিরতা আরও বেড়েছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি বিবেচনায় নেওয়ার পরেও এই মুহুর্তে অ্যাপলের প্রয়োজন অনুযায়ী দক্ষ কর্মী এবং বিপুল আকারের উৎপাদনের ক্ষমতা আছে এমন কোনো জায়গা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।”