বিশ্বকাপ অভিষেক ম্যাচে রঙ ছড়িয়ে সেলেসাও সমর্থকদের মন জয় করে নিয়েছেন ২৫ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড।
Published : 25 Nov 2022, 12:49 PM
শেষের বাঁশি বাজতেই বাধঁনহারা উল্লাসে মেতে উঠল ব্রাজিলের ডাগআউট। নেইমার, ভিনিসিউস জুনিয়র সে উদ্দাম উদযাপনের মধ্যমণি নন, সব উচ্ছ্বাস রিশার্লিসনকে ঘিরে। এ তো গেল লুসাইল স্টেডিয়ামের উৎসব। এর বাইরে লুসাইল থেকে আল বিদা, মোশারেইব হয়ে কর্নিশের ফ্যান জোনে সে উচ্ছ্বাসের ঢেউ আছড়ে পড়ল ‘রিশার্সিলন, রিশার্লিসন’ শ্লোগানে। সমর্থকদের কাছ থেকে তো এই ভালোবাসাটুকুই কিন্তু পেতে চেয়েছিলেন তিনি।
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। গত সেপ্টেম্বরে আক্ষেপ ঝরেছিল তার কণ্ঠে। ৯ নম্বর জার্সিতে গোলের পর গোল করেও যখন জয় করতে পারছিলেন না সেলেসাও সমর্থকদের মন, আকুতি জানিয়েছিলেন-আমার উপর একটু বিশ্বাস রাখো। সার্বিয়া ম্যাচের আগ পর্যন্ত সে বিশ্বাসটুকু তারা রেখেছিল কিনা, কে জানে, কিন্তু ম্যাচের পর ঠিকই সমর্থকদের সীমাহীন ভালোবাসায় সিক্ত হলেন এই ফরোয়ার্ড।
আস্থা না রাখা ওই সমর্থকদেরই বা দোষ কি? ব্রাজিলের ‘নাম্বার নাইন’ তো আর যেন-তেন বিষয় নয়। তোস্তাও, দা ফেনোমেনন রোনালদোর মতো শিল্পীর স্মারক এই ৯ নম্বর জার্সি। সেখানে রিশার্লিসনের বিশ্বকাপের আঙিনায় পা রাখা কাতারের আসর দিয়ে। বর্তমান দলে তার চেয়ে বিখ্যাত নেইমার, গাব্রিয়েল জেসুস। এমনকি হালের ভিনিসিউস জুনিয়রও আস্থার দিক থেকে তার চেয়ে ছিল এগিয়ে। কিন্তু ‘পায়রা’ ডাক নামের প্রতিদান দিতে মুখিয়ে ছিলেন রিশার্লিসন।
অদৃশ্য কোনো ইশারায় ম্যাচের চিত্রনাট্যও যেন এগোয় রিশার্লিসনের চাওয়া মেনে! তা না হলে ২০তম মিনিটে কাসেমিরোর শট কেন সরাসরি জমে যাবে গোলরক্ষকের গ্লাভসে, সাত মিনিট পর সহজ সুযোগ হেলায় হারাবেন ভিনিসিউস জুনিয়র কিংবা ৩৬তম মিনিটে দুর্বল শটে গোলরক্ষকের হাতে তুলে দিবেন রাফিনিয়া? প্রথমার্ধের শেষ দিকে ভিনিসিউস একেবারে গোলমুখ থেকে উড়িয়ে মেরে নষ্ট করবেন আরেকটি ভালো সুযোগ?
দ্বিতীয়ার্ধেও কেন ব্রাজিলের পিছু ছাড়তে চাইবে না ব্যর্থতা? ৫৫তম মিনিটে নেইমারের শরীরটা এক মোচড়ে ঘুরিয়ে নেওয়া শটের ঠিকানা হবে বাইরে, পাঁচ মিনিট পর আলেক্স সান্দ্রোর বুলেট গতির শট ফিরে আসবে পোস্ট কাঁপিয়ে? এ সবই যেন হতে থাকে রিশার্লিসনের ৬২তম মিনিটের গোলের জন্য! অথচ, এই গোলে তার অবদান সামান্যই।
বাঁ দিক দিয়ে বল নিয়ে ঢুকলেন দলের প্রাণভোমরা নেইমার, তিনি শট নেওয়ার জায়গা ঠিকঠাক না পাওয়ায় সামনে থাকা ভিনিসিউস দ্রুত পা চালালেন, ভানিয়া মিলিনকোভিচ-সাভিচও দারুণ দক্ষতায় আটকালেন ঝাঁপিয়ে, কিন্তু বল এ দফায় গ্লাভসে নিতে পারেননি সার্বিয়ার গোলরক্ষক। দলকে এগিয়ে নিতে গোলমুখে থাকা রিশার্লিশনকে একটু টোকা দিতে হত, স্রেফ সেই কাজটুকু তিনি করলেন পড়িমরি করে। ব্রাজিল সমর্থকদের মনে অবশেষে বয়ে গেল স্বস্তির সুবাতাসও।
কিন্তু এক গোলে স্বস্তি মিলে, জয়ের নিশ্চয়তা যে সেভাবে মেলে না। এদিকে ব্যবধান দ্বিগুণ করা গোলের দেখা মিলছিল না। এও যেন রিশার্লিসন কেন ‘পায়রা’, তা দেখানোর জন্যই! ৬৬তম মিনিটে তাই ভারসাম্য হারিয়ে পিছলে পড়ে সুযোগ নষ্ট করেন ভিনিসিউস। এরপর আসে মাহেন্দ্রক্ষণ, ৭৩তম মিনিট। সেই ভিনিসিউসের পাস বাঁ পায়ের আলতো টোকায় রিশার্লিসন উপরে তুলে নেন, শরীরটাকে পায়রার ডানায় শূন্যে ভাসিয়ে, প্রায় পুরোপুরি ঘুরিয়ে ডান পায়ের চোখ ধাঁধানো বুলেট গতির ভলি করেন, মুগ্ধতার সব সীমা ছাড়িয়ে বল লুটোপুটি খায় জালে!
রিশার্লিসন নায়ক হবেন, তাই ৭৯তম তাকে তুলে নেওয়ার পর পরই কিছুটা ব্যথা, অস্বস্তি নিয়ে নেইমার মাঠ ছাড়েন গোলের খাতায় নাম না তুলে। একটু পর কাসেমিরোর দূরপাল্লার শট ফিরে আসে ক্রসবারে ঘা খেয়ে। বদলি নামা গাব্রিয়েল জেসুস, রদ্রিগো, ফ্রেদের শট দিশা খুঁজে পায় না। ম্যাচে ব্রাজিলের মোট ২২টি শটের ৮টি পোস্টে থাকলেও শেষ পর্যন্ত জালের দেখা পায় রিশার্লিসনের দুটিই। এবং এই দুই গোলে ব্রাজিলের ‘হেক্সা’ অভিযানের হয় শুভসূচনা।
ব্রাজিলের হয়ে আগের ১৭ গোলের সমর্থকদের মন জয় করতে পারেননি রিশার্লিসন। তাই ওই ভালোবাসা পাওয়ার ওই আর্তি জানিয়েছিলেন। শেষ দুই গোলে সেই ভালাবাসাটুকু তিনি পেলেন। সেই ৯ নম্বর জার্সিতে তিনি এখন ব্রাজিল সমর্থকদের নয়নমণি! তার প্রমাণও মিলল মেট্রো স্টেশনে অল্প বয়সী এক ব্রাজিলিয়ান সমর্থককে ব্রাজিলের জয় ও রিশার্লিসনকে নিয়ে প্রশ্ন করতেই। তরুণটি উত্তর দিল তাড়াহুড়ো করে।
“ভীষণ খুশি (দলের জয়ে)। ব্রাজিলই এবার চ্যাম্পিয়ন। রিশার্লিসন, রিশার্লিসন….”
কথাটা শেষ করারও সময় নেই তার। দলছুট হয়ে যাওয়া ওই তরুণ ভিনদেশে অচেনা মেট্রো স্টেশনে সতীর্থদের খোঁজে দৌড়ে চলে গেলেন ব্রাজিলের পতাকা ওড়াতে ওড়াতে!