সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে একের পর এক সৃজনশীল উদ্যোগে যেন পর্যটনকেন্দ্রিক আশার পাখিরা ডানা মেলছে।
Published : 02 Jul 2023, 11:24 AM
এক সময় বহু শঙ্কা ছিল পাহাড়ের পর্যটনে। বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের সশস্ত্র তৎপরতায় বিপর্যস্ত আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি হয়; কিন্তু তারপরও তিন পাহাড়ি জেলার পর্যটন দৃশ্যত ডানা মেলেনি। স্থানীয় সংস্কৃতি ও নিজস্বতা বিপন্ন হওয়ার শঙ্কায়ও পর্যটনের বিরোধিতা ছিল।
কিন্তু মেঘ কাটছে পাহাড়ের পর্যটনে। শুধু সরকারি উদ্যোগই নয়, এবার পর্বতকেন্দ্রিক পর্যটনে এগিয়ে এসেছেন পাহাড়ের তরুণরা। সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে একের পর এক সৃজনশীল উদ্যোগে যেন পর্যটনকেন্দ্রিক আশার পাখিরা ডানা মেলছে।
কিন্তু কেন বা কোন জাদুবলে বদলে যেতে শুরু করেছে লেক-পাহাড়ের পর্যটন, কেনইবা এগিয়ে আসছেন তারা – এমন প্রশ্নের জবাবে রিসোর্ট, কটেজ এবং হাউজবোটের মালিকানায় থাকা তরুণরা জানালেন তাদের নিজস্ব ভাবনার কথা।
রাঙামাটির কাপ্তাই লেকে প্রথম হাউজবোট ‘প্রমোদিনী’র উদ্যোক্তা দীপাঞ্জন দেওয়ান বলছেন- “আমাদের অঞ্চলকে আমরা ভালোবেসে যতটা নান্দনিক ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারব, সেটা বাইরের কেউ পারবে না।
“সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে দেশের তথা এই অঞ্চলের সবচে বড় হ্রদটিকে ব্র্যান্ডিং করার জন্যই আমরা কাশ্মীর ও কেরালার মতো এখানেও হাউজবোট কনসেপ্ট নিয়ে কাজ শুরু করেছি এবং বলতে পারেন আমরা বেশ সাড়াও পাচ্ছি।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা শুরু করেছিলাম, এখন অনেকেই আমাদের পথ ধরে এগিয়ে আসছে।”
মাত্র বছরখানেক আগে পথ চলা শুরু করেছে বার্গি রিসোর্ট। এই রিসোর্টের পরিচালক বাপ্পী তংচঙ্গ্যা। তিনি বলছেন- “নতুন প্রজন্ম ট্যুরিজমে এগিয়ে আসছে- এর প্রধান কারণ হলো, সময়ের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং এর সম্ভাবনাকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করার জন্যই।
“আগের প্রজন্ম যে সাহস ও বাস্তবতার কারণে এগিয়ে আসেননি, আমাদের প্রজন্ম সাহসের সাথে পরিস্থিতিকে অনুকূলে নিয়েই এগিয়ে এসেছে।”
তবে পাহাড়ের ট্যুরিজম বিকাশে, স্থানীয় মানুষকে আরও বেশি সম্পৃক্ত করা, এখানকার ইতিহাস ঐতিহ্য ও বর্ণাঢ্য সংস্কৃতিকে প্রমোট করা, স্থানীয়দের আচরণ ও অভ্যাসকে পর্যটকবান্ধব করা, ট্যুরিস্টদের জন্য স্থানীয় ও বিদেশি পানীয় নিশ্চিত করতে লাইসেন্স প্রদান করা এবং ব্যাংকগুলোকে সহজশর্তে ঋণ দেয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন এই তরুণ উদ্যোক্তা।
রাঙামাটিতে সবচে বড় ইকো রিসোর্ট ‘রাইন্যাটুগুন’। এর স্বত্বাধিকারী ললিত সি চাকমা বলছেন, “পাহাড়ের মানুষ ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। তবুও নিজেদের অঞ্চলের কৃষ্টি-সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে বুকে ধারণ ও লালন করে স্থানীয় পর্যটনের বিকাশে এগিয়ে আসছে, এটাতো আশারই দিক।
“এই আশা ও স্বপ্নকে ঠিকপথে পৌঁছে দিতে প্রয়োজন আন্তরিক ও কার্যকর সরকারি সহায়তা এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। এখানকার প্রকৃতি ও পরিবেশকে অক্ষুন্ন রেখে এবং স্থানীয় মানুষকে সাথে নিয়ে-আস্থায় নিয়েই যদি পরিকল্পনা হয়, তবেই সেটি বাস্তবায়িত হবে।
“স্থানীয়রা তো এগিয়ে এসেছে, এবার সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে।’
কাপ্তাই হ্রদের হাউজবোট ‘মাওরুম’ এর পরিচালক অজয় চাকমা বলছেন-‘ এই পাহাড় আমাদের, একে ব্র্যান্ডিং করার জন্য আমাদের আবেগ অনুভূতি ভালোবাসা বাইরে থেকে আসা উদ্যোক্তাদের চেয়ে নিশ্চিত অনেক বেশি হবে।
“আমরা সুবিশাল কাপ্তাই হ্রদের সম্ভাবনাকে বিবেচনায় নিয়েই কাশ্মীর ও কেরালার মতো এখানেও হাউজবোটের ধারণাকে সামনে রেখে কাজ শুরু করেছি। আমরা মনে করি এই সম্ভানাকে ঠিকমত কাজে লাগাতে পারলে এই অঞ্চলের ট্যুরিজমে এর বিশাল ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
হাউজবোটের পাশাপাশি রাঙামাটিতে এর মধ্যেই গড়ে উঠেছে ছোটবড় অন্তত ১০টি রিসোর্ট, এর কোনটিতে শুধুই রেস্টুরেন্ট চালু আছে, কোন কোনটিতে ইতোমধ্যেই চালু হয়েছে আবাসন সুবিধাও।
স্থানীয় তরুণ উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার এই গল্প কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়। এর মধ্যেই চলতি মাসে এইসব উদ্যোক্তারা মিলে গঠন করেছেন রাঙামাটি রিসোর্ট ওনার্স এসোসিয়েশন। যেটি সাজেকের বাইরে রাঙামাটির রিসোর্ট মালিকদের প্রথম কোনো সাংগঠনিক উদ্যোগ।
জুমকিং লেক রিসোর্টের মালিক তনয় দেওয়ানকে সভাপতি, বার্গি লেকভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুমেত চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত নয় সদস্যের এই কমিটিতে কোষাধ্যক্ষ হিসেবে আছেন ইজোর রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড রিসোর্টের ম্যাকফিল চাকমা।
সদস্যরা হলেন রাইন্যাটুগুন ইকো রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ললিত সি চাকমা, গাঙপাড় গার্ডেন রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী হিটলার দেওয়ান, টং ইকো রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী রনজিত তঞ্চঙ্গ্যা, বড়গাং রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী প্রিয়দর্শী চাকমা, ডিভাইন লেক আইল্যান্ডের স্বত্বাধিকারী অতীশ চাকমা।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সুমেত চাকমা বলেন, “ট্যুরিজমের যে বিপুল সম্ভাবনা আছে, আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে অটুট রেখে যদি সেটাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে এইক্ষেত্রে অপার সম্ভাবনা আছে, আছে কর্মসংস্থানের সুযোগও।
“তরুণ উদ্যোক্তারা এইসব বিষয়ে বেশ সচেতন। আমরা সরকারের প্রতি অনুরোধ জানাই, এই উদ্যোক্তাদের পাশে যেনো দাঁড়ায় এবং রাঙামাটিকে পর্যটকবান্ধব করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।”
পাহাড়ের পর্যটনের উন্নয়নে তরুণ উদ্যোক্তাদের এমন চেষ্টাকে স্বাগত জানাচ্ছেন স্থানীয় প্রশাসনও।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী বলেন, “তরুণদের এমন উদ্যোগ পাহাড়ের জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। আমি তাদের এমন উদ্যোগের সফলতা কামনা করি।”
তবে এই তরুণ উদ্যোক্তরা সবচে বেশি সমস্যায় পড়েছেন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। তাদের বেশিরভাগ উদ্যোগই একান্তই স্থানীয় ও বন্ধুবান্ধবদের যৌথ বিনিয়োগ, কিন্তু তার পরিমাণও উল্লেখ করার মতো নয়। এই সেক্টরে ঋণ দিতেও খুব একটা আগ্রহী দেখা যায় না ব্যাংকগুলোকে।
এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংক বনরূপা শাখার ব্যবস্থাপক মো. রেজাউল করিম বলেন, “আমাদের ট্যুরিজমের জন্য আলাদাভাবে ঋণ দেওয়ার কোনো খাত নাই, বর্তমানে আমরা জায়গার বৈধ কাগজপত্র থাকলে তার বিপরীতে ঋণ দিতে পারব।
“যদি বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যটনকে মাথায় রেখে বিশেষ কোনো নির্দেশনা দেয় এবং ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশ আসে তবে অবশ্যই আমরা এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য সহায়তা করতে পারব।”