ভোক্তা-প্রযুক্তি জগতের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে আত্মবিশ্বাসী, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ও যুগান্তকারী ঘোষণার দেড় দশক পেরোলো সম্প্রতি। ১৫ বছরে পা দিল আইফোন।
Published : 10 Jan 2022, 07:03 PM
“কখনো কখনো এমন সব পণ্য আসে যা বদলে দেয় গোটা দুনিয়া। ১৯৮৪ সালে আমরা এনেছিলাম ম্যাকিনটশ। এটি যে কেবল অ্যাপল কে বদলে দিয়েছিল তা নয়, এটা গোটা কমপিউটিং বিশ্বকে বদলে দিয়েছিল। ২০০১ সালে আমরা এনেছি আইপড। এটা যে কেবল আমাদের গান শোনার অভ্যাস বদলে দিয়েছে তা নয়, এটা গোটা সংগীত দুনিয়াকে বদলে দিয়েছে। আজ আমরা ওই মানের যুগান্তকারী তিনটি পণ্যের উন্মোচন করতে যাচ্ছি।”
২০০৭ সালের ৯ জানুয়ারি স্যান ফ্রান্সিসকোর মসকোন কনভেনশন সেন্টারে এভাবেই নিকট ভাবষ্যতের আইফোনের বর্ণনা দিয়েছিলেন সে সময়ের অ্যাপল প্রধান স্টিভ জবস। মঞ্চে উঠেই তিনি ঘোষণা করেছিলেন- “আজ আমরা সবাই মিলে ইতিহাস তৈরি করবো।”
দেড় দশক পর প্রশ্ন জাগতেই পারে, অ্যাপল প্রধান জবস কি তখন ভেবেছিলেন, দেড় দশকের ব্যবধানে বৈশ্বিক অর্থনীতি আর রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারবে তার হাতের পণ্যটির উদ্ভাবনী প্রযুক্তি?
তবে হ্যাঁ, তিনি আত্মতৃপ্তির সঙ্গেই ঘোষণা করেছিলেন, “এই দিনটির জন্য আমি গত আড়াই বছর ধরে অপেক্ষা করছি।”
তার সেই অপেক্ষা যুক্তিসংগত ছিল।
জবস আইফোন উন্মোচনের আগ পর্যন্ত ‘স্মার্টফোন’ বাজার দাপিয়ে বেড়িয়েছে সে সময়ের রিম-এর তৈরি ব্ল্যাকবেরি ফোন। তবে সর্বসাধারণের হাতের নাগালে ছিল না সেকালের ‘স্মার্টফোন’, বরং বিলাসবহুল পণ্য হিসেবেই গ্রহণযোগ্যতা ছিল বেশি।
বিষয়টি এমন নয় যে, স্মার্টফোন প্রযুক্তিকে ‘বিলাসবহুল’ দামের পণ্যের গণ্ডি ভেঙ্গে সর্বসাধারণের হাতের নাগালে নিয়ে এসেছিল অ্যাপলের আইফোন; দেড় দশক পড়েও বাজারের সবচেয়ে ব্যয়বহুল স্মার্টফোনগুলোর নির্মাতা অ্যাপল। কিন্তু প্রথম আইফোন দিয়ে প্রযুক্তিপণ্যের বাজারে যে ‘সুনামি’ সৃষ্টি করেছিলেন জবস, তার প্রভাবেই পরবর্তীতে বাজারে অভিষেক অ্যান্ড্রয়েড প্ল্যাটফর্মের, সর্বসাধারণের হাতে পৌঁছেছে নামী-বেনামী ব্র্যান্ডের স্মার্টফোন।
বিশ্বের সামনে যে যুগান্তকারী প্রযুক্তি তুলে ধরতে যাচ্ছেন সেটা তার ঘোষণাতেই ছিল পরিষ্কার। “আইফোন একটা বিপ্লবী এবং জাদুকরী পণ্য যা আক্ষরিকভাবেই অন্য যে কোনো মোবাইল ফোনের থেকে পাঁচ বছর এগিয়ে আছে।”
নানা হিসেবেই পৃথিবী পাল্টে দিয়েছে অ্যাপলের আইফোন। প্রথম আইফোন উন্মোচনের ১৫ বছর পূর্তিতে আসুন জেনে নেওয়া যাক স্টিভ জবসের ভাষায় ‘বিপ্লবী’ স্মার্টফোন ও এর নির্মাতাকে নিয়ে নানা অজানা তথ্য।
১. ২০০৭ সালে অ্যাপলের বাজার মূলধন ছিল ১৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। ২০২২ সালের ৩ জানুয়ারিতে তিন লাখ কোটি ডলার বাজারমূল্যের মাইলফলক ছুঁয়েছে অ্যাপল।
২. প্রথম আইফোনে ছিল রূপালি রঙের অ্যালুমিনিয়াম কেসিং। আর আইফোনের সর্বশেষ মডেল আইফোন ১৩’র মূল ফ্রেম অ্যালুমিনিয়ামের হলেও সামনে পেছনে আছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির কাঁচ, কিনতে পাওয়া যায় পাঁচটি রঙে।
৩. প্রথম আইফোনের দাম ছিল ৪৯৯ ডলার, ছিল ৪জিবি স্টোরেজ। আরও ১০০ ডলার খরচ করে স্টোরেজ বাড়িয়ে নেওয়া যেত ৮জিবিতে। আর হালের ২৫৬ জিবি মেমোরির আইফোন ১৩ গ্রো ম্যাক্স বিক্রি হয় ১০৯৯ ডলার দামে। একই স্মার্টফোনের ১ টেরাবাইট মেমোরির সংস্করণটির খরচ ১৫৯৯ ডলার।
৪. প্রথম আইফোন যখন বাজারে আসে, তখন অস্তিত্ব ছিল না ইনস্টাগ্রাম, উবার, টিকটক, টুইচ, স্ন্যাপ, লিফট, ডোরড্যাশ, টিন্ডার, স্ল্যাক, লাইম, পোস্টমেটস, ভেনমো এবং পিন্টারেস্টের।
৫. প্রথম আইফোনে ক্যামেরা ছিল মাত্র একটি, ডিভাইসের পেছনের অংশে ছিল ক্যামেরাটি। আর আইফোন ১৩’র ক্যামেরা সংখ্যা চার। এর মধ্যে তিনটি আছে ডিভাইসের পেছনের দিকে, চতুর্থটি ফ্রন্ট ক্যামেরা।
৬. প্রথম আইফোনে টেক্সট কপি-পেস্ট করার ফিচার ছিল না। ২০০৯ সালে ‘আইফোন ওএস ৩’-এর মাধ্যমে আইফোনে অভিষেক হয় ফিচারটির।
৭. মাত্র ১৫টি অ্যাপ ছিল আইফোনের প্রথম সংস্করণে: ক্যালেন্ডার, ক্যামেরা, ক্লক, কন্ট্যাক্টস, আইপড, ম্যাপস, মেসেজেস, নোটস, ফোন, ফটোস, সাফারি, স্টকস, ভয়েস মেমোস, ওয়েদার এবং সেটিংস।
৮. ১৫ বছরে আইফোনের ৩৩টি মডেল বাজারজাত করেছে অ্যাপল। বর্তমানে বাজারে আছে কেবল আটটি।
৯. ভিডিও রেকর্ড করা যেতো না প্রথম আইফোনে। আর হালের আইফোন ১৩ প্রো-তে ৪কে ভিডিও রেকর্ড করা যায় ৬০এফপিএস হারে।
১০. আনসেইন, ট্যাঞ্জারিন, ডিটোর, হাই ফ্লাইং বার্ড এবং স্নো স্টিম লায়ন-এর মতো সিনেমার শুটিংয়েও ব্যবহৃত হয়েছে আইফোন।
১১. প্রথম আইফোন এমএমএস সমর্থন ছিল না। টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে ফটো, ভিডিও পাঠানোর কোনো ফিচার ছিল না ডিভাইসটিতে। পরবর্তীতে আইফোনে ওই ফিচারগুলো যোগ হয় ‘আইফোন ওএস ৩’-এর মাধ্যমে।
১২. প্রথম আইফোনের স্ক্রিন ছিল ৩.৫ ইঞ্চি। আর হালের আইফোন ১৩ মিনি’র স্ক্রিনের আকার ৫.৪ ইঞ্চি। আইফোন ১৩’র স্ক্রিন ৬.১ ইঞ্চি এবং আইফোন ১৩ প্রো ম্যাক্স-এর স্ক্রিন ৬.৭ ইঞ্চি।
১৩. ‘ফেইসটাইম’-এর অভিষেক হয়েছে ২০২১ সালে। আইমেসেজ এসেছে ২০১১ সালে।
১৪. ৫০০ অ্যাপ নিয়ে ২০০৮ সালের ১০ জুলাই চালু হয়েছিল অ্যাপলের ‘অ্যাপ স্টোর’। বর্তমানে এক কোটি ৮০ লাখ অ্যাপ আছে অ্যাপ স্টোরে।
১৫. প্রথম আইফোন উন্মোচনের ৭৪ দিনের মাথায় ২০০৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ১০ লাখতম আইফোন বিক্রি করে অ্যাপল। ২০১৮ সালে ২১ কোটি ৬৭ লাখ আইফোন বিক্রি করেছে অ্যাপল। গড়ে দেড় দিনে ১০ লাখ আইফোন করে বিক্রি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৮ সালের পর আইফোনের বিক্রি নিয়ে তথ্য প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছে অ্যাপল।