টেসলার বাইরে গিয়ে প্রযুক্তি বিকাশের পদক্ষেপ মাস্ক নিলে তা কোম্পানির সম্ভাব্য অগ্রগতি থামিয়ে দেবে, এতে কোম্পানিটির বাজারমূল্য কমে যাওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে।
Published : 17 Jan 2024, 04:31 PM
ভোটাধিকার না বাড়ালে কোম্পানির বাইরে থেকে এআই ও রোবটিক প্রযুক্তি বিকাশের হুমকি দিয়েছেন টেসলা সিইও ইলন মাস্ক, যা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা।
টেসলাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটিক খাতের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে নেওয়ার লক্ষ্যে কোম্পানির অন্তত ২৫ শতাংশ ভোটে নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে চান মার্কিন এ ধনকুবের।
সোমবার সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ মাস্ক বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে দামী অটোমেকার কোম্পানিতে তিনি যথেষ্ট প্রভাবশালী হলেও সে প্রভাব কোনো সিদ্ধান্ত টিকিয়ে রাখার মতো বড় নয়। আর ইভি উৎপাদন ছাড়াও বিভিন্ন নতুন পণ্য তৈরির বিষয়ে নিজের আগ্রহের কথা প্রকাশ করেছেন মাস্ক।
এ ঘটনার পর টেসলার শেয়ারমূল্য আধা শতাংশ বেড়ে গিয়ে ঠেকেছে ২১৯ দশমিক ৯১ ডলারে।
অনেক দিন ধরেই টেসলার প্রায় স্বয়ংক্রিয় ‘ফুল সেলফ-ড্রাইভিং’ সফটওয়্যার ও এর মানবাকৃতির রোবটের প্রোটোটাইপের পক্ষে বাজি ধরেছেন মাস্ক।
“মাস্কের পোস্ট থেকে ইঙ্গিত মেলে, কোম্পানির সিইও এবং পরিচালক হিসেবে নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে কোম্পানির বেশ কিছু লাভজনক সুযোগ নাকচ করার পাশাপাশি নিজের পছন্দের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন মাস্ক। এমনকি একে নিজের অন্যান্য প্রাইভেট কোম্পানির মতো করেই চালাতে চান তিনি।” --বলেন ‘টুলেন ল স্কুল’-এর অধ্যাপক অ্যান লিপটন।
“এটা এক ধরনের স্বার্থের দ্বন্দ্ব, যেখানে টেসলার প্রতি তার দায়িত্ববোধ লঙ্ঘনের ইঙ্গিত মেলে।”
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, টেসলার বাইরে গিয়ে প্রযুক্তি বিকাশের পদক্ষেপ নিলে তা কোম্পানির সম্ভাব্য অগ্রগতি থামিয়ে দেবে, যেখানে কোম্পানিটির বাজারমূল্য কমে যাওয়ার মতো ঝুঁকিও রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে টেসলা ও মাস্কের মন্তব্য জানতে পারেনি রয়টার্স।
‘কর্পোরেট অপর্চুনিটি ডক্ট্রিন’ নামে পরিচিত এক আইনি নীতি অনুসারে, কোনো কোম্পানির সিইও ও পরিচালকদের কোম্পানি নিজেই করতে পারে এমন যে কোনো ব্যবসার সুযোগ বাইরে থেকে নেওয়া নিষিদ্ধ।
“টেসলার অনুমতি না নিয়েই মাস্ক কোম্পানির বাইরে গিয়ে নতুন প্রযুক্তি বিকাশ করলে তা অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে।” --বলেছেন ‘ইউনিভার্সিটি অফ ডেলাওয়্যার’-এর ‘উইনবার্গ সেন্টার ফর কর্পোরেট গভর্নেন্স’ বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক চার্লস এলসন।
বর্তমানে টেসলার প্রায় ১৩ শতাংশ মালিকানা নিয়ে কোম্পানির সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী মাস্ক। এর পাশাপাশি, বাণিজ্যিক রকেট কোম্পানি স্পেসএক্স, ব্রেইন চিপ কোম্পানি নিউরালিংক, সামাজিক মাধ্যম এক্স, ও চ্যাটজিপিটি’র প্রতিদ্বন্দ্বী এআই প্ল্যাটফর্ম ‘এক্সএআই’-এর মালিকও তিনি।
টুইটার কেনার লক্ষ্যে টেসলায় নিজস্ব মালিকানার বেশ কিছু অংশ বিক্রি করে দিয়েছিলেন মাস্ক, যার ফলে দুই বছর ধরে ইভি নির্মাতা কোম্পানিটিতে তার ভোটাধিকারও কমে এসেছে।
শেয়ারবাজারে নিজের সকল বিকল্প ব্যবহার করলে টেসলায় ২৩ শতাংশ পর্যন্ত মালিকানা বাড়াতে পারেন মাস্ক। তবে, কর পরিশোধের জন্য এর কিছু অংশ বিক্রিও করে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে রয়টার্স।
‘দাবির ধরন’
“টুইটার কেনার জন্য নিজস্ব শেয়ার বিক্রি করে যে লোকসান হয়েছে, সেটাই সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন মাস্ক।” --বলেন বাজার বিশ্লেষক কোম্পানি ‘সিএফআরএ’র গবেষণা বিশ্লেষক গ্যারেট নেলসন।
“আমাদের মতে, ডেলাওয়্যারের আদালতে মাস্কের পূর্ববর্তী ভর্তুকি প্যাকেজ নিয়ে যে মামলা চলছে, তার আগে নতুন দাবির এ নাটক সাজিয়েছেন তিনি।”
২০১৮ সালে দায়িত্ব পালন করা টেসলার পর্ষদের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছেন কোম্পানির শেয়ার মালিক রিচার্ড টর্নেট্টা।
মামলার অভিযোগ, টেসলার সহ-প্রতিষ্ঠাতা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে একটি অবান্তর ভর্তুকি প্যাকেজ নিয়েছিলেন, যেখানে ইভি নির্মাতা কোম্পানিটিতে মাস্কের পুরো সময় কাজ করার দরকারও ছিল না।
আদালতের কাছে এ ভর্তুকি প্যাকেজ প্রত্যাহারের দাবি করেছেন টর্নেট্টা, যা মঞ্জুর করা হলে একই আকারের নতুন ভর্তুকি প্যাকেজের পরিকল্পনায় সম্মতি দেওয়া পর্ষদের পক্ষে জটিল হয়ে উঠতে পারে।
২০২২ সালে নির্বাহী কর্মকর্তাদের বেতন গবেষক কোম্পানি ‘ইকুইলার’-এর অনুমানে উঠে আসে, ২০২১ সালে মাস্কের যে ভর্তুকি প্যাকেজ ছিল, সেটি ২০২১ সালে সর্বোচ্চ বেতনপ্রাপ্ত ২০০ নির্বাহীর বেতনের যোগফলেরও ছয় গুণ বড় ছিল।
সোমবার এক্স-এ মাস্ক বলেছেন, নিজের নতুন ভর্তুকি প্যাকেজ নিয়ে পর্ষদের সঙ্গে কোনো ‘মতপার্থক্য’ নেই। তবে, মামলার রায় না আসা পর্যন্ত সেটি আটকে আছে।
বিশেষজ্ঞদের একটি অংশের অনুমান, মাস্ক নিজের দাবির জন্য বোর্ডের কাছ থেকে খুব সামান্যই বিরোধিতা দেখতে পাবেন। এর থেকে ইঙ্গিত মেলে, টেসলায় মাস্কের গুরুত্ব কতো বেশি ও নিজ ভাই কিম্বলের মতো পর্ষদের বেশ কিছু সদস্যের সঙ্গে তার কতোটা ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।
“অতীতেও মাস্কের এমন খেয়ালী আচরণ সহ্য করতে দেখা গেছে পর্ষদকে। তাই, অন্যান্য প্রযুক্তি কোম্পানির কাছে কাজ দেওয়ার তুলনায় তার চাহিদা পূরণ করাই সহজ হবে।” --বলেন ডিউক ইউনিভার্সিটি’র ‘ফুকুয়া স্কুল অফ বিজনেস’ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শু জিয়াং।
শীর্ষ বিনিয়োগ কোম্পানি জেপি মরগানের বিশ্লেষক রায়ান ব্রিংকম্যান বলেন, মাস্কের এমন মন্তব্যে তার সিইও পদ থেকে অব্যাহতির ঝুঁকি বাড়তে পারে। এমনকি কোম্পানির বিনিয়োগকারী কমে যাওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে।
তিনি আরও যোগ করেন, মাস্কের এমন প্রকাশ্য মন্তব্যে পর্ষদের ওপরও চাপ বাড়ছে।
টেসলা’র পর্যবেক্ষকদের মতে, কোম্পানির এআই ও রোবটিক খাতের কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে না চাইলে মাস্ককে সন্তুষ্ট না রাখা বাদে অন্য কোনো উপায় নেই বললেই চলে।
“মাস্ক যা চান, তা না পেলে তিনি কোম্পানিতে বিনিয়োগ বন্ধ করে দিতে পারেন, যার ফলে কোম্পানি রসাতলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাই মাস্কের দাবি পূরণই কোম্পানির অন্যান্য বিনিয়োগকারীর স্বার্থের জন্য ভালো হবে।” --বলেন মার্কিন বিনিয়োগ কোম্পানি ডিপওয়াটার অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের কার্যনির্বাহী জিন মানস্টার।