এ বছর ভারতের স্পেস প্রোগ্রামের বাজেট ধরা হয়েছে ১৫৫ কোটি ডলার, যেখানে নাসার এ বছরের বাজেট আড়াই হাজার কোটি ডলার।
Published : 04 Nov 2024, 04:03 PM
সম্প্রতি বেশ কিছু উচ্চাভিলাষী মহাকাশ প্রকল্পের ঘোষণা দিয়েছে ভারত, যেখানে সর্বমোট ২৭০ কোটি ডলার খরচের অনুমোদন মিলেছে।
এইসব পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে ভারতের ঐতিহাসিক চন্দ্র মিশনের পরবর্তী পর্যায়, বুধ গ্রহে একটি অরবিটার পাঠানো, দেশের প্রথম স্পেস স্টেশনের প্রথম পর্যায় নির্মাণ ও স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য নতুন পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট নির্মাণ।
ভারতে মহাকাশ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা সবচেয়ে বড় বাজেট এটি। তবে, অন্যান্য দেশে এমন সব প্রকল্পের পরিসর ও জটিলতার কথা বিবেচনায় নিলে, এগুলো মোটেও বিলাসবহুল নয়।
এমনকি ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো’র চাঁদের, মঙ্গলের ও সৌর মিশনগুলো কীভাবে এত সাশ্রয়ী হয়, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন গোটা বিশ্বের বিশেষজ্ঞরা।
মঙ্গল গ্রহে ‘মঙ্গলযান’ নামের স্যাটেলাইট পাঠাতে ভারতের খরচ পড়েছে সাত কোটি ৪০ লাখ ডলার। আর গত বছরের ঐতিহাসিক ‘চন্দ্রযান ৩’ পাঠাতে খরচ পড়েছে সাড়ে সাত কোটি ডলার, যেখানে সায়েন্স ফিকশন সিনেমা ‘গ্র্যাভিটি’ নির্মাণেই খরচ পড়েছিল ১০ কোটি ডলার।
এদিকে, মঙ্গলে ‘ম্যাভেন’ অরবিটার পাঠাতে নাসার খরচ পড়েছিল ৫৮ কোটি ২০ লাখ ডলার। আর রাশিয়ার ‘লুনা ২৫’, যা চন্দ্রযান ৩ চাঁদে অবতরণের আগেই চাঁদের মাটিতে বিস্ফোরিত হয়েছিল, তার পেছনে খরচ পড়েছে ১৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মিশনে এত কম খরচ হওয়ার পরও মূল্যবান কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে এগোনো ভারত যা করছে, তা দেশটির নিজস্ব সক্ষমতার চেয়েও বেশি।
চাঁদের মাটিতে পানির অস্তিত্ব নিশ্চিত করা প্রথম মহাকাশযান ছিল ‘চন্দ্রযান-১’। এ ছাড়া, মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডলে মিথেনের অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণা করতে নিজের সঙ্গে একটি পেলোড বহন করেছে ‘মঙ্গলযান’। আর চন্দ্রযান-৩’র পাঠানো ছবি ও তথ্য বেশ আগ্রহের সঙ্গেই দেখে আসছেন গোটা বিশ্বের মহাকাশপ্রেমীরা।
ভারতের এত কম খরচ হয় কীভাবে?
ভারতের অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা শিশির কুমার দাস তার কর্মজীবনে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ইসরো’র আর্থিক খাত তদারকি করতেন। তার মতে, এ মিতব্যয়ী হওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছিল ৬০’র দশকে, যখন বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো ভারতীয় সরকারের কাছে একটি মহাকাশ কর্মযজ্ঞ তুলে ধরেছিলেন।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারত স্বাধীনতা পেয়েছে ১৯৪৭ সালে। এর পর থেকেই দেশটির জনগণের খাদ্য চাহিদা পূরণ এমনকি যথেষ্ট পরিমাণ স্কুল ও হাসপাতাল নির্মাণে বেগ পেতে হয়েছে দেশটিকে।
“ইসরো’র প্রতিষ্ঠাতা ও বিজ্ঞানী ভিক্রাম সারাভাইকে সরকারের কাছে বোঝাতে হয়েছে, স্পেস প্রোগ্রাম এমন কোনো বিলাসিতা নয় যে, ভারতের মতো দরিদ্র দেশে েএর জায়গা হবে না। বরং তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, ভারতীয় নাগরিকদের আরও ভালো পরিষেবা দিতে স্যাটেলাইট সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে,” বিবিসি’কে বলেছেন দাস।
কিন্তু ভারতের মহাকাশ প্রোগ্রামের বাজেট সবসময়ই কম ছিল, যেখানে অন্যান্য চাহিদার প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি। ৬০ ও ৭০’র দশকের বিভিন্ন ছবিতে দেখা গেছে, বিজ্ঞানীরা সাইকেল এমনকি গরুর গাড়িতেও রকেট ও স্যাটেলাইট বহন করছেন।
বেশ কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন আন্তঃগ্রহ মিশন সফলভাবে পরিচালনা করার পরও ইসরো’র বাজেট স্বল্পতা আগের মতোই ছিল। এ বছর, ভারতের স্পেস প্রোগ্রামের বাজেট ধরা হয়েছে ১৫৫ কোটি ডলার, যেখানে নাসার এ বছরের বাজেট আড়াই হাজার কোটি ডলার।
দাস বলছেন, ইসরো’র বিভিন্ন মিশন এত সাশ্রয়ী হওয়ার প্রধান কারণগুলোর একটি হল তাদের সকল প্রযুক্তি ও মেশিন ভারতেই উৎপাদিত হয়ে থাকে।
১৯৭৪ সালে দিল্লি নিজেদের প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা পরিচালনা করার পর পশ্চিমা দেশগুলো ভারতে বিভিন্ন প্রযুক্তি রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, যা তাদের স্পেস প্রোগ্রামের জন্য ‘শাপে বর’ ছিল বলে দাবি করেছেন দাস।
“আমাদের বিজ্ঞানীরা একে নিজস্ব প্রযুক্তি বিকাশের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছেন, যেখানে তাদের প্রয়োজনের সব যন্ত্রপাতিই দেশীয়ভাবে উৎপাদিত। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের তুলনায় তাদের বেতন ও মজুরি খরচও কম ছিল।”
বিজ্ঞান লেখক পল্লব বগলা বলছেন, নাসা স্যাটেলাইট নির্মাণের জন্য বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানি থেকে আউটসোর্স করে এমনকি মিশনের জন্য বীমা রাখা হয়, যার ফলে তাদের খরচ বেড়ে যায়। তবে, ইসরো’র বেলায় বিষয়টি এমন নয়।
“এ ছাড়া, নাসার মতো ভারতের এমন কোনো প্রকৌশল মডেল নেই, যা ব্যবহার করে সত্যিকারের উৎক্ষেপণের আগে কোনো মিশন পরীক্ষা করা যায়। আমরা শুধু একক মডেল নিয়ে কাজ করি, যা মিশনের মূল উৎক্ষেপণ। এতে বিস্ফোরণ ঘটার ঝুঁকি থাকলেও আমরা তা নিয়েই থাকি। সেটা সম্ভব হয়েছে এগুলো সরকারি প্রকল্প হওয়ার কারণে।”
ভারতের প্রথম ও দ্বিতীয় চাঁদের মিশন এবং মঙ্গল মিশনের প্রধান মাইলস্বামী আন্নাদুরাই বিবিসিকে বলেছেন, ইসরো খুবই অল্প সংখ্যক কর্মী নিয়োগ দিয়ে থাকে, যার ফলে অন্যান্য মহাকাশ গবেষণা সংস্থার তুলনায় তাদের কম বেতন দিতে হয়। এজন্যই ভারতের বিভিন্ন মহাকাশ প্রকল্প এই প্রতিযোগিতার দৌড়ে এখনও ভালোভাবে টিকে আছে।