বৃষ্টিতে বৈদ্যুতিক ‘ভাষায় কথা বলে’ মাশরুম

“তবে, বৃষ্টির পর এই বৈদ্যুতিক বিভব ওঠানামা করতে শুরু করে, এমনকি কখনও কখনও এটি একশ মিলিভোল্ট পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায়।”

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 May 2023, 06:44 AM
Updated : 19 May 2023, 06:44 AM

একটি বনে হরেক রকমের প্রাণীর ডাক শোনা যায়, বিশেষ করে বৃষ্টি এলে। সে সময় বনে মধুর সুরে কিচিরমিচির করে পাখির দল, আওয়াজ করে পোকামকড়ও। আর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ডাকতে থাকে ব্যাঙ।

তবে, বনের সকল কথোপকথনই শ্রবণযোগ্য নয়- আর এতে বনের সকল প্রাণীর ধ্বনিও অন্তর্ভূক্ত নয়।

এমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন জাপানের একদল বিজ্ঞানী। তারা বলছেন, বিশেষ এক ধরনের মাশরুম বা ব্যাঙের ছাতা সম্ভবত বৃষ্টি হলে ভূগর্ভস্থ বৈদ্যুতিক সংকেত ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে।

জাপানের টুহুকো ইউনিভার্সিটির কাওয়াতাবি সায়েন্স সেন্টারের ‘সেকেন্ডারি মিক্সড ফরেস্টে’র (একবার ক্ষতি হওয়ার পর ফের নতুনভাবে তৈরি হওয়া বন যাতে একাধিক ধরনের বৃক্ষ থাকে) মাটিতে থাকা ‘দ্বিবর্ণ চোরা’ হিসেবে পরিচিত ‘লাকারিয়া বাইকালার’ নামের ক্ষুদ্রাকৃতির বাদামী ছত্রাকে এই পরীক্ষা চালান গবেষকরা।

লাকারিয়া বাইকালার হলো ‘এ্যাক্টোমাইকোরহিজাল’ শ্রেণির ছত্রাক, যা ওক ও পাইন’সহ আকারে বিশাল বিভিন্ন গাছের সঙ্গে মিথোজীবীতার সম্পর্ক গড়ে তোলে। আর ছত্রাকের শর্করার বিনিময়ে গাছগুলোর পানি ও পুষ্টি উপাদানের সরবরাহও বেড়ে যায়।

ছত্রাক নিয়ে আগে করা গবেষণা থেকে ইঙ্গিত মিলেছে, লাকারিয়া বাইকালার বড় গাছগুলোকে বিভিন্ন প্রাণী ভক্ষণেও সহায়তা করে। ‘স্প্রিংটেইল’ নামে পরিচিত পোকাদের প্ররোচিত করে বিষ দিয়ে মেরে ফেলে তাদের প্রাণিজ প্রোটিন শুষে নেওয়ার পর যেসব নাইট্রোজেন যৌগ পাওয়া যায়, ছত্রাকগুলো তা নিজেদের পোষক গাছের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়।

কিছু মাইকোরহিজাল ছত্রাক পোষকদেহের কোষে চোষক প্রবেশ করিয়ে পুষ্টি উপাদান টেনে নিতে থাকে। বদলে লাক্কারিয়া বাইকালার এর মতো এ্যাক্টোমাইকোরহিজাল শ্রেণির ছত্রাকেরা এর বদলে বড় গাছের গাছের ভূগর্ভস্থঃ শিকড়ের চারপাশে ‘সেথ’ (খোলসের মতো) তৈরি করে।

আর এই সেথই রয়েছে নতুন আবিষ্কারের কেন্দ্রে।

এই সেথগুলো শিকড়ের মতো তন্তুময় হাইফি দিয়ে তৈরি, যা দিয়ে ছত্রাকেরা সব ধরনের পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে। মাটির নিচে মাইকোরহিজাল ছত্রাকের হাইফি এক সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিশাল এক জালের মতো আকৃতি তৈরি করে, এদেরকে বলে মাইকোরহিজাল নেটওয়ার্ক।

গাছের শিকড়গুলো ভূগর্ভস্থঃ পুরো বনের মাটির নিচে এক ধরনের নেটওয়ার্ক তৈরি করে ‘উড ওয়াইড ওয়েব’ হিসাবে কাজ করে। এগুলোর মাধ্যমে গাছেরা ইন্টারনেটের মতো রাসায়নিক সিগনাল ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে, এমন কিছু মতবাদ প্রচলিত রয়েছে বিজ্ঞানী মহলে।

আর, মাইকোরহিজাল নেটওয়ার্কের অস্তিত্ব বাস্তব হলেও এগুলো বিস্তৃত কাঠের জালের মাত্রা ও এর জটিল অবস্থার জন্য দায়ী কি না, সে সম্পর্কে খুব অল্পই প্রমাণ আছে। অনেক বিজ্ঞানী বলেন, এই ঘটনার অনেক জনপ্রিয় বিবরণই বাড়িয়ে বলা।

আগের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নিজের পরিবেশ বদলে ফেলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এইসব ছত্রাক বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি করে। এইসব সংকেত যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

২০২২ সালের এক গবেষণায় কিছু ছত্রাকে স্নায়বিক সিগনালের মতো বৈদ্যুতিক কার্যক্রমের নজির মিলেছে। একে মানুষের বক্তব্য গঠনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। ওই গবেষণায় ছত্রাকের নেটওয়ার্ক থেকে তৈরি বৈদ্যুতিক কার্যক্রমে ৫০টি ভিন্ন ‘শব্দ’ বা ‘একগুচ্ছ স্পাইক’ শনাক্তের কথা  প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বিজ্ঞানবিষয়ক সাইট ‘সায়েন্স অ্যালার্ট’।

পূর্ববর্তী গবেষণায় আরও দেখা যায়, বিভিন্ন গাছ ভূগর্ভস্থ গোপন বৈদ্যুতিক সংকেত পাঠাতে পারে, সম্ভবত মাইকোরহিজাল ছত্রাকের সাহায্য ছাড়াই।

নতুন এই গবেষণাপত্রের লেখকরা বলছেন, এর আগেও ছত্রাকে বৈদ্যুতিক বিভব থাকা বিভিন্ন ‘স্পাইক’ দেখা গেছে, কখনও কখনও পানি বা অন্যান্য উদ্দীপকের প্রতিক্রিয়া হিসাবেও। তবে সেসব পরীক্ষার বেশিরভাগই সীমিত পরসরে ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম পরিবেশে জন্মানো ছত্রাক নিয়ে করা বলে জানিয়েছে বিজ্ঞানীদলটি।

নতুন এই পরীক্ষায় তারা বনের পায়ে চলা পথের ধারে প্রাকৃতিক পারিবেশে জন্মানো ছয়টি লাকারিয়া বাইকালার ছত্রাকের মাথায় ইলেকট্রোড বসান।

এই মাশরুমগুলো ‘জলচাম ওক (ক্যুয়ারকাস সেরাটা)’ ও ‘লুজ-ফ্লাওয়ার হর্নবিম (কারপিনাস ল্যাক্সিফ্লোরা)’ গাছের কাছাকাছি জায়গায় অবস্থিত ছিল। উভয়ই লাকারিয়া বাইকালারের সম্ভাব্য মিথোজীবি গাছের প্রজাতি।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে ও অক্টোবরের শুরুতে চালানো প্রায় দুই দিনের পরীক্ষায় গবেষণা দলটি মাশরুমের বৈদ্যুতিক বিভব পর্যবেক্ষণ ও এটি ‘মিলিভোল্ট’ এককে পরিমাপ করেন। প্রাথমিকভাবে গবেষণার জায়গা শুষ্ক, রৌদ্রজ্জ্বল ও প্রায় বৃষ্টিহীন ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে সায়েন্স অ্যালার্ট।

পয়লা অক্টোবর এই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। সে সময় এক ঘুর্ণিঝড়ের প্রভাবে ৩২ মিলিমিটার বৃষ্টির এক থেকে দুই ঘণ্টা পর মাশরুমগুলোতে নতুন কার্যক্রমের লক্ষণ দেখা যায়।

“শুরুতে এইসব মাশরুমে তুলনামূলক কম বৈদুতিক বিভব দেখা গেলে আমরা এর কারণ হিসেবে বৃষ্টিপাতের অভাবকে ধরে নিয়েছি।” --বলেন তোহোকু ইউনিভার্সিটির জীবাণু পরিবেশবিদ ইউ ফুকাসাওয়া।

“তবে, বৃষ্টির পর এই বৈদ্যুতিক বিভব ওঠানামা করতে শুরু করে, এমনকি কখনও কখনও এটি একশ মিলিভোল্ট পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায়।”

ফুকাসাওয়া ও তার সহকর্মীদের তথ্য অনুসারে, এই ওঠানামার কারণে বৃষ্টি ও তাপমাত্রা উভয়ই পরিবর্তিত হয়। এ ছাড়া, তাদের বিশ্লেষণ থেকে ইঙ্গিত মেলে, বৃষ্টিপাতের পর মাশরুমের মধ্যেও বৈদ্যুতিক সংকেত প্রবাহের নজির মিলেছে।

আর কাছাকাছি থাকা ছত্রাকগুলোর মধ্যে তুলনামূলক বেশি সংকেত আদান প্রদান হয়েছে বলে উঠে এসেছে গবেষণাপত্রে।

বনের ভূগর্ভস্থঃ বাস্তুতন্ত্রে মানব দৃষ্টির অন্তরালে থাকা ছত্রাক কী ধরনের ভূমিকা পালন করে, এর পূর্ণাঙ্গ জবাব না মিললেও ওই রহস্যে এই গবেষণা নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে সায়েন্স অ্যালার্ট।

এই পরীক্ষার মূল গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে ‘ফাঙ্গাল ইকোলজি’ সাময়িকীতে।