দাবদাহের মধ্যে গরু লালনপালনে অতিরিক্ত যত্ন নিতে গিয়ে বাড়তি খরচের বোঝা বহন করতে গিয়ে লোকসানে পড়ার ভয় তাদের মধ্যে।
Published : 03 May 2024, 01:27 AM
টানা দাবদাহের মধ্যে শুধু মানুষ ভুগছে তা নয়, তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছে গরু, কোথাও কোথাও মারাও যাচ্ছে। ওজন ও দুধ উৎপাদন কমে যাওয়াসহ এমন নানান সমস্যাতেও বিপাকে খামারিরা; বিশেষ করে যাদের চোখ ছিল কোরবানির হাটের পানে তারা আছেন বেশি ভয়ডরের মধ্যে।
গরুর মৃত্যুর খবরে বেশি বিচলিত হয়ে পড়ছেন খামারিরা। পাবনার বেড়ার ঢালার চরে এক খামারির ১০টি থেকে পরপর ৪টি গরু মারা যাওয়ার তথ্য দিয়েছেন স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা। খামারিদের সংগঠনের এক নেতা কেরানীগঞ্জের একটি খামারেই ৮টি গরু মারা যাওয়ার কথা বলেছেন। কেরানীগঞ্জে এ সংখ্যা একশ ছুয়েছে বলে তাকে জানিয়েছেন খামারিরা।তপ্ত বৈশাখের দহনের এই দিনগুলোতে দেশজুড়ে গরুর মৃত্যু ছাড়াও অসুস্থতা, বাড়তি যত্ন নিতে গিয়ে বাড়তি খরচ, গর্ভপাতের কারণে গরুর প্রজনন বাধাগ্রস্ত হওয়ার মতো সংকটের মুখে পড়েছেন খামারি ও চাষিরা।এসব কারণে কোরবানি ঈদকে ঘিরে গরু লালনপালন করে স্বপ্ন বুনছিলেন যেসব খামারি, তাদের চোখে এখন আশঙ্কার কালোমেঘ। গরুকে মোটাতাজা করে ঈদের বাজারের জন্য প্রস্তুত করতে পারবেন কি না সে নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে তাদের মনে।
এসব সংকট থেকে রক্ষা পেতে দিনে একাধিকবার গরুকে গোসল করানো, ফ্যান চালানো ও স্যালাইন-গ্লুকোজ খাওয়ানো হচ্ছে। তবুও যেন গরুকে সুস্থ রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন খামারিরা। বাড়তি খরচের বোঝা বহন করতে গিয়ে লোকসানে পড়ার ভয় তাদের মধ্যে।
কেরানীগঞ্জের আরবান ক্যাটল ফার্মের স্বত্বাধিকারী জুবায়ের হোসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,“আমার গরু আছে ৮০টা। এর মাঝে হঠাৎ হিটস্ট্রোকে একটি মারা যায়। এরপর বাকিগুলোর খাবারে নিয়ন্ত্রণ এনেছি। আর পশু ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী যত্ন নিচ্ছি। তাই বাকিগুলো এখন সুস্থ আছে। তবে ভয় কাটেনি।”
খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার কাছে আসা তথ্য মতে শতাধিক গরু মারা গেছে। আমার জানার বাইরেও অনেক গরু মারা গেছে বলে অনুমান করছি। আমি যেসব গরু মারা যাওয়ার খবর পেয়েছি, সেগুলোর সব কয়টাই বড় গরু ও দুধের গরু।
“আমি যে শখানেক গরু মারা যাওয়ার তথ্য পেয়েছি, সেগুলোর ৪০টি সিরাজগঞ্জের। আর ৫০০ এর মতো গর্ভপাতের ঘটনাও সিরাজগঞ্জে ঘটেছে। সামনে কোরবানির জন্য গরু প্রস্তুত করছেন খামারিরা। তারা এখন অসহায় বোধ করছে।”
তিনি বলেন, এবার কোরবানি ঘিরে সারাদেশে ১ কোটি ৩০ লাখ পশু প্রস্তুত করা হচ্ছে। এর মাঝে শুধু গরু ৬০ লাখ। টানা গরমে গরুর দুধের উৎপাদন কমেছে ২৫ শতাংশ। ৯৯ শতাংশেরও বেশি পশুর ওজন কমেছে। এক হাজারের মতো গাভীর গর্ভপাত হয়েছে। গরু সুস্থ রাখতে খামারগুলোতে খরচ বেড়েছে অন্তত ২০ শতাংশ।
তার ভাষ্য, তবে কোরবানিতে গরু সরবরাহ কম হবে না, খামারিদের খরচ বেড়ে যাওয়ায় শুধু গরুর দামটা একটু বাড়বে।তবে সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাশরুর আহমেদ দিলেন ভিন্ন তথ্য। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম তিনি বলেন,“কেরানীগঞ্জে একটি খামারেই মারা গেছে ৮টি গরু। শুধু কেরানীগঞ্জেই শখানেকের মতো গরুর মৃত্যু হয়েছে হিটস্ট্রোকে। আর সারাদেশে অন্তত দুই হাজার গরু মারা গেছে। অনেক বড় গরুর ৩০ থেকে ৭০ কেজি পর্যন্ত ওজন কমেছে। ২৭ কেজি দুধের গাভী এখন ২০ কেজি দুধ দিচ্ছে।“অনেক কিছু করেও গরুকে দাবদাহ থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না। গরমের কারণে গরু খাওয়াদাওয়া কমিয়ে দেওয়ায় ওজন কমতে শুরু করেছে। গরমের আগে যেমন ওজন বাড়ছিল ধীরে ধীরে, এখন ওজন কমতেছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বিডিএফএ’র পক্ষ থেকে গরুকে তিন থেকে চারবার গোসল করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আর স্যালাইনসহ ভিটামিন খাওয়াতে বলা হয়েছে।”
বগুড়ার খামারি বগুড়া ভান্ডারের মালিক তৌহিদ পারভেজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,“ গরমের কারণে বারবার অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে আমার গরুগুলো। ভয়ে আছি রীতিমতন। আমার খামারে ১৬০টি গরু আছে। সবগুলোরই ওজন কমে যাচ্ছে। দুধের উৎপাদন কমে গেছে।”
পাবনার বেড়ার ঢালার চরে এক খামারির ১০টি থেকে পরপর ৪টি গরু মারা গেছে বলে জানা গেল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমানের কাছ থেকে।
তিনি বলেন, “গরু মারা যাওয়ার কারণ কি তা পরীক্ষা করার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে আঞ্চলিক প্রাণিসম্পদ গবেষণা কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিল। পরীক্ষার পর ‘নাইট্রেস পয়জনিং’ পাওয়া গেছে। প্রচণ্ড দাবদাহের কারণে এ ‘পয়জন’ মাটি থেকে ঘাসে চলে আসে। সেই ঘাস খেয়ে গরু আক্রান্ত হয়, পরে মারাও যেতে পারে। গরুর সুস্থতার জন্য কী করণীয় সেসব বিষয়ে লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। নিয়মিত পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে একাধিক বৈঠকে।”ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের নিবন্ধিত গরুর খামারের সংখ্যা দেশে ৫৫ হাজার। সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাশরুর আহমেদ বলেন, নিবন্ধিত এসব খামারে গরু রয়েছে ১৫ থেকে ১৬ লাখ।
অন্যদিকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ছোট-বড় মিলে ছয় লাখ ৯৮ হাজার ১১৫টি পশুর খামার রয়েছে।এবারের টানা গরমে এসব খামারগুলোতে থাকা গবাদিপশু নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন খামার মালিকরা। তারা আশায় রয়েছেন বৃষ্টি নেমে প্রকৃতির খরতাপ কমবে।
বৃহস্পতিবার দেশে কোথাও কোথাও বৃষ্টি হলেও টানা ৩৩ দিনের তাপপ্রবাহে কয়েকদফা সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে। তপ্ত হয়ে ওঠা প্রকৃতিতে তীব্র গরমের অতিষ্ঠ পশু-পাখি, নেতিবাচক প্রভাবে পড়েছে গরুর খামারগুলোতেও। গরম থেকে গবাদিপশুর সুরক্ষায় সচেতনতমূলক মাইকিং করছে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়ার কথা তুলে ধরে গাজীপুরের মাওনার ক্ষুদে খামারি জুবাইদুর রহমান বলেন, “ঈদের জন্য তিনটা গরু পালতাছি। গরুর খাবারের দাম অত্যাধিক বেশি। এরমধ্যে বড় গরুটা হঠাৎ গরমের কারণে অসুস্থ হইছিল। পরে ওষুধ খাওয়ানোর পরে সুস্থ আছে। গরু পালনে সবমিলিয়া এবার খরচ বেশি পড়ছে। তাই ঈদে কড়া দামে না বেচলে লস হইবো।”
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (সম্প্রসারণ) ডা. মো. শাহিনুর আলম বলেন, অতি গরমের মধ্যে মাঠ পর্যায়ের সব কর্মকর্তাদের খামারিদের পরামর্শ দিতে বলা হয়েছে। তাদের পাশে থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এমন তাপমাত্রা মারাত্মক বিপদের
টানা দাবদাহের মধ্যে চড়তে থাকা তাপমাত্রা এখন গরুর জন্য মারাত্মক বিপদজনক অবস্থায় পৌঁছেছে বলে জানিয়েছেন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিম্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন ফ্যাকাল্টির মেডিসিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের চেয়ারম্যান কে বি এম সাইফুল ইসলাম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “১৫ ডিগ্রি থেকে ২৫ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা গরুর জন্য সহনীয়। এর মাঝে ২০ ডিগ্রিতে গরু সবচেয়ে ভালো থাকে। আর ২৫ এর উপরে যত বাড়তে থাকে ততো হিট স্ট্রেস হতে থাকে, তবে ৩০ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা গরু সহ্য করতে পারে। এর বেশি হলে গরুর শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বেড়ে যাওয়াসহ নানা সমস্যা হতে পারে।
“৩৬ ডিগ্রির উপরে উঠে গেলে সেটা হল বিপজ্জনক। তারমানে বর্তমানে দেশে যে তাপমাত্রা আছে তা গরুর জন্য খুবই অনিরাপদ। এক্ষেত্রে গরুর বিভিন্ন রোগ হতে পারে, হিটস্ট্রোকে মারা যাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।”গরমে করণীয় কী?
অফিস চলাকালীন সময়ে ১৬৩৫৮ নম্বরে ফোন করলে দেশের যে কোনো খামারিকে প্রয়োজনীয় তথ্য সহযোগিতা দেওয়া হয়। জরুরি ক্ষেত্রে এ নম্বর থেকে সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দেন প্রাণী স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা এই শিক্ষাবিদ।
অধ্যাপক সাইফুল বলেন, “তীব্র গরমে পশুর খাবারের টেনডেন্সি কমে যায়। বেশি খাওয়ানো হলে গরুর শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। আর খাবার কম খেলে উৎপাদন একটু কমই হবে। তবু খাবারে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।
“সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত খুব ভারি খাবার খাওয়ানো যাবে না। বরং এই সময়টাতে আগের তুলনায় তিনগুণ বেশি পানি খাওয়াতে হবে। পানির সাথে ভিটামিন সি খাওয়ালে ভালো। খামারের চাল টিনের হলে উপরে চট, বস্তা বা কম্বল জাতীয় জিনিস ভিজিয়ে রাখলে ঘরে ঠান্ডা অনুভূত হবে। খামারে বাতাসের জন্য পর্যাপ্ত ফ্যান রাখতে হবে।
“দিনে একবার গোসল করানো হলেও বারবার শরীর ভেজানো গেলে ভালো হয়। এখন স্বাভাবিক পানিই বেশ গরম। খাওয়ার পানির ১৮ ডিগ্রির নিচে হলে ভালো হয়। তবে বরফের মতো ঠান্ডা যেন না হয়। তাহলে হিতে বিপরীত হবে। টিউবয়েলের পানি খাওয়ানো যেতে পারে। পানির সাথে ভিটামিন সি, গ্লুকোজসহ কিছু ওষুধ দিলে একটু স্বস্তি পাবে গরুগুলো।”
তার পরামর্শ বেশি বেশি কাঁচা ঘাস খাওয়াতে পারলে ভালো। বেশি স্বাস্থ্যবান গরুর দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। কেননা সেগুলোর গরম একটু বেশি অনুভূত হয়।
গরুর খামার একটু বড় ও খোলামেলা বা বাতাস আসা-যাওয়া করতে পারে সে ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন তিনি। তাপে গরম হওয়া পানি না দিয়ে সরাসরি টিউবওয়েলের পানি খাওয়াতে হবে।
তিনি জানান, পানির সঙ্গে ভিটামিন সি, গ্লুকোজসহ কিছু ওষুধ পাওয়া যায়, যেগুলো গরুকে একটু স্বস্তি দেয়।ফি এর বাড়তি বোঝা
এদিকে এ বিপদের মুখেও মিলছে না বিনামূল্যে সেবা। সরকারি প্রাণিসম্পদ চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিতে এলে এক থেকে দুই হাজার পর্যন্ত টাকা ফি নেয় বলে অভিযোগ করেছেন বেশ কয়েকজন খামারি।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (সম্প্রসারণ) ডা. মো. শাহিনুর আলমের কাছে এ অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,“গরুকে যদি প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কাছে নিয়ে আসা হয় সেক্ষেত্রে কোনো ভিজিট নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে অনেক খামারি পশুকে কেন্দ্রে নিয়ে আসতে পারেন না। তখন আমাদের অনেক ডাক্তার তার বাসায় যায়।
“তবে গিয়ে একজন গরিব খামারির কাছে কিছু দাবি করেছে বা জোর করছে, এ ধরনের অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব। দূরত্ব বিবেচনায় কোনো কোনো খামারি চিকিৎসকদের খুশি হয়ে কিছু দিয়ে থাকেন। এছাড়া কৃত্রিম প্রজননসহ কিছু সেবা আছে, যেগুলোর রেট সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সেসব চিকিৎসকরা নেবে।”
তিনি বলেন, “আমাদের কাছে সবসময় সব ওষুধ থাকে না। এক্ষেত্রে সেই ওষুধ খামারিদেরই কিনে নিতে হয়। অফিসের ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের খামারিদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে খামারিদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য। আর আমাদের কর্মীরা সারাদেশেই এ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। আমাদের উপজেলার কর্মকর্তারা সেবা দিচ্ছে।”