‘হাজার গুণ বেশি কার্যকর’ স্বচ্ছ সৌরকোষ উদ্ভাবন

প্রায় অদৃশ্য এই কোষগুলোর গড় স্বচ্ছতার হার ৭৯ শতাংশ, যা ব্যবহার করা যাবে জানলা, গাড়ির সামনের কাঁচ, এমনকি মানুষের ত্বকের উপরেও।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 May 2023, 01:59 PM
Updated : 24 May 2023, 01:59 PM

প্রচলিত সৌরকোষগুলোর অস্বচ্ছ, আকারে মোটা বা বড়। সেইসঙ্গে নষ্ট করে বাড়ি কিংবা প্রতিষ্ঠানের নান্দনিক সৌন্দর্য। কথাটি মিথ্যা নয়। আর একে কারণ হিসাবে দেখিয়ে এই নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের প্রতি একধরনের অনীহা চাপিয়ে দেন অনেকেই। সেই অজুহাতের দিন সম্ভবত ফুরালো।

একদল গবেষক ‘২ডি অ্যাটমিক শিট’ বা দ্বিমাত্রিক আণবিক স্তর প্রযুক্তি ব্যবহার করে অত্যন্ত স্বচ্ছ নতুন একধরনের সৌরকোষ উদ্ভাবন করেছেন। বলা হচ্ছে এটি সৌর বিদ্যুতের ধারণাকেই বদলে দিতে পারে। 

প্রায় অদৃশ্য এই কোষগুলোর গড় স্বচ্ছতার হার ৭৯ শতাংশ, যা ব্যবহার করা যাবে জানলা, গাড়ির সামনের কাঁচ, এমনকি মানুষের ত্বকের উপরেও।

বহুবছর ধরে বিজ্ঞানীরা স্বচ্ছ সৌরকোষ তৈরির উপায় খুঁজে আসছিলেন। উপযুক্ত উপাদান না পাওয়ায় এতদিন পর্যন্ত সুরাহা হচ্ছিলো না সে সমস্যার। ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্ট’ সাময়িকীতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এর বিস্তারিত জানিয়েছে গবেষক দলটি।

স্বচ্ছ পরিবাহী হিসাবে বহুল প্রচলিত ইন্ডিয়াম টিন অক্সাইড (আইটিও) ও টাংস্টেন ডাই-সালফাইডের আস্তরের সংযোগে কিছুটা পরিবর্তন এনেছেন তারা। নতুনভাবে কিছু পাতলা ধাতুর প্রলেপ যোগ করা ইন্ডিয়াম টিন অক্সাইড আর টাংস্টেন সালফাইডের আস্তরের মাঝে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় একস্তর বিশিষ্ট টাংস্টেন অক্সাইডের একটি প্রলেপ যোগ করেছেন।

“সৌরকোষগুলো আলোকশক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করতে আইটিও হাজার গুণ বেশি কর্মক্ষম প্রচলিত ইলেক্ট্রোডের তুলনায়– বলেছেন গবেষকদের একজন, টোশাইকাই কাটো। জাপানের তোহোকু ইউনিভার্সিটির ‘গ্র্যাজুয়েট স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং’য়ের একজন সহযোগী অধ্যাপক তিনি।

এই স্বচ্ছ সৌরকোষের কার্যকারিতা যাচাই করে দেখতে একটি নমুনাকে জানলার কাঁচের পরিবর্তে ব্যবহার করে গবেষক দলটি। পরীক্ষাগারে কৃত্রিম সূর্যালোকের আবহ তৈরি করে, অতিস্বচ্ছ করে বানানো নমুনাটির কার্যকারিতা মেপে দেখেন তারা।

প্রাপ্ত ফলফলে দেখা যায় নমুনাটি প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে ১৩ মিলিওয়াট হারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, যেটি অন্যান্য স্বচ্ছ সৌরকোষের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।

দলটি সেখানে থেমে না থেকে এই কোষটি দিয়ে পূর্ণাঙ্গ সৌর প্যানেল বানানোর জন্য নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। তাতেও চ্যালেঞ্জ এসেছে।

“ডিভাইসের আকার বাড়ালে ভোল্টেজে অনাকাঙ্ক্ষিত পতন রোধ করতে নকশায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আমরা এনেছি।” –যোগ করেন কাটো।

স্বচ্ছ সৌরকোষের সম্ভাব্য প্রয়োগ

স্বচ্চ সৌরকোষ বিদ্যুৎ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। প্রচলিত সৌরকোষগুলো ব্যবহার করতে ছাদ বা বড় খোলা প্রান্তর প্রয়োজন হয়। বিল্ডিংয়ের খাড়া পাশে, যানবাহনসহ অন্যান্য অনেক বস্তুর খোলা উপরিতল যেখানে সূর্যের আলো পড়ে কিন্তু কাজে লাগানো যায় না- এমন অনেক ক্ষেত্রে এই স্বচ্ছ সৌর প্যানেল ব্যবহার করা যাবে।

স্বচ্ছ সৌরকোষের ব্যবহারের সম্ভাবনার ক্ষেত্রটি বিশাল। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, এর ব্যবহারে নতুন ধরনের বিদ্যুৎ স্বয়ংসম্পূর্ণ ভবন তৈরি হতে পারে, যেগুলো নিজেদের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক আলোও ব্যবহার করতে পারবে। এগুলো ব্যবহার করে বাড়ানো যাবে বৈদ্যুতিক যানবাহনের সক্ষমতা আর স্থায়িত্বও।

এ ছাড়াও স্বচ্ছ সৌরকোষ নানারকম নিত্যব্যবহার্য পণ্যেও ব্যবহার করা যাবে। উদাহরণ হিসাবে মোবাইলফোন ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস আলোক উৎস থেকেই চার্জ নেবে। ফলে, চার্জার বা পাওয়ার ব্যাংকের প্রয়োজন ফুরাবে।

স্বচ্ছ সৌরকোষের ব্যবহার পরিবেশের ওপরও প্রভাব রাখবে। নবায়নযোগ্য ও পরিচ্ছন্ন এই শক্তির ব্যবহার গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন ও পরিবেশ দূষণ কমাবে, ইতিবাচক প্রভাব পড়বে জলবায়ু সংকটের বাস্তবতায়।

দীর্ঘ অনুসন্ধান

স্বচ্ছ সৌরকোষ তৈরির যাত্রাটা ছিলো দীর্ঘ এবং সংকটপূর্ণ। যে যাত্রায় বিজ্ঞানীরা অহরহ নিত্যনতুন বাধার সম্মুখীন হয়েছেন।

এর জন্য উপযুক্ত উপাদান খুঁজে বের করাটা ছিলো মূল চ্যালেঞ্জ। এমন একটা উপাদান লাগবে, যা একইসঙ্গে স্বচ্ছ, বিদ্যুৎ সুপরিবাহী এবং আলোকে বিদ্যুতে রূপান্তর করতে পারে উচ্চমাত্রায়। পাশাপাশি হতে হবে টেকসই ও মজবুত।

বিজ্ঞানীরা জৈব অজৈব অনেক ধরনের উপাদান নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে গেছেন। তাদের বেশিরভাগই হয় খুবই অস্বচ্ছ নাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি।

গ্রাফিন এবং টাংস্টেন ডাই-সালফাইডের মতো দ্বিমাত্রিক উপাদানগুলো গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে। এগুলো পাতলা এবং স্বচ্ছ একই সঙ্গে বিদ্যুৎ পরিবহনেও ভালো। কিন্তু এখানে সমস্যা হলো এগুলো তেমন টেকসই না।

এই সৌরকোষগুলোর সম্ভাব্য ব্যবহার অনেক। বিল্ডিংয়ের জানালায় এগুলো ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদানে ব্যবহার করা যেতে পারে, বিশেষ করে সুউচ্চ দালানগুলোর বাইরের আবরণে। এর সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যুতিক গাড়ির কাঁচে, নানা রকম ইলেকট্রনিক যন্ত্রে এমনকি বৈদ্যুতিক মোটরেও এগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। 

প্রায় অদৃশ্য এই সৌরকোষগুলো পোশাক, স্মার্টওয়াচসহ পরিধানযোগ্য বিভিন্নরকম পণ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে। এমনকি পেইসমেকার বা গ্লুকোজ মনিটরের মতো চিকিৎসা যন্ত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে মানুষের ত্বকেও এগুলো স্থাপন করা যেতে পারে– বলা হয়েছে প্রকাশিত প্রবন্ধটিতে।

তবে গবেষকদলটি বলছে, এই সৌরকোষগুলোকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের আগে আরো কিছু সংকট নিরসন করতে হবে।

মূল গবেষণা প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্ট’ সাময়িকীতে।