নারী ফুটবল
দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েদের ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে টানা দুইবারের জয়ী সাবিনা-মনিকা-ঋতুপর্ণাদের নিতে হবে আরও বড় মঞ্চে নিজেদের প্রমাণের চ্যালেঞ্জ।
Published : 02 Nov 2024, 06:40 PM
অনেক চ্যালেঞ্জ জিতে, অনেক বাধা পেরিয়ে, মনস্তাত্বিক লড়াই উতরে উইমেন’স সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা ধরে রাখা বাংলাদেশ জাগিয়েছে দলকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার আশা। একটু চওড়া হচ্ছে উইমেন’স এশিয়ান কাপে খেলার স্বপ্ন। গতবার বাছাইয়ে দল যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিল, তাতে বোঝা গেছে পথটা মোটেও সহজ নয়। তবে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে টানা দুইবারের জয়ী দলের বড় মঞ্চে নিজেদের সামর্থ্য দেখানোর প্রত্যয় থাকতেই হবে।
ঠিক এই ব্যাপারটি নিয়েই বলছিলেন বাংলাদেশের প্রধান কোচ পিটার জেমস বাটলার। শিরোপা ধরে রাখার অভিযানে দলকে পথ দেখানো এই ইংলিশ কোচ মনে করেন, লক্ষ্য হওয়া উচিত আরও বড়।
“সবাই শুধু সাফ, সাফ করে। কেন স্বপ্নটা আরও বড় করে না? এশিয়ান পর্যায়ে খেলার কথা কেন ভাবে না?”
এশিয়ান কাপের মূল পর্বে এখনও খেলার সুযোগ হয়নি বাংলাদেশের। সবশেষ ২০২২ এর বাছাইয়ে ইরান ও জর্ডানের বিপক্ষে দুটি ম্যাচেই হেরেছিল ৫-০ ব্যবধানে। দক্ষিণ এশিয়া থেকে মহাদেশীয় টুর্নামেন্টে ভারত ছাড়া এখন পর্যন্ত খেলতে পেরেছে কেবল নেপাল (১৯৯৯ সালে শেষবার)।
এবারের সাফ দিয়ে একটা ব্যাপার পরিষ্কার, ভারত ও নেপালের চেয়ে এখন কিছুটা এগিয়েই বাংলাদেশ। বিশেষ করে আগের আসরের কয়েক জন তারকা খেলোয়াড়ের অনুপস্থিতি, অনুপ্রেরণাদায়ী কোচের বিদায়, খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ না পাওয়ার মতো ব্যাপারগুলো বিবেচনায় নিলে এবারের সাফল্যের মাহাত্ম্য আরও বড়।
২০২২ আসরের আগ পর্যন্ত টানা পাঁচ শিরোপা জিতে এই অঞ্চলের ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের সিংহাসনে ছিল ভারত। সেখানে বসে আরও এগিয়ে যেতে বাংলাদেশের প্রয়োজন একটি নতুন পরিকল্পনা। দলকে এক ধাপ এগিয়ে এশিয়ার মঞ্চে নিতে প্রয়োজন আরও অনেক বিনিয়োগ।
এই পথে দলকে এরই মধ্যে কিছুটা এগিয়ে নিয়েছেন বাটলার। দলে এনেছেন স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা। গড়ে তুলছেন ভবিষ্যতের ভরসা, যারা এরই মধ্যে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন বর্তমানের নির্ভরতাদের। কারো জায়গা নিশ্চিত নয়, খেলতে হবে নিজেকে প্রমাণ করেই। মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তাদের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ হিসেবে আছেন স্বপ্না রানী। মাসুরা পারভীন, নিলুফার ইয়াসমিন নীলাদের ‘প্রতিপক্ষ’ হিসেবে আছেন আফিদা খাতুন, কোহাতি কিসকু। আক্রমণভাগে সাবিনা, কৃষ্ণা রানী সরকারদের ‘চ্যালেঞ্জর’ মুখে ফেলে দিয়েছেন তহুরা খাতুন, শামসুন্নাহার জুনিয়র।
বাটলার পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, কে গতবারের সাফ জয়ী, কে এই প্রথম সাফ খেলতে এসেছে, সেগুলো তিনি দেখবেন না। শুরুর একাদশে কারও জায়গা নিশ্চিত নয়। জায়গা ধরে রাখা আর জায়গা করে নেওয়ার লড়াই ভালোভাবেই ‘উস্কে’ দিয়েছিলেন এই ইংলিশ কোচ। যা কাজেও দিয়েছে বেশ। সিনিয়র বনাম জুনিয়র- যে দ্বন্দ্ব চাউর হয়েছে, বাটলারের দৃষ্টিতে তা প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
দলের ভেতরে চলা ‘লড়াই’ সিনিয়রদের কেউ কেউ নাখোশ হয়েছেন বটে, কিন্তু সেরাটা নিংড়ে দেওয়ার তাগিদ ছিল সবার মধ্যেই। নতুনরাও মুখিয়ে ছিলেন সুযোগের জন্য, যখনই তা মিলেছে, তারাও সেরাটা ঢেলে দিতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি একবিন্দু। এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার মিথস্ক্রিয়ায় বাংলাদেশ আবারও চ্যাম্পিয়ন! কৃতিত্ব তাই অভিজ্ঞ সাবিনা, নতুন আফিদাদের যেমন, গোলাম রব্বানী ছোটনের জায়গায় এবার ডাগআউটে দাঁড়ানো বাটলারেরও তেমনি।
খেলোয়াড়দের অবদান দৃশ্যমান, কোচদের ভূমিকাও কমবেশি সবার জানা। এই অভিযানে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন- বাফুফে কতটা সহায়তা দিয়েছে? ২০২২ সাফের পর ভারত খেলেছিল ১৯টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ, নেপাল ১৪টি। বাংলাদেশ এই সময়ে খেলেছে কেবল ১১ ম্যাচ, এর সবশেষ চারটিতে প্রতিপক্ষ ছিল চাইনিজ তাইপে ও ভুটান। মাঝের সময়ে মিয়ানমার সফরসহ আরও বেশ কিছু ম্যাচ আয়োজনের ঘোষণা দিলেও সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেনি বাফুফে। ফুটবলের নিয়ন্তা সংস্থা নিজেদের কাজ পুরোপুরি না করলেও মেয়েরা নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়েই ধরে রেখেছেন শিরোপা।
সাফের পরীক্ষায় উতরে যাওয়ার পর নিশ্চিতভাবেই দলের জন্য অনেক চাওয়া থাকবে বাটলারের। সদ্য ভূমিষ্ঠ নাতির মুখ দেখার জন্য তার তর সইছে না। দেশে ফিরে নাতির মুখ দেখবেন এবং এরপর ফিরে এসে বলবেন বিস্তারিত, নিজের কাজের পরিধি নিয়েও সিদ্ধান্ত নেবেন।
বাটলার নানা সময়েই বলেছেন, এশিয়ার মঞ্চে তিনি দেখতে চান বাংলাদেশকে। সেই লক্ষ্য মেয়েদেরও। তবে এর পাশাপাশি নিজেদের নিয়েও বেড়েছে তাদের স্বপ্নের পরিধি। পাকিস্তানের নাদিয়া খান, জাহমেনা সামিন মালিক খেলেন ইউরোপে। জামিলা খান খেলেন সৌদি আরবে। নেপালের ফরোয়ার্ড সাবিত্রা ভান্ডারি খেলেন ফরাসি লিগের দল গ্যাঁগোঁতে। বাটলার মনে করেন, সাবিনা, মনিকা, আফিদাদের অন্তত এশিয়ার ক্লাবগুলোতে খেলার সামর্থ্য আছে।
ইউরোপে খেলার স্বপ্ন এর আগেও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাথে আলাপচারিতায় বলেছিলেন সাবিনা। সেই স্বপ্ন উঁকি দিতে শুরু করেছে অন্যদের মনেও।
বল এখন বাফুফের কোর্টে। আরও ভালো আবাসন, পুষ্টি, অনুশীলনের সুবিধা, নিয়মিত আন্তর্জাতিক ম্যাচ নিশ্চিত করার পাশাপাশি মেয়েদের আর্থিক নিরাপত্তার দিকটি আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হলে দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে এশিয়া কিংবা ইউরোপের আকাশেও উড়তে পারে বাংলাদেশের মেয়েরা।