ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে লোকসান হয়েছে ৪২৮ কোটি টাকা। বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বেচে ক্ষতি হয়েছে ১১৩ কোটি টাকার।
Published : 15 Oct 2023, 08:34 PM
দুই যুগেরও বেশি সময় আগে যাত্রা শুরু করা ঢাকার বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ডেসকো গত জুনে সমাপ্ত অর্থবছরে বিপুল পরিমাণ লোকসান দিয়েছে।
এই অর্থবছরে কোম্পানিটির লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচশ কোটি টাকা। ১৯৯৮ সালে যাত্রা শুরুর পর কখনও এই অভিজ্ঞতা হয়নি কোম্পানিটির।
এই পরিস্থিতির জন্য ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন আর বেশি দরে কিনে কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রিকে দায়ী করেছেন পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাওসার আমীর আলী।
তার তথ্য বলছে, বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বেচে তাদের লোকসান হয়েছে ১১৩ কোটি টাকা। আর টাকার অবমূল্যায়নের কারণে ক্ষতি হয়েছে ৪২৮ কোটি টাকা।
রোববার কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ গত ৩০ জুন সমাপ্ত হিসাব বছরের আর্থিক বিবরণী অনুমোদন করে। বিপুল পরিমাণ লোকসান দিলেও শেয়ার প্রতি এক টাকা হিসাবে ৩৯ কোটি ৭৫ লাখ ৬৯ হাজার ৮০৪ টাকা লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে কোম্পানিটি।
কোম্পানিটির রিজার্ভে থাকা ২ হাজার ২২১ কোটি ১০ লাখ টাকা থেকে এই লভ্যাংশ বিতরণ করা হবে।
লোকসানের সিংহভাগ শেষ তিন মাসে
ঘোষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২২ সালের জুলাই থেকে গত জুন পর্যন্ত কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি লোকসান দিয়েছে ১৩ টাকা ৬১ পয়সা।
৩৯৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির মোট শেয়ার সংখ্যা ৩৯ কোটি ৭৫ লাখ ৬৯ হাজার ৮০৪টি।
এই হিসাবে কোম্পানিটি এই অর্থবছরে লোকসান দিয়েছে ৫৪১ কোটি ৯ লাখ ২৫ হাজার ৩২ টাকা।
এই লোকসানের পুরোটাই হয়েছে গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত নয় মাসে।
এই অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শেয়ার প্রতি ২৯ পয়সা বা সাড়ে ১১ কোটি টাকারও বেশি মুনাফা করে। এরপর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শেয়ার প্রতি ৮ পয়সা হিসাবে ৩ কোটি ১৮ লাখ টাকার মতো লোকসান দেয়।
তারপরেও অর্ধবার্ষিক হিসাবে কোম্পানিটি মুনাফাতেই ছিল।
কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে প্রায় ১৪৫ কোটি ১১ লাখ ৩০ হাজার টাকা লোকসান দেয় কোম্পানিটি।
এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসে লোকসান হয় ৪০৪ কোটি ৩২ লাখ ৮৫ হাজার টাকার মতো।
টাকার অবমূল্যায়নের চাপ
এত লোকসান কেন, এই প্রশ্নে ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাওসার আমীর আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই অর্থবছরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য বাড়িয়েছিল ২৮ শতাংশ। কিন্তু আমরা খুচরায় আমরা বাড়াতে পেরেছি ১৫ শতাংশ। দামের এই পার্থক্য আমাদেরকে লোকসানে নিয়ে গেছে।”
তবে লোকসানের সিংহভাগই হয়েছে টাকার অবমূল্যায়নে।
ডেসকো এমডি বলেন, “বিদেশি সংস্থাগুলো থেকে যেসব ঋণ নেওয়া আছে সেগুলো তো ডলারে পরিশোধ করতে হচ্ছে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ঋণ পরিশোধের খরচও বেড়ে গেছে। আমরা টাকায় আয় করি আর ডলারে ঋণ পরিশোধ করি। এখানেও একটা পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে।
“যখন ঋণ নেওয়া হয়েছিল তখন ডলারের দাম ছিল ৮২ টাকা। এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে এক ডলার সমান ১০৯ থেকে ১১০ টাকায়। কেবল ডলারের বাড়তি দরের জন্য বাড়তি ৪২৮ কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে।“
টাকার অবমূল্যায়ন কেবল ডেসকো না, চাপে ফেলেছে সরকারি সঞ্চালন কোম্পানি পাওয়ারগ্রিডকেও। গত মার্চ পর্যন্ত অর্থবছরের নয় মাসে কোম্পানিটি ৩৩২ কোটি ১৩ লাখ টাকারও বেশি লোকসান দিয়েছে একই কারণে। অর্থবছর শেষে এই লোকসানটা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই হিসাব এখনও প্রকাশ করা হয়নি। ডেসকোর মতো তাদেরও লোকসান শুরু হয় গত বছরের অক্টোবর থেকে।
বিদ্যুৎ বিতরণ পদ্ধতি পরিচালন ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও গুণগত মান পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৬ সালের ৩ নভেম্বর থেকে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি ডেসকোর যাত্রা শুরু। ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বরে ৫০০ কোটি টাকার অনুমোদিত মূলধন নিয়ে মিরপুর অঞ্চলের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা অধিগ্রহণের মাধ্যমে শুরু হয় বাণিজ্যিক কার্যক্রম।
বর্তমানে মিরপুর, পল্লবী, কাফরুল, কল্যাণপুর, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, গুলশান, বনানী, মহাখালী, উত্তরা, উত্তরখান, দক্ষিণখান, বারিধারা, বাড্ডা, টঙ্গী এবং পূর্বাচলসহ ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা এর আওতাভূক্ত।
ডেসকোর সংযোগ এখন ১২ লাখ ৪০ হাজার ১৪০টি।
২০০৬ সালে কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে এর শেয়ারের ৭৫ শতাংশ সরকারের মালিকানায় আছে। বাকি ২৫ শতাংশের মধ্যে ১৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে, ৮.৯৬ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে এবং ০.০৬ শতাংশ আছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে।