কুমিল্লায় অবৈধ দেড়শ লেভেল ক্রসিং যেন ‘মরণফাঁদ’

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই কুমিল্লায় রেলপথে প্রাণহানি হয়েছে ৪৭ জনের।

আবদুর রহমান, কুমিল্লা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 August 2022, 08:37 AM
Updated : 6 August 2022, 08:37 AM

পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের প্রবেশদ্বার বলা হয় কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশনকে। কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, লাকসাম রেলওয়ে থানার আওতাধীন রেলপথে অনুমোদনহীন ও অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা প্রায় দেড়শ।

কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন, বাস্তবে এই সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। আর দিন দিন এসব লেভেল ক্রসিং ‘মরণফাঁদ’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠছে মানুষের কাছে।

কুমিল্লা জেলার ১২০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা রেলপথে গত সাড়ে পাঁচ বছরে ৩৩৪ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে রেলওয়ে পুলিশ। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই নিহত হয়েছে ৪৭ জন। এসব দুর্ঘটনার বেশিরভাগই অনুমোদনহীন লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ঘটেছে বলে জানা গেছে।

কুমিল্লা রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী লিয়াকত আলী মজুমদার জানান, জেলার রেলপথ পড়েছে- ঢাকা-লাকসাম-চট্টগ্রাম, লাকসাম-নোয়খালী ও লাকসাম-চাঁদপুর পথে। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে লাকসাম থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ডাবল লাইন নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। ৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথে বৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা ১৪টি, অবৈধ ক্রসিংয়ের সংখ্যা ৬৪টি। এর মধ্যে ২০টি লেভেল ক্রসিং নতুন করে বৈধ করা হচ্ছে।

এ ছাড়া লাকসাম-চাঁদপুর রেলপথে ২০টি বৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে এবং অবৈধ ৩৭টির মধ্যে ১৪টি নতুন করে নির্মাণ করে বৈধ করা হচ্ছে। আর লাকসাম-নোয়াখালী রেলপথে বৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা ২২টি এবং অবৈধ ৪২টির মধ্যে নতুন করে গেট নির্মাণ করা হচ্ছে ১৬টিতে।

গত ৯ মার্চ ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর এলাকায় স্কুলে যাওয়ার পথে ট্রেনে কাটা পড়ে তিন শিক্ষার্থী নিহত হয়। তারা বিজয়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ছিল।

বিজয়পুর এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে লিয়াকত আলী মজুমদার জানান, বিদ্যালয়ের এলাকায় ৫০০ ফুট ফ্যান্সিং (কাঁটাতারের বেড়া) করা হবে। এ ছাড়া দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রতিটি লেভেল ক্রসিংয়ে ১০০ ফুট করে ফ্যান্সিং করা হবে।

লাকসাম রেলওয়ে থানার ওসি খন্দকার জসিম উদ্দিন বলেন, লাকসাম রেলওয়ে থানার আওতাধীন এলাকাটি হলো- ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গঙ্গাসাগর রেলস্টেশন থেকে ফেনীর ফাজিলপুর, লাকসাম-নোয়াখালী রুট এবং লাকসাম-চাঁদপুর রেলপথে লাকসামের চিতোষীর আগ পর্যন্ত।

“এর মধ্যে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা লালমাই, সদর দক্ষিণ, নাঙ্গলকোটসহ কুমিল্লা জেলা এলাকা।”

তিনি জানান, ট্রেন দুর্ঘটনায় এই এলাকায় ২০১৭ সালে ৭৪ জন, ২০১৮ সালে ৬৮, ২০১৯ সালে ৬৬, ২০২০ সালে ৩৭, ২০২১ সালে ৪২ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা ৪৭ জন।

তিনি বলেন, অসচেতনতার কারণেই ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যায় অনেকে। এ ছাড়া রেললাইনের ওপর দিয়ে যাওয়া সড়ক পথের বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে যান চলাচলে অসাবধানতার কারণে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহনের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষেও প্রাণহানি ঘটে। আমরা চেষ্টা করছি, এসব বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে।

জেলার লাকসাম উপজেলার বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, প্রভাবশালীরা রেললাইনের লেভেল ক্রসিং সংলগ্ন জমি অবৈধভাবে দখল করে বাড়িঘর, দোকানপাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। যার কারণে অনেক সময় পথচারী ও যানবাহন চালকদের ট্রেন চলাচল চোখে পড়ে না। এতে প্রতিটি অবৈধ লেভেল ক্রসিং এক একটি মরণফাঁদ হয়ে পড়েছে।

জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলার বাসিন্দা ফখরুল ইসলাম বলেন, ২০১৫ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের লাকসাম থেকে চিনকি আস্তানা পর্যন্ত ডাবল রেললাইনে ট্রেন চলাচল শুরু করে। এতে ওই রেলপথে আগের চেয়ে অনেক দ্রুত সময়ে ও গতিতে ট্রেন চলাচল করছে।

তিনি বলেন, ৬১ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাবল এই রেলপথে হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ লেভেল ক্রসিংয়ে কোনো গেট ও গেটম্যান নেই। এতে প্রায়ই ট্রেনে কাটা পড়ে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। দ্রুত এসব বিষয়ে রেলওয়েকে পদক্ষেপ নিতে হবে।

লাকসাম রেলওয়ে জংশনে কর্মরত তিনজন রেলকর্মী জানান, অনেক সময় দেখা যায় দুর্ঘটনা বা হতাহতের খবরও রেলওয়ে পুলিশের কাছে এসে পৌঁছায় না। স্থানীয়রা নিজেরাই লাশ উদ্ধার করে দাফন করে ফেলেন। বিগত বছরগুলোতে প্রাণহানির বেশিরভাগই হয়েছে অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের জন্য।

তারা জানান, এ ছাড়া রেলওয়ের পক্ষ থেকে কুমিল্লা ও আশপাশের এলাকায় দেড় শতাধিক অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের কথা বলা হলেও বাস্তবে এর সংখ্যা হবে ৩০০ বেশি। কারণ অনেকক্ষেত্রে দেখা গেছে, মানুষ নিজেদের সুবিধার্থে যত্রতত্র রেললাইনের উপর দিয়ে রাস্তা বানিয়ে চলাচল করছে।

অবৈধ এসব লেভেল ক্রসিংয়ে গেট নির্মাণ ও গেটম্যান নিয়োগের দাবি দীর্ঘদিনের হলেও এই সমস্যা সমাধানে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই বলে দাবি স্থানীয়দের। তবে এরই মধ্যে বেশ কিছু স্থানে গেট নির্মাণ ও গেটম্যান নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে।

কুমিল্লা রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী লিয়াকত আলী মজুমদার বলেন, পর্যায়ক্রমে আমরা গুরুত্বপূর্ণ লেভেল ক্রসিংগুলোয় গেট নির্মাণ এবং গেটম্যান নিয়োগ দেওয়া শুরু করেছি।

তিনি আরও বলেন, “এ ছাড়া রেললাইনে যেহেতু সবসময় ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকে, সেক্ষেত্রে জনসাধারণকেই সচেতন হতে হবে। মানুষ চলাচলে সচেতন হলেও ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণহানি কমে আসবে।”