হাজারতম ম্যাচে মেসির হাজার রঙ

তিনি বাঁ পায়ে চেনা সেই ঝলক দেখান, আবার মেজাজও হারিয়ে বসেন!

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরদোহা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Dec 2022, 04:50 AM
Updated : 4 Dec 2022, 04:50 AM

উপহার দিলেন দারুণ গোল, চকিত চমকে ছড়ালেন মুগ্ধতা, আবার মেজাজও হারালেন লিওনেল মেসি! ক্লাব ও আন্তর্জাতিক ফুটবল মিলিয়ে হাজারতম ম্যাচ খেলতে নেমে সাধারণ, অসাধারণ সব রূপেই যেন ধরা দিলেন ফুটবলের এই মহাতারকা।

আল রাইয়ানের আহমেদ বিন আলি স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শেষ ষোলোয় শনিবার মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা। দাপুটে ফুটবলের পসরা মেলে ধরে, শেষ দিকের নাটকীয়তাকে পাশে ঠেলে ২-১ গোলের জয়ে কাতার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনালে ওঠে লিওনেল স্কালোনির দল।

১৯৮৬ আসরের পর আরেকটি শিরোপা জয়ের দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা পুরণের পথে আলবিসেলেস্তারা পার হলো আরেকটি সিঁড়ি। মেসিও তা পেরুলেন মেসিসুলভ ঝলক দেখিয়ে, যখন আর্জেন্টিনা গোলের জন্য ধুঁকছে!

মেসি ত্রাতা হয়ে এলেন ৩৪তম মিনিটে। ডান দিক দিয়ে ওঠা আক্রমণে আলেহান্দ্রো গোমেস ফাউলের শিকার হলে ফ্রি কিক পায় আর্জেন্টিনা। মেসির শট রক্ষণে প্রতিহত হওয়ার পর ঘুরে-ফিরে ফের যায় তার পায়ে। এবার আর একটুও ভুল করেননি সাতবারের বর্ষসেরা। নিখুঁত শটে সামনে থাকা দুই খেলোয়াড়ের মধ্যে দিয়ে ঠিকানা খুঁজে নেন মেসি। গ্যালারিতে আকাশি নীল-সাদা সমর্থকদের উচ্ছ্বাসে কেঁপে ওঠে চারিধার।

কাতার বিশ্বকাপে এ নিয়ে চার ম্যাচে তিন গোল করলেন মেসি। এ গোলে দুটি চাওয়া পূরণ হলো ২০২১ সালে আর্জেন্টিনাকে কোপা আমেরিকার শিরোপা এনে দেওয়া এই ফরোয়ার্ডের। বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে পেলেন নিজের প্রথম গোল।

রেকর্ডের একটি পাতায় ছাপিয়ে গেলেন কিংবদন্তি দিয়েগো মারাদোনাকেও। বিশ্বকাপে ২১ ম্যাচ খেলে ৮ গোল করেছিলেন ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক মারাদোনা। ২৩ ম্যাচে মেসির গোল হলো ৯টি।

আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপে মেসির চেয়ে বেশি গোল আছে এখন কেবল গাব্রিয়েল বাতিস্তুতার, ১০টি। একটি গোলে ‘গাবিগোল’কে ছোঁয়া এবং দুটিতে তাকে পেছনে ফেলে এ চূড়ায় ওঠার হাতছানি এখন বার্সেলোনার সাবেক এই ফরোয়ার্ডের সামনে।

এর একটু আগে দেখা মেলে অন্য এক মেসির। তিনি শান্ত, বিনয়ী, সহজে মেজাজ হারানোর পাত্র নন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড়ের কনুই মারার চেষ্টায় তাকে চটে যেতেও দেখা যায়।

ম্যাচ জুড়ে অসংখ্যাবারই দেখিয়েছেন পায়ের কারিকুরি। ৬৫তম মিনিটে আচমকা ট্রেডমার্ক দৌড়ে অস্ট্রেলিয়ার তিন মিডফিল্ডারকে পেরিয়ে যান চোখের পলকে, এরপর এক ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ‍হুলিয়ান আলভারেসকে বল বাড়ান নিখুঁতভাবে। কিন্তু ফিরতি বল পেয়েও সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি বলে দুর্দান্ত একটি গোলের গল্প লেখা হলো না।

৭৭তম মিনিটে ক্রেইগ গুডউইনের জোরাল শট এনসো ফের্নান্দেসের মুখে লেগে দিক পাল্টে দূরের পোস্ট দিয়ে জালে জড়ায়। তাতে জমে ওঠে ম্যাচ। শঙ্কার মেঘ যেন জমে ওঠে আর্জেন্টিনার আকাশে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা বিমুঢ় হয়ে যান মেসিও, কিন্তু দিশেহারা হননি মোটেও।

৮৯তম মিনিটে শট নেওয়ার মতো ভালো জায়গায় থাকলেও নিজে শট নেননি। বাঁ দিকে আরও ভালো অবস্থানে থাকা লাউতারে মার্তিনেসকে বল বাড়ান নিশ্চিত গোল পেতে। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে উড়িয়ে মেরে সুবর্ণ সুযোগ ইন্টার মিলান স্ট্রাইকার। হতাশ হন মেসি, কিন্তু তার চোখেমুখে ফোটে না ক্ষোভের ছাপ।

মরিয়া মেসির ছোটাছুটি চলে শেষের বাঁশি বাজার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। দ্বিতীয়ার্ধের যোগ করা সময়ে ৩৫ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডের শট অল্পের জন্য বাইরে যায়। পরের মিনিটে মার্তিনেসের শট গোলরক্ষক ফেরানোর পর বল পেয়ে যান, কিন্তু ভারসাম্য হারিয়ে দরকারি টোকাটা ঠিক মতো দিতে পারেননি। কিন্তু হাল ছাড়েননি, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছুটতে থাকেন অবিরাম, ক্লান্তিহীন।

ম্যাচের একেবারে অন্তিম সময়ে গ্যারাং কৌলের জোরাল শট পড়িমরি করে কোনোমতে ঠেকান গোলরক্ষক মার্তিনেস। ততক্ষণে শেষের বাঁশি বাজার অপেক্ষার সময় নেই, আর্জেন্টিনার ডাগআউটে উদযাপন শুরু হয়ে যায়। বাশির শব্দ বাজতে বাঁধনহারা উল্লাসে মেতে ওঠে আর্জেন্টিনা। আরেকটা ধাপ পেরুনোর ‍উদযাপনে মাতেন মেসিও।

হাজারতম ম্যাচটি তাই মেসির জন্যও হয়ে থাকে অন্যরকম আমেজের। নেতার মতোই দলকে এগিয়ে নেওয়া গোল করার আনন্দ, মারাদোনাকে ছাপিয়ে যাওয়া তৃপ্তি, সুযোগ নষ্টের হতাশায় পোড়া, কিছুটা মেজাজ হারানো-এমন নানান রঙে রঙিন হয়ে ওঠে এই মহাতারকার আরেকটি মাইলফলক ছোঁয়ার ম্যাচ।

এমন ম্যাচে কি আর কেউ সেরা হতে পারেন? হাজারতম ম্যাচের উপলক্ষ হাজার রঙে রাঙিয়ে ম্যাচের সেরাও মেসি!