সংবাদমাধ্যমে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যানের শেয়ার কারসাজির খবর আসার পর এ নির্দেশনা এল। এর আগে তার ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়।
Published : 22 Aug 2024, 07:52 PM
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ১১ দিনের মাথায় পুঁজিবাজারের এই নিয়ন্ত্রক সংস্থাই অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ও তার সন্তানের বিও হিসাব অবরুদ্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
পাশাপাশি শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগে বারবার আলোচনায় আসা সরকারি কর্মচারি আবুল খায়ের হিরু, বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন-বিএমবিএ এর সদ্য সাবেক সভাপতি ছায়েদুর রহমানসহ ১১ জনের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব অবরুদ্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার থেকে পুঁজিবাজারে থাকা এসব ব্যক্তির বিও হিসাব বন্ধ রাখতে বুধবার রাতে চিঠি দেয় বিএসইসি। দেশের ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) এবং সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডকে (সিডিবিএল) চিঠি দিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘চিঠি দিয়ে ১১ ব্যক্তির বিও হিসাব পরবর্তী নিদের্শনা না দেওয়া পর্যন্ত ফ্রিজ রাখতে বলা হয়েছে।’’
ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনে সরকার পতনের পর সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত ১০ অগাস্ট পদত্যাগ করেন। এরপর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে পুঁজিবাজারে অনিয়ম ও কারসাজিতে তার জড়িত থাকার অভিযোগ নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়। আগেও পুঁজিবাজারে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অনিয়মের মাধ্যমে সুবিধা দিয়ে তার আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার অভিযোগ উঠেছিল।
অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতসহ ২০ অগাস্ট আটজনের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার পরদিনই এসব ব্যক্তি ও আরও তিনজনের বিও অ্যাকাউন্ট জব্দ করার নির্দেশনা এল।
বিও অ্যাকাউন্ট জব্দের তালিকায় রয়েছেন-শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, পিতা রফিকুল ইসলাম; তার সন্তান জুহায়ের সারার ইসলাম, পিতা শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম; বিএমবিএর সদ্য সাবেক সভাপতি ছায়েদুর রহমান, পিতা আব্দুর রশিদ ও তার স্ত্রী ফেরদৌসি বেগম; সরকারি কর্মকর্তা হয়েও শেয়ার কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকায় একাধিকবার জরিমানা দেওয়া আবুল খায়ের হিরু ও তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান; কারসাজির অভিযোগে একাধিকবার নাম আসা জাভেদ এ মতিন, পিতা এম এ আজিজ; সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি সিডব্লিউটির মনিজা চৌধুরী; আবুল কালাম মাতবর ও তার মেয়ে কনিকা আফরোজ ও সন্তান সাজেদ মাতবরের।
এসব বিও হিসাবে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত শেয়ার কেনাবেচা করা যাবে এবং বিওতে জমা থাকা টাকা তোলা যাবে না। তবে জমা হতে পারবে বলে চিঠিতে বলা হয়েছে। অর্থ ও শেয়ারের বিপরীতে পাওয়া ডিভিডেন্ডসহ সব খাত থেকে আসা আয় যোগ করা যাবে।
পুঁজিবাজারে তার ও সন্তানের নামে কোনো বিও হিসাব আছে কি না, তা জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করেও সাড়া মেলেনি অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতের কাছ থেকে।
একইভাবে সাড়া মেলেনি বিএমবিএ সদ্য সাবেক সভাপতি ছায়েদুর রহমানের কাছ থেকেও।
বিএসইসির চিঠি পেয়ে বৃহস্পতিবার তা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে সংস্থাগুলো। সিডিবিএল ও ডিএসই’র একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, চিঠিতে উল্লেখ করা ব্যক্তিদের নামে বিও হিসাব থাকলে তা নিয়ম অনুযায়ী ‘ফ্রিজ’ করা হবে।
পরে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক বা কোনো তদন্ত কমিটি তথ্য চাইলে তা সরবরাহ করবে পুঁজিবাজারের সংস্থাগুলো।
বিএসইসির এক কর্মকর্তা বলেন, চিঠি দেওয়া মানেই সবার নামে বিও হিসাব আছে তা নয়। পরে তদন্তের সময়ে জানা যাবে, কার নামে কতটি বিও হিসাব আছে বা আদৌ ছিল কি না।
কারসাজি চক্রকে দায়সারা জরিমানা
বিএসইসি যাদের নামের বিও হিসাব অবরুদ্ধ করতে নির্দেশনা দিয়েছে, তাদের কারসাজির ঘটনা পুঁজিবাজারে সমালোচিত হয়ে আসছে অনেক দিন ধরেই।
শিবলী রুবাইয়াত পদত্যাগের পরে সংবাদমাধ্যমে খবর আসে সন্তানের নামে ও বেনামে বিও হিসাব খুলে শেয়ার কেনাবেচা করেছেন তিনি।
তিনি চেয়ারমম্যান থাকাকালে তার সন্তান এবং ছায়েদুর রহমান বাদে বিও হিসাব অবরুদ্ধ করা অন্য সবার বিরুদ্ধেই পৃথক অভিযোগে এক বা একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল বিএসইসি ও ডিএসই।
বিএসইসি ও ডিএসই গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে পুঁজিবাজারে আলোচিত এসব ব্যক্তির বিপুল টাকার শেয়ার কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার বিষয়টি।
তবে প্রমাণ হওয়ার পরও তাদের কয়েক কোটি টাকার জরিমানা করে শিবলী রুবাইয়তের নেতৃত্বে থাকা কমিশন। এ নিয়ে সময়ে সময়ে সমালোচনাও হয়।
আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে ২০২০ সালের ১৭ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে নিয়োগ দেয় সরকার। সবশেষ গত এপ্রিলে পুনরায় চার বছরের জন্য তার মেয়াদ বাড়ানো হয়।
আগের চেয়ারম্যানের সময়ে কোভিড-১৯ কারণে পুঁজিবাজারে দেওয়া ‘ফ্লোর প্রাইস’ তুলে নিয়েছিলেন পরিস্থিতি উন্নয়নে দায়িত্বে নেওয়ার ১৩ দিন পর।
পরে বাজার কারসাজিতে জড়িতদের ধরতে নেওয়া একাধিক পদক্ষেপে বিনিয়োগকারীরা সন্তুষ্ট হতে শুরু করলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক ৭ হাজার ছুয়েছিল।
তালিকাভুক্ত বন্ধ কারখানা চালুর উদ্যোগ ও লোকসানি কোম্পানির পর্ষদ ভেঙে নতুন করে সেগুলোকে চালুর মত পদক্ষেপও নেন তিনি। তবে সমালোচনা সইতে হয়েছে বিশাল বহর নিয়ে বিপুল ডলার খরচ করে একাধিক দেশে রোড শো করা নিয়ে।
এত সব উদ্যোগের মধ্যেও পুঁজিবাজারে দরপতনের ধারা থেমে থাকেনি। পরিস্থিতির উন্নতি না হলেও মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন শেয়ার নিয়ে কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারদর কয়েকগুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। এরপরও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় ২০২২ সালে তিনিও পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইস বসান, যা ধীরে ধীরে তোলা হচ্ছে এখনও।
তার দীর্ঘ মেয়াদকালে আবুল খায়ের হিরু, সাকিব আল হাসান, মতিউর রহমানের মত বাজার কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়েও থেমে যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত। বড় অঙ্কের কারসাজির বিপরীতে এদের নামমাত্র জরিমানা করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
ফরচুন শু, জেনেক্স ইনফোসিস, সোনালী পেপার, ডেলটা লাইফ ইনস্যুরেন্স, এনআরবিসি ব্যাংক ও আইপিডিসি ফিন্যান্স এর মত অনেক কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি হলেও তাদের বিরুদ্ধে নামমাত্র ব্যবস্থা নেয় বিএসইসি। কয়েকটির বিরুদ্ধে তদন্ত পর্যন্ত করা হয়নি।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যানসহ আট জনের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ