সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, এর মধ্যেই ২০-২৫ শতাংশ আমন ধান কাটা হয়ে গেছে। ১৬ হাজার হেক্টর জমি থেকে ৪০ হাজার মেট্রিক টন চাল পাওয়া যাবে।
Published : 25 Nov 2023, 11:23 AM
এবছর সাত কেদার (এক কেদারে ৩০ শতাংশ) জমিতে আমন ধান চাষ করেছেন সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার অচিন্তপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল শান্তি মিয়া। প্রকৃতি এবার ছিল কৃষকের, ফলনও হয়েছে ভালো। তাই এই কৃষকের চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক।
“অনেক বছর ধরি আমন ধান বালা (ভালো) অয় না। বছরো ২-৩ বার মাইর যায়। কিন্তু ইবার ধান বালা অইছে। আগুন মাইয়া (অগ্রহায়ণ মাসের) কৃষক ইবার উন্নত অইত পারব,” এভাবেই খুশি ঝরছিল শান্তি মিয়ার কথায়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে গত কয়েক বছর সুনামগঞ্জে আমনের ফলন ভালো হয়নি। এ বছর কোনো দুর্যোগে না পড়ায় হয়েছে বাম্পার ফলন। ফলে হাসি ফুটছে কৃষকের মুখে। চাষের খরচ মিটিয়ে তারা ধারদেনাও শোধ করতে পারবেন বলে আশা করছেন।
সুনামগঞ্জ কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, এ বছর জেলায় ৮২ হাজার ২১৫ হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও তা ছাড়িয়ে আমন আবাদ হয়েছে ৮৩ হাজার ৩৬৯ হেক্টর। ফলন হবে প্রায় দুই লাখ ছয় হাজার টন ধান, যার বাজার মূল্য প্রায় ৯২৫ কোটি টাকা।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, এর মধ্যেই ২০-২৫ শতাংশ আমন ধান কাটা হয়ে গেছে। ১৬ হাজার হেক্টর জমি থেকে ৪০ হাজার মেট্রিক টন চাল পাওয়া যাবে। যার বাজার মূল্য প্রায় ১৮০ কোটি টাকা।
নভেম্বরের মধ্যেই প্রায় ৫০ ভাগের বেশি আমন ধান কাটা হয়ে যাবে বলে আশা এই কৃষি কর্মকর্তার।
শুক্রবার সদর উপজেলার কোরবাননগর ইউনিয়নে দেখা গেছে, হলুদ রঙ ধারণ করেছে আমনের ক্ষেত। কোনো কোনো জমিতে ধান কাটছেন কৃষক। আবার কেউ কাটা ধান মাড়াই শেষে ধানখলায় শুকাচ্ছেন। অনেকে কাটা ধানের খড় গবাদিপশুর জন্য শুকাতে দিচ্ছেন। সবমিলিয়ে সবার মধ্যে এক ধরনের উৎসবের আমেজ।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ব্রাহ্মণগাঁও গ্রামের কৃষক হারিছ আলী (৬৫) বলেন, “আমার ২২ কেদার আগুন মাইয়া জমিন আছে। জমিন করার মানুষ না থাকায় আইধ্যা দিছি। পয়লা মারার ধান পাইয়া শুকাইতাছি।
“ইবার মুক্তা ও ৩২ ধান বালা অইছে। বালা ফলনের লাগি সার-বিষ বেশি দিতে অইছে। তবে খরচ বেশি অইলেও ইবার ধান রইয়া পুষি গেছে। কোনও লস অইতনা। লাভ অইব।”
এই কৃষকের মতো ভালো ফলন পেয়ে খুশি অচিন্তপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল লতিফও। তিনি ঋণ করে চাষাবাদ করেছিলেন। এখন ভালো ফলন পেয়ে ঋণ পরিশোধ করেও লাভের মুখ দেখবেন বলে আশা করছেন।
এই কৃষক জানান, গত কয়েক বছর ধরে কয়েক দফা বন্যায় বীজতলা ও আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে পড়েনি আমন ধান।
“ইবার আমন খেত বালা অইছে। ধান রইতে গিয়া যা ঋণপিন করছিলাম তা মারা যাইব।”
একই গ্রামের কৃষক আব্দুল মনাফ জানালেন, আগের মতো এখন ধান চাষ করে পোষায় না। সার, বীজ, কীটনাশক সব কিছুর দাম বেড়েছে। তাই কৃষক বেশি লাভবান হতে পারে না।
তবে এবারের বাম্পার ফলনে কৃষক লাভবান হতে পারবে জানিয়ে তিনি বলেন, “ইবার আমরা কৃষকরার জান বাঁচব। খুব বালা ধান অইছে।”
বামনগাঁও গ্রামের কৃষক আব্দুল হামিদ জানালেন, এ বছর মুক্তা, বিআর ৩২, ২২ ধান খুব ভালো ফলন দিয়েছে।
এভাবে নিয়মিত ফলন পেলে, শ্রমিকদের খরচ ও অন্যান্য খরচ কুলিয়েও কৃষক লাভবান হতে পারবে জানিয়ে তিনি বলেন, “ইবার আমরার আগুন মাইয়া ধান মাইর গেছে না। ইলা ফসল পাইলে ক্ষেত কইরা, কামলা খরচ দিয়া পোষলনে।”
গত মৌসুমে সুনামগঞ্জের হাওরে স্মরণকালের সবচেয়ে বাম্পার বোরো ধানের ফলন হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ ফসল তুলতে পেরে তৃপ্তিতে ছিলেন হাওরের চাষীরা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে না পড়ায় এবার এর ধারাবাহিকতা আমনেও লক্ষ্যণীয়।
সুনামগঞ্জ কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত বোরো মৌসুমে নয় লাখ ছয় হাজার ৬৪৯ টন চাল উৎপাদন হয়েছিল। যার বাজারমূল্য প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। আমন চাষে জেলায় প্রায় আড়াই লাখ চাষী জড়িত। ভালো ফলনে তারাও এবার লাভের মুখ দেখবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, রবি মওসুমে এবার প্রায় ১২ হাজার কৃষক পরিবারকে সার ও বীজ দেওয়া হয়েছে। ৮৮টি ইউনিয়নে উদ্বুদ্ধকরণ সভা করা হয়েছে কিভাবে ফলন বাড়াতে হবে এবং পোকা-মাকড় দমন করতে হবে।
এছাড়াও সুনামগঞ্জ সদর ও ছাতক উপজেলায় ১০০ কৃষককে সার বীজ, কীটনাশক, ধান রোপন, কাটা ও মাড়াইসহ সব খরচ দিয়ে চাষাবাদ করানো হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, গত বোরো মওসুমে জেলায় স্মরণকালের বাম্পার ফলন হয়েছে। এর ধারাবাহিকতা আমনেও লক্ষ্য করা গেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পোকামাকড়ে কোনো ক্ষতি না করায় আমনেরও বাম্পার ফলন হয়েছে।