কাতার বিশ্বকাপে সবচেয়ে নিচের র্যাঙ্কিংয়ের দল ঘানা উপহার দিচ্ছে রোমাঞ্চকর সব ম্যাচ।
Published : 29 Nov 2022, 07:47 PM
প্রথমার্ধে ঘানার দুই গোলের লিডের স্বস্তি। দ্বিতীয়ার্ধে মুহূর্তের ঝলকে ১৬৮ সেকেন্ডের ব্যবধানে সমতায় দক্ষিণ কোরিয়া। ওই সময়ে ঘানার খেলোয়াড়দের ঘাবড়ে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল। তবে শান্ত ছিলেন একজন- অধিনায়ক আন্দ্রে আইয়ু। বলটা তিনি হাতে তুলে নিলেন, হাতের ইশারায় সতীর্থদেরও শান্ত থাকার বার্তা দিলেন। দলের আক্রমণভাগের প্রতি তার এতটাই দৃঢ় বিশ্বাস যে তিনি জানতেন, গোল আসবে যেকোনো মুহূর্তে।
আফ্রিকার দেশটি পরে ঠিকই গোল করেছে। রোমাঞ্চকর লড়াইয়ে কোরিয়াকে ৩-২ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় যাওয়ার আশা বাঁচিয়ে রেখেছে ভালোভাবে।
তিন মিনিটে চো চিউইয়ি-সাংয়ের দুটি হেডের গোলে কোরিয়া সমতা ফেরানোর পরও কীভাবে শান্ত ছিলেন তিনি, ব্যাখ্যা করলেন অধিনায়ক আইয়ু।
“আমি যখন জর্ডান (আইয়ু), ইনাকি (উইলিয়ামস), (মোহাম্মেদ) কুদুসকে দেখি, তখন আমার মধ্যে অনুভূতি জাগে যে যেকোনো মুহূর্তে গোল আসতে পারে। এ কারণেই আমি খুব শান্ত এবং আত্মবিশ্বাসী ছিলাম।”
কাতার বিশ্বকাপে প্রতিটি দলের দুটি করে ম্যাচ শেষে ঘানাকে টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বিনোদনদায়ী দল বললে হয়তো ভুল হবে না। আসরে ৩২ দলের মধ্যে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে সবচেয়ে নিচের দল তারা, ৬১ নম্বরে। তবে দলটি জানে, কীভাবে গোল করতে হয়। প্রথম দুই ম্যাচে সেটির প্রমাণও দিয়েছে।
প্রথম ম্যাচে পর্তুগালের সঙ্গে দারুণ লড়াই করেও তাদের হারতে হয় ৩-২ গোলে। পরের ম্যাচে সোমবার দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষেও স্কোরলাইন একই, তবে এবার জয়ী দলের নাম ঘানা।
খেলার পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা অপটার তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে উরুগুয়ের পর ঘানাই প্রথম দল, যারা বিশ্বকাপে টানা দুই ম্যাচে ৩-২ ফল (পক্ষে বা বিপক্ষে) আনতে পারল। সব দল মিলিয়ে বৈশ্বিক আসরে এই কাজটি করে দেখাতে পেরেছে আর কেবল জার্মানি (১৯৯৪ সালে) ও সুইজারল্যান্ড (১৯৩৪)।
আক্রমণভাগে ঘানা কতটা কার্যকর, তার প্রমাণ মেলে পরিসংখ্যানেও। কোরিয়ার বিপক্ষে প্রথমার্ধে গোলের জন্য তিনটি শট নিয়ে দুটি লক্ষ্যে রাখে তারা, আর দুটিই খুঁজে পায় কাঙ্ক্ষিত ঠিকানা- প্রতিপক্ষের জাল। পুরো ম্যাচে তাদের তিনটি প্রচেষ্টা লক্ষ্যে ছিল, সবগুলির পরিণতি গোল।
পুরো ম্যাচে কোরিয়া যেখানে গোলের জন্য শট নেয় ২২টি, সেখানে ঘানা ৮টি, তাতেই বাজিমাত। পর্তুগালের বিপক্ষে লক্ষ্যে তাদের তিন শটের দুটিতে মেলে গোল।
কোরিয়ার বিপক্ষে ঘানার দুই ও তিন নম্বর গোলটি করেন মোহাম্মেদ কুদুস। এমনিতে তিনি এটাকিং মিডফিল্ডার। তবে দলের কাছে তার পরিচয় গোলস্কোরার। জর্ডান আইয়ুর ক্রসে ছয় গজ বক্সের মুখে চমৎকার হেডে নিজের প্রথম গোলটি করেন কুদুস। গোলটি আসে ৩১ পাসের পর, যেখানে সম্পৃক্ত ছিলেন ১০ জন খেলোয়াড়।
নিজের প্রতি ২২ বছর বয়সী কুদুসের আত্মবিশ্বাস কতটা উঁচুতে, তা ফুটে ওঠে টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ‘দা গার্ডিয়ান’কে দেওয়া তার সাক্ষাৎকারে। নেইমারকে টেনে এনে বলেন, “তিনি আমার চেয়ে ভালো নন। তিনি স্রেফ একজন হাই প্রোফাইল খেলোয়াড়, এই আর কী।”
এই মৌসুমে ক্লাব আয়াক্সের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে প্রথম তিন ম্যাচেই জালের দেখা পান কুদুস। দল গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেওয়ার আগে সব মিলিয়ে তিনি গোল করেন চারটি। বিশ্বকাপের আগে ২০২২-২৩ মৌসুমে ক্লাবের হয়ে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২১ ম্যাচে তার গোল ১০টি।
প্রথমবার বিশ্ব মঞ্চে খেলতে এসে দ্বিতীয় ম্যাচে দুই গোল করে দলের জয়ের নায়ক তিনিই। বিশ্বকাপে এক ম্যাচে জোড়া গোল করা ঘানার প্রথম খেলোয়াড়ও তিনি। ঘানাও এই প্রথম এক ম্যাচে করতে পারল তিন গোল।
অবধারিতভাবে ম্যাচ সেরার পুরস্কার ওঠে কুদুসের হাতে। ম্যাচের পর তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন কোচ অটো আডো।
“মাঠের ভেতরে ও বাইরে সে অসাধারণ একটা ছেলে। সে দ্রুতগতির ও বুদ্ধিমান। তাকে আরও রক্ষণাত্মকভাবে কাজ করতে হবে। তবে গ্রেট খেলোয়াড় হওয়ার জন্য সে সঠিক পথেই আছে।”
এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে কোরিয়ার বিপক্ষে ‘আইয়ু ব্রাদার্স’- আন্দ্রে ও জর্ডানের সঙ্গে খেলা কুদুস আক্রমণভাগে সহায়তা করেছেন ইনাকি উইলিয়ামসকে। জয়সূচক গোলটি করতে পারতেন উইলিয়ামস। বাঁ দিক থেকে সতীর্থের পাস ডি-বক্সে ফাঁকায় পেয়েও শট নিতে ব্যর্থ হন আথলেতিক বিলবাওয়ের এই ফরোয়ার্ড। তবে ভুল করেননি কুদুস।
২০১০ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনাল খেলার পথে যতগুলি গোল করেছিল ঘানা, এবার প্রথম দুই ম্যাচেই তারা ছুঁয়ে ফেলেছে সেই সংখ্যা- পাঁচ। দারুণ এই আক্রমণভাগের পাশাপাশি দলটির রক্ষণও প্রশংসা দাবিদার। শেষের দিকে কোরিয়ার একের পর এক আক্রমণ প্রতিহত করার দুর্দান্ত মনোভাব দেখিয়েছে তারা।
দারুণ কয়েকটি সেভ করেছেন গোলরক্ষক লরেন্স আটি-জিগি। দলের প্রথম গোলদাতা, সেন্টার-ব্যাক মোহাম্মেদ সালিসু রক্ষণের কাজটাও করেছেন ঠিকঠাক, ম্যাচে বল ক্লিয়ার করেছেন তিনি ১৫ বার।
উইলিয়ামস তাই কৃতিত্ব দিলেন ডিফেন্ডারদের, “ডিফেন্ডাররা অসাধারণ ছিল। শেষের দিকে প্রতিটি বল খুব দ্রুত ক্লিয়ার করেছে ওরা।” তার সঙ্গে একমত অধিনায়ক আইয়ুও, “এটিই বলে দেয় আমাদের যথেষ্ট টিম স্পিরিট আছে। আমরা অনেক ঐক্যবদ্ধ। এই তিন পয়েন্ট পেতে যেকোনো কিছু করতে আমরা প্রস্তুত ছিলাম এবং আমরা তা করে দেখিয়েছি।”
আট বছর পর এবার বিশ্ব মঞ্চে ফিরেছে ঘানা। ২০১৪ ব্রাজিল আসরে তাদের বিদায় নিতে হয়েছিল গ্রুপ পর্ব থেকে। এবার শেষ ষোলোর যাওয়ার ভালো সুযোগ আছে। গ্রুপের শেষ ম্যাচে উরুগুয়েকে হারাতে পারলেই মিলে যাবে নকআউট পর্বের টিকেট। ড্র করলেও সুযোগ থাকবে, যদি পর্তুগাল হার এড়ায় কোরিয়ার বিপক্ষে।
গ্রুপে তাদের শেষ ম্যাচের আগে ফিরে আসছে ২০১০ বিশ্বকাপের স্মৃতি। ঘানার জন্য দুঃস্মৃতিই বলতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার ওই আসরে শেষ আটে উরুগুয়ের বিপক্ষে নির্ধারিত সময়ে ১-১ সমতার পর অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের একেবারে শেষ মুহূর্তে গোল প্রায় পেয়েই যাচ্ছিল তারা। তখনই লুইস সুয়ারেসের কুখ্যাত সেই হ্যান্ডবল। আদিয়াহর হেড যাচ্ছিল জালে, গোললাইন থেকে গোলরক্ষকের মতো হাত দিয়ে বল ফিরিয়ে দেন উরুগুয়ের স্ট্রাইকার। ঘানা পেনাল্টি পেলেও আসামোয়া জিয়ানের শট লাগে ক্রসবারে।
প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে খেলার খুব কাছে গিয়েও টাইব্রেকারে হেরে সেই স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে ঘানার।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে এখনও পর্যন্ত ঘানা ও উরুগুয়ের দেখা হয়েছে ওই একবার। ১২ বছর পর আবার যখন বিশ্বকাপেই মুখোমুখি তারা, ঘুরে-ফিরে আসছে আগের ম্যাচের প্রসঙ্গ। ঘানার কোচ আডো যদিও কোরিয়া ম্যাচের পরই বলে দিয়েছেন, প্রতিশোধের কোনো ভাবনা তাদের নেই।
এই নিয়ে তৃতীয় বিশ্বকাপ খেলতে আসা ৩২ বছর বয়সী আইয়ুর আশা, কোরিয়া ম্যাচের মতোই উরুগুয়ের বিপক্ষে নিজেদের মেলে ধরতে পারবেন তারা।
“এটি দুর্দান্ত ম্যাচ ছিল, দারুণ অনুভূতি, সবকিছু ভালো হয়েছে। আমি ম্যাচটি উপভোগ করেছি, আমরা সবাই উপভোগ করেছি। আমাদের মনোবল উঁচুতে রাখতে হবে। এই ম্যাচের মতো সবকিছু করার চেষ্টা করতে হবে।”
“এটি কঠিন টুর্নামেন্ট। সবাই দেখতে পাচ্ছে, এখানে অনেক চমক জাগানো ঘটনা ঘটছে। কোনো ম্যাচ নিয়েই ভবিষ্যদ্বাণী করা যাবে না। ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। আমি খুব খুশি। এখন আমরা শেষ ষোলোয় যাওয়ার লড়াইয়ে আছি।”