দারুণ কিছু কীর্তি-অর্জনের সাক্ষী ছিল বিগত বৈশ্বিক আসরগুলোর ফাইনাল।
Published : 16 Dec 2022, 10:19 AM
বলা হয়, রেকর্ড গড়া হয় ভাঙার জন্য। কিন্তু কিছু অর্জন যেমন চিরস্থায়ী জায়গা পেয়ে যায় ইতিহাসের পাতায়, তেমনি কিছু রেকর্ড যেন ভাঙা অসম্ভবের পর্যায়ে চলে যায়। বিশ্বকাপ ফাইনালেও আছে এমন কিছু কীর্তি।
৩২ দলের রোমাঞ্চ-উত্তেজনা, চমক দেখানো সব পারফরম্যান্সের পর পর্দা নামার দুয়ারে কাতার বিশ্বকাপ। কে হবে এবারের আসরের চ্যাম্পিয়ন, জানতে অপেক্ষা স্রেফ দুই দিনের। একপেশে ফাইনাল নাকি হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, গড়া হবে কী নতুন কোনো রেকর্ড নাকি সাদামাটা কোনো ম্যাচ; অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছেন ফুটবলপ্রেমীরা।
আগামী রোববারই মিলবে সব চাওয়া-পাওয়ার হিসাব। ওই দিন আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের ‘হাইভোল্টেজ’ ফাইনাল দিয়ে শেষ হবে বিশ্বকাপের ২২তম আসর। লুসাইল স্টেডিয়ামের সবুজ গালিচায় শিরোপা নির্ধারণী লড়াই শুরু বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায়।
প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের বিপক্ষে অবিশ্বাস্যভাবে হেরে এবারের আসর শুরু করেছিল টুর্নামেন্টের ফেভারিট দলগুলোর একটি আর্জেন্টিনা। এরপর দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে টানা পাঁচ জয়ে তারা এখন বিশ্ব মঞ্চে ৩৬ বছরের শিরোপা খরা কাটানো থেকে এক ধাপ দূরে।
ফাইনাল ওঠার পথচলায় শিরোপাধারী ফ্রান্সেরও জয় পাঁচ ম্যাচে। গ্রুপ পর্বে প্রথম দুই ম্যাচ জিতে পরের ধাপ নিশ্চিত করা দলটি শেষ রাউন্ডে হারে তিউনিসিয়ার কাছে। এতে অবশ্য আত্মবিশ্বাসে কোনো আঁচ লাগেনি ফরাসিদের। দারুণ পারফরম্যান্সে টানা দ্বিতীয় শিরোপা জয়ের অপেক্ষায় তারা।
জমজমাট এই লড়াইয়ের আগে বিগত বিশ্বকাপগুলোর ফাইনাল ম্যাচের কিছু পরিসংখ্যান, রেকর্ড, কীর্তি বিডিনিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
৮৮ সেকেন্ডের গোল
বিশ্বকাপ ফাইনালে সবচেয়ে দ্রুততম গোলের রেকর্ডটি নেদারল্যান্ডসের ইয়োহান নিশকেন্সের। ১৯৭৪ সালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে সফল স্পট-কিকে ৮৮ সেকেন্ডে জালের দেখা পান তিনি।
খেলা শুরুর পর ১৬ পাসে ইয়োহান ক্রুইফের পায়ে বল গেলে তিনি পেনাল্টি আদায় করে নেন। বিশ্বকাপের ফাইনালে যা ছিল প্রথম স্পট-কিক। আর সেটায় লক্ষ্যভেদ করে উল্লাসে মাতেন নিশকেন্স।
ফাইনালে প্রথম পেনাল্টি পেতে ৪৪ বছর লাগলেও দ্বিতীয়টির সিদ্ধান্ত আসে ২৩ মিনিট পরই। পল ব্রিটনারের সফল স্পট-কিকে সমতা ফেরায় জার্মানরা। পরে ৪৩ মিনিটে জার্ড মুলারের গোলে বিশ্বকাপে নিজেদের দ্বিতীয় শিরোপা ঘরে তোলে পশ্চিম জার্মানি।
৬০ বছরে প্রথম
বিশ্বকাপের ফাইনালে কোনো গোল হজম না করার রেকর্ড গড়তে লেগে যায় ৬০ বছর। ১৯৯০ সালে প্রথমবারের মতো এই কীর্তি গড়ে পশ্চিম জার্মানি। ইতালির স্তাদিও অলিম্পিকোর ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ১-০ গোলে জিতে নিজেদের তৃতীয় শিরোপা ঘরে তোলে জার্মানরা।
১৯৩০ সালে উদ্বোধনী আসরে আর্জেন্টিনাকে ৪-২ গোলে হারিয়ে শিরোপা জেতে উরুগুয়ে। পাঁচ যুগ ধরে ২৭ দল ব্যর্থ হয় ফাইনালে জাল অক্ষত রাখতে।
জার্মানির এই অর্জনের পেছনে ছিলেন ২৩ বছর বয়সী বডো ইলিগনার। বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলা সবচেয়ে কম বয়সী গোলরক্ষকের রেকর্ড এখনও তার নামের পাশে।
৪৪ বছরের ধারার অবসান
২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা আসরে স্পেন কেবল নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপই ঘরে তোলেনি, ভেঙেছিল ৪৪ বছর ধরে চলা একটি ধারাও। ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে দ্বিতীয় (অ্যাওয়ে) জার্সি পরে ১-০ গোলে জিতেছিল স্প্যানিশরা।
এর আগে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে দ্বিতীয় জার্সি গায়ে জড়িয়ে ১৯৬৬ সালে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়েছিল ইংল্যান্ড। ওয়েম্বলিতে ৪-২ গোলে জয়ের ম্যাচে ইংলিশরা পরেছিল লাল জার্সি।
এরপর ১৯৮৬ সালের ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে সবুজ রঙের দ্বিতীয় জার্সি পরে হেরেছিল পশ্চিম জার্মানি। চার বছর পর পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষেই শেষের মঞ্চে আর্জেন্টিনা হারে গাঢ় নীল জার্সি গায়ে চাপিয়ে। ২০০৬ সালে সাদা জার্সি পরে ইতালির কাছে হারে ফ্রান্স।
হাঙ্গেরির ৩০ ম্যাচ অপরাজিত পথচলার সমাপ্তি ফাইনালে
অবিশ্বাস্য ফর্ম নিয়ে ১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপে পা রেখেছিল হাঙ্গেরি। বিশ্ব সেরার মঞ্চেও দাপটের সঙ্গে এগিয়ে যায় তারা। ফাইনাল খেলতে নামে তখনকার রেকর্ড টানা ৩০ ম্যাচ অপরাজিত থেকে।
কিন্তু বিশ্বকে চমকে দিয়ে তাদের এই রথ শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে থামিয়ে দেয় পশ্চিম জার্মানি। ৩-২ গোলের জয়ে নিজেদের প্রথম বৈশ্বিক আসরের শিরোপার স্বাদ পায় তারা।
৬৮ বছর আগের ওই আসরে গ্রুপ পর্বে পশ্চিম জার্মানিকে ৮-৩ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল হাঙ্গেরি। ফাইনালেও প্রত্যাশিতভাবে শুরুতে তারা এগিয়ে যায় ২-০ গোলে। কিন্তু চমক দিয়ে শেষ পর্যন্ত ৩-২ গোলের জয় তুলে নেয় পশ্চিম জার্মানি। বিশ্বকাপের ইতিহাসে ফাইনালে দুই গোলে পিছিয়ে থাকার পর ঘুরে দাঁড়িয়ে জেতার ঘটনা ওই একটিই।
হাঙ্গেরির ৩০ ম্যাচ অপরাজিত থাকার ওই রেকর্ড ৪০ বছর পরে ভাঙে দিয়েগো সিমেওনে, ফের্নান্দো রেদোন্দো ও গাব্রিয়েল বাতিস্তুতারাদের আর্জেন্টিনা।
বয়সের সর্বোচ্চ পার্থক্য ২২
বিশ্বকাপের ফাইনালে বিজয়ী দলের শুরুর একাদশে থাকা সবচেয়ে কম ও বেশি বয়সী খেলোয়াড়ের মধ্যে সর্বোচ্চ পার্থক্য ২২ বছর। ১৯৮২ আসরে ইতালির হয়ে ১৮ বছর বয়সী জুজেপ্পে বেরগোমি ও ৪০ বছর বয়সী দিনো জফ শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে খেলেছিলেন।
১৯৫৮ সালের ফাইনালে ব্রাজিলের পেলে ও নিল্তন সান্তোসের বয়সের তফাৎ ছিল ১৫ বছর ৫ মাস। পরের স্থান ফ্রান্সের। ১৯৯৮ সালে শিরোপা জেতা ফরাসিদের হয়ে ফাইনালে শুরুর একাদশে খেলেছিলেন জিনেদিন জিদান ও ফঁক লেবাফ। দুজনের বয়সের পার্থক্য ছিল ৪ বছর ৫ মাস।
ফাইনালে অনন্য হার্স্ট
১৯৬৬ সালের ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে ৪-২ গোলে হারিয়েছিল ইংল্যান্ড। দলটির হয়ে হ্যাটট্রিক করেছিলেন জিওফ হার্স্ট, আরেকটি গোল মার্টিন পিটার্সের। বিশ্বকাপের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে এখন পর্যন্ত তিন গোল করা একমাত্র খেলোয়াড় হার্স্ট।
হার্স্ট ও পিটার্স মিলে ৮ ম্যাচের অভিজ্ঞতা নিয়ে ওই টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়েছিলেন। পরের আসরের ফাইনালে ইতালিকে ৪-১ গোলে হারিয়েছিল ব্রাজিল। লাতিন আমেরিকার দলটির হয়ে গোলগুলো করা খেলোয়াড়দের মিলিত অভিজ্ঞতা ছিল ২২০ ম্যাচের।
পাঁচ বদলে অদ্বিতীয় ব্রাজিল
১৯৫৮ সালে নিজেদের প্রথম শিরোপা ঘরে তুলেছিল রেকর্ড পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। অস্ট্রিয়া ম্যাচ দিয়ে ওই আসর শুরু করা লাতিন আমেরিকানরা ফাইনালে খেলেছিল সুইডেনের বিপক্ষে। তাদের প্রথম ম্যাচের শুরুর একাদশের পাঁচ জন ছিলেন না শিরোপা নির্ধারণী লড়াইয়ে। বিশ্বকাপ জেতা কোনো দল তাদের প্রথম ম্যাচের একাদশ থেকে শেষ ম্যাচের একাদশে এত বেশি বদল আনেনি।
অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে শুরুর একাদশে না থাকা জিজালতা সান্তোস, জিতু, গারিঞ্চা, পেলে ও ভাভা ছিলেন ফাইনালের একাদশে।
ফাইনালে সুইডেনের হয়ে একটি গোল করেছিলেন ৩৫ বছর বয়সী নিলস লিদহোল্ম। আর ব্রাজিলের হয়ে ১৭ বছর বয়সী পেলে দুটি। বিশ্বকাপের ইতিহাসে ফাইনালে সবচেয়ে বেশি ও কম বয়সে গোল করার রেকর্ড এই দুইজনের।
সুইডেনকে ৫-২ গোলে হারিয়ে শিরোপা ঘরে তুলেছিল ব্রাজিল। ৭ গোলের ফাইনাল বিশ্বকাপে আর কখনও দেখা যায়নি। চারটি শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে ৬টি করে গোল হয়েছে।
৩ ফাইনাল খেলা একমাত্র কাফু
বিশ্বকাপ ইতিহাসে তিনটি ফাইনাল খেলা একমাত্র খেলোয়াড় ব্রাজিলের কাফু। ইতালির বিপক্ষে ১৯৯৪ আসরে চোট পাওয়া জর্জিনিয়োর বদলি হিসেবে প্রথমার্ধে মাঠে নেমেছিলেন ‘দা এক্সপ্রেস ট্রেন’ নামে পরিচিত এই রাইট-ব্যাক।
এরপর ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সের বিপক্ষে ফাইনাল খেলেন কাফু। ২০০২ সালে তার নেতৃত্বেই ফাইনালে জার্মানিকে হারিয়ে নিজেদের পঞ্চম ও সবশেষ শিরোপা জেতে ব্রাজিল।
তিনটি বিশ্বকাপ জেতা একমাত্র খেলোয়াড় পেলে। কিন্তু ব্রাজিলিয়ান এই কিংবদন্তি ১৯৬২ সালের ফাইনালে চোটের কারণে খেলতে পারেননি।
৪
বিশ্বকাপের দুটি ফাইনালে গোল করার কীর্তি আছে স্রেফ চারজন খেলোয়াড়ের- ব্রাজিলের ভাভা (১৯৫৮, ১৯৬২) ও পেলে (১৯৫৮, ১৯৭০), পশ্চিম জার্মানির পল ব্রিটনার (১৯৭৪, ১৯৮২) এবং ফ্রান্সের জিনেদিন জিদান (১৯৯৮, ২০০৬)।
মন্তির অনন্য কীর্তি
দুটি ভিন্ন দেশের হয়ে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা ইতিহাসের একমাত্র ফুটবলার লুইস মন্তি। ১৯৩০ সালে উদ্বোধনী আসরের ফাইনালে উরুগুয়ের বিপক্ষে জন্মভূমি আর্জেন্টিনার হয়ে খেলেছিলেন এই মিডফিল্ডার। ওই ম্যাচে ৪-২ গোলে জিতে শিরোপা ঘরে তোলে উরুগুয়ে।
পরে ১৯৩৪ সালের ফাইনালে ইতালির হয়ে চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। এবার শিরোপা জেতার অনির্বচনীয় স্বাদ পান মন্তি। শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচটি ২-১ গোলে জিতেছিল ইতালি।