এ মিশনের মহাকাশযানটি যে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক যন্ত্র বহন করছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘ভিজিবল এমিশন লাইন করনাগ্রাফ’ বা ‘ভেল্ক’ নামের যন্ত্রটি।
Published : 28 Nov 2024, 04:03 PM
মহাকাশে ভারতের প্রথম সৌর পর্যবেক্ষণ মিশন ‘আদিত্য এল১’-থেকে ‘এই প্রথম বড় কোনো ফলাফল’ উঠে এসেছে, এমনই দাবি দেশটির বিজ্ঞানীদের।
এ মিশনের মহাকাশযানটি যে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র বহন করছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘ভিজিবল এমিশন লাইন করনাগ্রাফ’ বা ‘ভেল্ক’ নামের যন্ত্রটি। আর ‘করোনাল মাস ইজেকশন (সিএমই)’ নামের ঘটনা কখন শুরু হয়েছিল, এর সহায়তায় বিজ্ঞানীরা তা নির্ভুলভাবে অনুমান করতে পেরেছেন বলে উঠে এসেছে বিবিসি’র প্রতিবেদনে।
‘সিএমই’ অর্থাৎ সূর্যের করোনা স্তর থেকে যেসব বিশাল আগুনের গোলা ছিটকে পড়ে, তা নিয়ে গবেষণা করা ভারতের প্রথম সৌর মিশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।
“আলোর কণা থেকে তৈরি একেকটি সিএমই’র ভর এক লাখ কোটি কিলোগ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে, যা প্রতি সেকেন্ডে তিন হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত গতিতে ছুটতে পারে। এটি যেকোনো দিকে ছুটে যেতে পারে, এমনকি পৃথিবীর দিকেও,” বলছেন ভেল্ক যন্ত্রটি নকশা করা ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’র অধ্যাপক আর রমেশ।
“কল্পনা করুন, বিশাল এক আলোর গোলা পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে। আর নিজের সর্বোচ্চ গতিতে থাকলে এটি মাত্র ১৫ ঘণ্টায় সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব অর্থাৎ ১৫ কোটি কিলোমিটার পাড়ি দিতে সক্ষম।”
ভেল্ক’র প্রধান গবেষক রমেশ সম্প্রতিই মর্যাদাপূর্ণ ‘অ্যাস্ট্রোফিজিকাল জার্নাল লেটারস’-এ সিএমই নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। তিনি বলছেন, ভেল্ক যে করনাল ইজেকশনের ঘটনাটি ধারণ করেছে, সেটি শুরু হয়েছিল ১৬ জুলাই গ্রিনিচ মান সময় দুপুর ১টা আট মিনিটে। আর তা পৃথিবীর দিকেই তাক করা ছিল।
“যাত্রা শুরু করার আধা ঘণ্টার মধ্যেই এটি নিজের দিক বদলে সূর্যের পেছনের দিকে চলে যায়। তবে, দূরত্ব বেশি হওয়ায় পৃথিবীর আবহাওয়ায় এর কোনো প্রভাব পড়েনি।”
কিন্তু সৌর ঝড়, সৌরচ্ছটা ও করনাল মাস ইজেকশনের ঘটনা নিয়মিতই পৃথিবীর আবহাওয়ার ওপর প্রভাব ফেলে। মহাকাশেও এর প্রভাব দেখা যায়, যেখানে প্রায় সাত হাজার আটশটি স্যাটেলাইট বসানো। এর মধ্যে ভারতের আছে ৫০টিরও বেশি।
স্পেস ডটকম বলছে, মানবজীবনে এটি সরাসরি হুমকি না হলেও পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ঘটিয়ে এগুলো গ্রহটিতে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে, এমন ঝুঁকি রয়েছে।
এর প্রভাব থেকেই পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি জায়গাগুলোয় সুন্দর অরোরার দেখা মেলে। আর এর চেয়ে শক্তিশালী করনাল মাস ইজেকশন থেকে এমন অরোরাও দেখা যেতে পারে, যেগুলোর ব্যাপ্তি লন্ডন বা ফ্রান্স পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায়। এ বছরের মে ও অক্টোবর মাসে এমন ঘটনা ঘটেওছে।
তবে, মহাকাশে এর প্রভাব আরও গুরুতর, যেখানে করোনাল মাস ইজেকশনের চার্জযুক্ত কণা স্যাটেলাইটের বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রে গোলযোগ তৈরি করে, এমনকি বৈদ্যুতিক গ্রিড ছিটকে ফেলে, আবহাওয়া ও যোগাযোগের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা বিভিন্ন স্যাটেলাইটের কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
“এখন আমাদের জীবন পুরোপুরি নির্ভর করে যোগাযোগ স্যাটেলাইটের ওপর। আর, এর মানে হচ্ছে, সিএমই থেকে ইন্টারনেট, ফোনের লাইন এমনকি রেডিও যোগাযোগেও গোলযোগ তৈরি হতে পারে,” বলছেন অধ্যাপক রমেশ।
রেকর্ডের পাতায় সবচেয়ে শক্তিশালী সৌরঝড়ের ঘটনাটি ছিল ১৮৫৯ সালের, যা ‘ক্যারিংটন ইভেন্ট’ নামে পরিচিত। এর থেকে নির্গত তীব্র অরোরার আলো তখন গোটা বিশ্বের টেলিগ্রাফ লাইন বিচ্ছিন করে দিয়েছিল।
নাসার বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০১২ সালে একই ধরনের শক্তিশালী ঝড় পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছিল, যার তীব্রতা ছিল ‘ক্যারিংটন ইভেন্টের কাছাকাছি’।
তারা আরও যোগ করেন, এই বছরের ২৩ জুলাই এমনই এক শক্তিশালী করোনাল মাস ইজেকশন পৃথিবীর কক্ষপথ ভেদ করেছিল। তবে, ‘সৌভাগ্যবশত’ এটি আমাদের গ্রহে আঘাত না হেনে মহাকাশে অবস্থান করা নাসার সোলার অবজারভেটরি ‘স্টেরিও-এ’তে আঘাত হেনেছিল।
১৯৮৯ সালে একই ধরনের ঘটনার কারণে কানাডার কুইবেক অঞ্চলের পাওয়ার গ্রিড নয় ঘণ্টার জন্য বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে ৬০ লাখ মানুষ বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েন।
২০১৫ সালের ৪ নভেম্বর এমনই এক ঘটনায় সুইডেন ও ইউরোপের কয়েকটি এয়ারপোর্টের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটে। ফলে, বেশ কয়েক ঘণ্টার জন্য ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যায়।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, করনাল মাস ইজেকশন বা কোনো সৌর ঝড় চলাকালীন সূর্যে কী ঘটে, আমরা তা রিয়েল টাইমে দেখতে পেলে সেটা পাওয়ার গ্রিড ও স্যাটেলাইট বন্ধ করার সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি সম্ভাব্য ক্ষতি থেকেও সুরক্ষা দিতে পারে।
এদিকে, নাসা, ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইএসএ, জাপান ও চীন বেশ কয়েক দশক ধরেই বিভিন্ন সৌর মিশন থেকে সূর্যের গতিবিধি দেখার চেষ্টা করে আসছে। বছরের শুরুতে এই তালিকায় যোগ হয়েছে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো, যারা সূর্যের হিন্দু দেবতা’র নামানুসারে তাদের মহাকাশযানের নাম ‘আদিত্য-এল-১’ রেখেছে।
আদিত্য-এল-১ এখন মহাকাশের যে অবস্থানে আছে, সেখান থেকে নিয়মিতই সূর্য পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ মেলে। এমনকি সূর্যগ্রহণের সময়ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালাতে পারে এটি।
অধ্যাপক রমেশ বলছেন, আমরা যখন পৃথিবী থেকে সূর্যের দিকে তাকাই, তখন আমরা কমলা রঙের একটি আগুনের গোলা দেখতে পাই, তা হল সূর্যের পৃষ্ঠ বা এর সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশ ফটোস্ফিয়ার।
আর কেবল পূর্ণগ্রাস গ্রহণের সময় অর্থাৎ যখন চাঁদ পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে চলে আসে, তখনই এ ফটোস্ফেয়ার পুরোপুরি ঢেকে যায়। ফলে, আমরা সূর্যের সবচেয়ে বাইরের স্তর অর্থাৎ সোলার করোনা দেখার সুযোগ পাই।
অধ্যাপক রমেশের মতে, ভারতের করোনাগ্রাফটি নাসা ও ইএসএ’র যৌথ প্রকল্প ‘সোলার অ্যান্ড হ্যালিওস্ফেরিক অবজারভেটরি’র করোনাগ্রাফের তুলনায় কিছুটা এগিয়ে।