বুটের আলতো টোকা লাগতেই বল ভাসল শূন্যে। এরপর শুরু ছন্দময় কিপি-আপি কিংবা জাগলিং। টোকায় বল এই শূন্যে ভাসে, তো পরক্ষণেই নেমে আসে নেইমারের পায়ে। একবার, দুইবার, এমন করে চলতে থাকে অগণিতবার। এক দল শিশুর চোখ ভেসে থাকা বলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উপরে ওঠে-নিচে নামে। চোখে-মুখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে হা-করে তাকিয়ে থাকে তারা। ছোট্ট মনে হয়তো উঁকি দেয়, কীভাবে সম্ভব?
৩০ বছর বয়সী নেইমার নিজেও যেন এক লহমায় ফিরে যান শৈশবের দিনগুলোতে। কাতারের দোহার আল আরাবি স্পোর্টস ক্লাবের গ্রাউন্ড তার কাছে হয়ে ওঠে সাও পাওলোর ক্রুজেসের বাড়ির উঠান কিংবা সান্তোসের চেনা আঙিনা। শৈশবে, কৈশরে যে আঙিনায় এমন করে মুগ্ধতা ছড়াতেন। অবাক দৃষ্টিতে এই শিশুগুলোর মতো তখন তার দিকে তাকিয়ে থাকতেন বাবা-মা।
ফুটবলের প্রতি নেইমারের টান বোঝাতে একবার মা নাদিনে বলেছিলেন, ছেলেবেলা থেকে ফুটবলের স্পর্শ থেকে একটু দূরে থাকতে পারত না নেইমার। দিনভর কখনও বাড়ির উঠানে, সামনের রাস্তার, স্কুলে, সমুদ্রপাড়ে, এমনকি ঘরের মধ্যে ফুটবল নিয়ে মেতে থাকত। রাত নেমে এলেও সে ‘চর্মগোলকটি’ হাতছাড়া করত না এক মুহূর্তের জন্যও। ঘুমাতে যেত ফুটবলকে বাহুডোরে নিয়ে। মা একদিন গুণে দেখলেন, তার ছোট্ট ছেলেটির ঘরে ফুটবলই ৫৪টি!
আল আরাবি মাঠে ব্রাজিল দলের কাতার বিশ্বকাপের প্রস্তুতি দেখতে গিয়ে ছেলেবেলার নেইমারকেও দেখা হয়ে গেল। প্রথম দিনের অনুশীলনে খুব যে আঁটঘাট বেঁধে প্রস্তুতি নিলেন, ঘাম ঝরালেন তিনি, তা নয়। হালকা দৌড়ঝাঁপ, কিছু শুটিং প্র্যাকটিস, বল পায়ে সতীর্থদের বোকা বানালেন, কখনও দুজনের ফাঁক দিয়ে ড্রিবলিং করতে করতে বেরিয়ে গেলেন-এগুলোই।
অনুশীলনে দেখা হলো আমুদে নেইমারকেও। বরাবরই তিনি প্রাণোবন্ত, প্রাণোচ্ছল। হাসি, ঠাট্টা, সতীর্থদের সঙ্গে খুনসূটিতে মেতে থাকতে ভালোবাসেন। প্রস্তুতির ফাঁকে নেইমারকে ধরা দিলেন একই রূপে। কখনও বয়সী দানি আলভেসের সঙ্গে, আবার কখনও ভিনিসিউস জুনিয়রের কাঁধে হাত রেখে কিংবা খোঁচা-টোকা দিয়ে মজা করছেন। শুটিং প্র্যাকটিসে নিজের এবং সতীর্থদের ‘মূল্যহীন’ গোলও উদযাপন করলেন বেশ হৈ-হুল্লোড় করে।
প্রস্তুতির শেষ দিকে এক দল শিশু এলো মাঠে। নানা বর্ণের মানুষের সাথে মানুষের সম্মিলন ঘটাতে বিশ্বকাপের আয়োজক কাতারের এই উদ্যোগ। এর আগে মেসিরা সময় কাটিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে কাজ করা আর্জেন্টাইনদের সাথে, বিশেষ করে যারা শ্রমিক শ্রেণির, সেই পিছিয়ে থাকা মানুষগুলোর সঙ্গে। এদিন নেইমারদের সঙ্গে দেখা করতে এলো শিশুরা।
শিশুদের কাছে পেয়ে নেইমার ফিরে গেলেন ছেলেবেলায়। কখনও কিপি-আপি করে দেখালেন, কখনও তাদের সঙ্গে বল-নেওয়া করে পাসিং ফুটবলের পসরা মেললেন। এমনকি তাদের পায়ের ফাঁক দিয়ে বল বের করে নিয়ে শিশুতোষ হাসিতে ফেঁটে পড়লেন। ফুটবলের ভাষায় যেটিকে বলে ‘নাটমেগ’ এবং এই কাণ্ড পেশাদার ফুটবলে হরহামেশাই করেন তিনি।
প্রস্তুতির এই পর্বে কোনো চাওয়া-পাওয়ার হিসেব নেই। কোনো ভার নেই। কেবল সীমাহীন আনন্দে মেতে থাকা, ভেসে যাওয়ার ক্ষণ। প্রায় আধঘণ্টা ধরে রিশার্লিসন, রদ্রিগোদের মতো তিনিও শিশুদের সঙ্গে মেতে থাকলেন ফুটবল নিয়ে। কখনও আদরে তাদের জড়িয়ে ধরলেন দু-হাত দিয়ে আকঁড়ে, চুলে বিলিও কেটে দিলেন কারো কারো। শিশুদেরকে বিদায় দেওয়ার আগে বল উপহার দিলেন, অটোগ্রাফ, জার্সি দিলেন। আগামী দিনের নেইমার হওয়ার স্বপ্নের বীজও ওই শিশুদের মনে বুনে দিলেন ভিন্ন উপায়ে!
তাই-ই তো। বাচ্চাগুলো যখন উঠে পড়ে লাগল প্রিয় তারকাকে নিজেদের পায়ের কারিকুরি দেখাতে, নেইমারও সাড়া দিলেন শিশুর সরলতায়। তাদের বডি ডজে বোকা বনে যাওয়ার ভান করে হাসিতে ফেটে পড়লেন। ‘প্রতিপক্ষের’ পা থেকে বল কেড়ে নিতে না পারার ‘ব্যর্থতায়’ মন ভার করলেন। পাস আটকাতে না পেরে করলেন অবাক হওয়ার ভঙ্গি। তাদের গোল উদযাপন করলেন প্রাণখোলা হাসিতে, বিপুল হাততালিতে। এভাবে যেন নাম না জানা শিশুগুলোর মনে এই আত্মবিশ্বাসটুকু ঠিকই গেঁথে দিলেন-নেইমারকে ও হারানো যায়, সময়ের সেরাদের একজনকেও ছাপিয়ে যাওয়া যায়।
যেমনটি নেইমার নিজেও চাইতেন ছেলেবেলায়-সবাইকে ছাপিয়ে যেতে, সবার সেরা হতে। পর্তুগেয়েসার যুব দলে খেলার সময়ের তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন দলটির সেসময়কার কোচ রেজিনালদো ফেরেইরা। তিনি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মেলে ধরেছিলেন নেইমারের সেরা হওয়ার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা, সাফল্যের তীব্র ক্ষুধা।
“নেইমার বল খেলতে ভালবাসত, সবসময় সেরা হতে চাইত। রাস্তার (ফুটবলে) সেরা, জেলার সেরা, শহরের সেরা এবং এরপর প্রদেশের সেরা, তারপর দেশের সেরা হতে চাইত। এখন তো সে বিশ্বসেরা।”
“প্রতিটি দিন, সবসময় সে আরও বেশি (সাফল্য পেতে) চাইত। এখন আপনারা ওর মধ্যে ঠিক যে আকাঙ্ক্ষাটা দেখতে পান, সেটা ওর মধ্যে ছিল সেই ছেলেবেলা থেকে।”
কাতারে নেইমারও নোঙর ফেলেছেন সাফল্য ক্ষুধা নিয়ে। ক্লাব ও জাতীয় দল মিলিয়ে প্রায় ৩০টি শিরোপা জেতা হয়ে গেছে, কিন্তু বিশ্বকাপ এখনও অধরা। ব্রাজিলের জার্সিতে উল্লেখ করার মতো সাফল্য বলতে ২০১৩ সালে কনফেডারেশন কাপ জয় আর ২০২১ সালে কোপা আমেরিকায় রানার্সআপ হওয়া। ওদিকে ২০০২ সালের পর থেকে বৈশ্বিক শিরোপার স্বাদ এখনও পাওয়া হয়নি ব্রাজিলের। ষষ্ঠ শিরোপার জন্য ক্ষুধার্ত তারাও।
এত ভার নিয়ে কাতারে এসে রোববার প্রথম অনুশীলনে নেমেছিলেন নেইমার। শুরুটা করলেন সারলেন আয়েশীভাবে। এরপর শিশুদের সঙ্গে ফিরে গেলেন নিজের শৈশবের হারানো দিনগুলিতে। হাসাহাসি করে, আনন্দে মেতে পার করে দিলেন সময়টুকু। এই হাসিই এবার তার বিশ্বকাপের আঙিনায় টেনে নেওয়ার পালা। আগামী ২৪ নভেম্বর সার্বিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিলের গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচ দিয়ে কী? উত্তরটা আপাতত তোলা সময়ের হাতে।