ভৈরবে ট্রেন দুর্ঘটনা: চিকিৎসার খরচই এখন বড় দুশ্চিন্তা

রেল কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত খোঁজ নেয়নি বলে অভিযোগ ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্বজনদের।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Oct 2023, 05:14 PM
Updated : 24 Oct 2023, 05:14 PM

ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালের চারতলার মেঝেতে স্বামীর বিছানার কাছে মেঝেতে পাটিতে বসে কাঁদছিলেন তাসলিমা। ভৈরবের রেল দুর্ঘটনায় তার রিকশাচালক স্বামী স্বাধীন মিয়ার পায়ের তিন জায়গায় ভাঙা হাড় অস্ত্রোপচার করে জোড়া দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে; আর দুশ্চিন্তায় ঘুমহীন তাসলিমা শুধু নিজের কপালকেই দোষারোপ করে চলেছেন।

পঁচিশোর্ধ্ব স্বাধীনের শরীর থেকে প্রচুর রক্ত গেছে। স্বামীর দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পর থেকেই পেরেশানির মধ্যে আছেন তিনি। ঢাকা পর্যন্ত তাকে আনতেই ব্যাপক ঝঞ্জাট পোহাতে হয়েছে। কোনো রকমে প্রাণে বাঁচলেও এখন চিকিৎসা কীভাবে হবে আর খরচ কোথায় থেকে আসবে সেই দুর্ভাবনা পেয়ে বসেছে তাকে।

ভৈরব দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পঙ্গু হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি আছেন স্বাধীনসহ চারজন। তারা সবাই শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এত গুরুতর আহত হওয়ার চিকিৎসার খরচ জোগানোর সামর্থ্য তাদের নেই।

স্বজনরা বলছেন, রেল কর্তৃপক্ষ বা সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।

তবে রেলওয়ে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আহতদের যথাযথ চিকিৎসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের জেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা সিরাজ উদ-দৌলা খানের পাঠানো বার্তায় বলা হয়, অপ্রত্যাশিত এ দুর্ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতাসহ আহতদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

Also Read: ‘ট্রেন থেকে বেরিয়ে দেখি রক্তাক্ত যাত্রীরা ছোটাছুটি করছে’

Also Read: ভৈরব দুর্ঘটনা: ভাতিজার বিয়ে শেষে ফেরা হলো না সুজন মিয়ার পরিবারের

Also Read: ভৈরবে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা: ১৬ জনের লাশ হস্তান্তর

Also Read: ঢাকায় ট্রেন ইঞ্জিন ঘোরানো যায় না, সতর্ক করা হয়েছিল একদিন আগেই

পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম জানান, সোমবারের দুর্ঘটনায় আহত ১১ জন চিকিৎসার জন্য আসেন। এদের মধ্যে দুজনের মাথায় জখম থাকায় তাদের নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে পাঠানো হয়। বাকি পাঁচজনকে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। চারজনকে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

হতাহত এসব যাত্রীর ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগও খুব সীমিত বলে জানাচ্ছেন রেলের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, বিদ্যমান রেলওয়ে আইনে হতাহত যাত্রীদের সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা আছে। ১৮৯০ সালে যখন ব্রিটিশরা এই আইন করে তখন ১০ হাজার টাকার মূল্য হয়তো অনেক বেশিই ছিল। তবে ‘রেলওয়ে (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট ২০২১’ নামে রেলের আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটির খসড়ার ৮২ (ক) ধারায় রেলওয়ের গাফিলতিতে যাত্রীর মৃত্যু হলে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধানের প্রস্তাব করা হয়েছে। খসড়া আইনটি এখনও সংসদে পাস হয়নি।

কে যোগাবে খরচ? 

আহত স্বাধীনের ২৩-২৪ বছর বয়সী স্ত্রী তাসলিমা দুর্ঘটনার বিষয়ে কথা বলছিলেন আর কাঁদছিলেন। জোরে কান্নার কারণে পাশের বিছানার রোগীর স্বজনদের ধমকও খেলেন কয়েকবার। নিজের উপার্জন নেই, সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামী ভাঙা পা নিয়ে কাতরাচ্ছেন; ওষুধের প্রভাবে ঘুমাচ্ছেন। এ অবস্থায় ফোনে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে সাহায্য চাওয়া ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছেন না। 

তাসলিমা জানান, ঢাকার মিপুরের কাজীপাড়া এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন তারা। আট বছরের একটি ছেলে আছে তাদের। স্বাধীন মিয়া রিকশা চালিয়ে যে আয় করেন তাতেই কোন রকমে সংসার চালিয়ে নিচ্ছিলেন। 

দুই দিন আগে গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে গিয়েছিলেন স্বাধীন। সোমবার গ্রামের বাড়ি থেকে এগার সিন্ধুর ট্রেনে ঢাকায় ফেরার পথে দুর্ঘটনায় পড়েন। 

তিনি বলেন, সোমবার বিকেল ৫টার দিকে অপরিচিতে একজন ফোন করে তাকে বলেন “আপনার স্বামী ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট কইরা রাস্তায় পইড়া রইছে। নেওয়ার মতো কেউ নাই। ঠ্যাং ভাইঙা হাড্ডি বাইরায়া গেছে, রক্তে ভাইসা যাইতাছে। তাড়াতাড়ি আপনাদের লোক আইতে কন।”

তাসলিমা বলেন, “আমি তারে কইছি ‘আমার তো কেউ নাই ওইহানে। আমি ঢাকাত্তে গিয়া ক্যামনে তারে আনমু’। কী যে করুম। বুঝতে পারতাছিলাম না। হেই ব্যাডায় কিছুক্ষণ পর পর ফোন দিয়া কইতাছে, ‘তাড়াতাড়ি করেন, কাউরে আইতে কন। ঠ্যাংডা দুই ভাগ হইয়া গেছে। রক্তে ভাইসা যাইতাছে।’ আমি পরে তারে কইলাম, ‘আমি মহিলা মানুষ, কই যামু। আপনারা একটা ব্যবস্থা করেন’।”

কান্নারত এ নারী বলেন, ফোনকারী ওই ব্যক্তি পরে একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ঢাকায় পাঠানোর প্রস্তাব দেন। তাসলিমা অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া পরিশোধে রাজী হন। কিন্তু একা রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে পাঠাতে রাজি হচ্ছিলেন না সেখানকার লোকেরা। পরে তারা আহত আরেক ব্যক্তির সঙ্গে স্বাধীনকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেন।

সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা রক্ত বন্ধের চেষ্টা চালান। পরে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়।

তাসলিমা বলেন, ঢাকা মেডিকেল থেকে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিতে স্বাধীনকে একটি সিএনজি অটোরিকশায় তোলা হয়। এসময় আবারও রক্তপাত শুরু হয়ে যায়, রক্তে ভাসাভাসি হওয়ায় তাকে অটোরিক্সায় নেওয়া যাচ্ছিল না। পরে আরেকটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে হয়। রাতে পঙ্গু হাসপাতালে আনার পর পায়ে অস্ত্রোপচার করা হয়।

অস্ত্রোপচারে পর তার পায়ে যে ধাতব খাঁচাটি লাগানো হয়েছে সেটিও কিনতে ৩ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে তাসলিমাকে। তিনি বলছেন, “আমার হাতে কুনো টেকা আছিল না। কয়েকজনের কাছ থিকা হাওলাত কইরা আসছি। অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়াই দিলাম পাঁচ হাজার। অপারেশনের সময় ওষুধ, যন্ত্রপাতি মিলায়া লাগলো আরও পাঁচ হাজার। এক্সরে করাইলাম ছয়শ টাকায়। ওষুধের জন্য আরও টেকা লাগবো কইতাছে। আমি কই পামু এতো টেকা। আমার ভাসুরে আইছে। হেও তো গরীব মানুষ।”

তিনি বলেন, “ওর কামাইয়ে আমার সংসার চলতো। ঠ্যাংটাতো ওর গেল। এহন তো রিক্সাও আর চালাইতে পারবো না আবার চিকিৎসার এতোগুলা টেকা আমারে কে দিব। সব আত্মীয়-স্বজনরে ফোন করতাছি টেকার জন্য।”

বিলের বোয়াল ও ট্যাংরা মাছ, দেশি মুরগি আর প্রচুর কাঁচামাল নিয়ে খুশি মনেই ট্রেনে স্ত্রী হালিমাকে নিয়ে এগার সিন্ধুরে উঠেছিলেন সবজি ব্যবসায়ী মো. শাহজাহান। ভৈরবের দুর্ঘটনায় বাম হাতের তর্জনি হারিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিনি, বাম হাতের হাড়ও ভেঙেছে তার। তার স্ত্রী হালিমার মাথার খুলির হাড় ফেটেছে, হাতে-পায়েও হাড় ভেঙেছে। তিনিও ভর্তি আছেন পঙ্গু হাসপাতালে।

ছেলে-মেয়ে নিয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জে থাকেন, শাকসবজির ব্যবসা করে সংসার চালান। স্ত্রী হালিমাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন। বাজিতপুর থেকে এগার সিন্ধুর এক্সপ্রেসের ‘ট’ বগিতে উঠেছিলেন। ভৈরব স্টেশনে ‘ট্রেন ঘোরানোর’ মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বিকট শব্দে মালগাড়িটি তাদের ট্রেনে ধাক্কা দেয়। ট্রেনের বগির ছাদ ভেঙে পড়ে। পরে স্থানীয় লোকেরা তাদের টেনে বাইরে বের করে নিয়ে আসেন।

শাহজাহানের শয্যাপাশে রয়েছেন তার জামাতা রাকিব হোসেন। রাকিব বলছেন, তার শ্বশুর ছোট ব্যবসা করেন। দুর্ঘটনার পর তার মালামাল আর পাননি, পকেটে থাকা টাকাও হারিয়েছেন। পরে খবর পেয়ে তারা ভৈরব থেকে তাদের ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করেন। এখন পর্যন্ত তাদের ২০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে।

রেল কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসনের কেউ তাদের খোঁজ না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আইজকা রেলের দোষে আমাগো এই অবস্থা। অথচ কেউ একটা খবরও করলো না। গরীব মানুষ আমরা। হ্যাগো চিকিৎসা চালাইতে আরও অনেক খরচ আছে সামনে। হ্যাতে নিজেও ইনকাম করতে পারব না অনেকদিন। এত টেকা আমাগো কে দিব।”

একই হাসপাতালে ভর্তি আছেন রিকশাচালক আব্দুল খালেক। তার ডান পা ভেঙেছে শরীরের ডান পাশে নানা জায়গায় গভীর ক্ষত রয়েছে। শয্যাপাশে বসে সুপারির খোল দিয়ে বানানো পাখা হাঁকিয়ে বাতাস করছিলেন তার স্ত্রী ফালিমা।

ফালিমা জানান, ঢাকার বিশ্বরোড এলাকায় রিকশা চালান খালেক। তিনি (ফালিমা) দুই মেয়েকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি থাকেন। কুলিয়ারচর থেকে ট্রেনে উঠেছিলেন খালেক। তার কাছে মোবাইল ফোন ছিল না। দুর্ঘটনার পর গ্রামের একজন তাকে চিনতে পেরে বাড়িতে মেয়ের নম্বরে ফোন করে খবর দেন। এরমধ্যেই তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় আনা হয়। পরে ফালিমা মেয়েদের নিয়ে ঢাকায় আসেন।

আহত স্বামীর চিকিৎসার খরচ নিয়ে উদ্বিগ্ন ফালিমা বলেন, “আমরা গেরামের মানুষ, কাউরে চিনিও না। হ্যাতে না কামাইলে আমাগো খাওনও বন্ধ আর হ্যায় এহন ঠ্যাং ভাইঙা পঙ্গু হইল, তার চিকিৎসা করামু কী দিয়া আর মাইয়াগো লইয়া আমি চলমু কীবায়?”

স্বাধীনের স্ত্রী তাসলিমা, খালেকের স্ত্রী ফালিমা, আহত শাহজাহান সবাই জানালেন রেল কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি এমনকি সান্ত্বানাটুকুও দেয়নি।

এ বিষয়ে কথা বলতে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান ও পূর্ব জোনের মহাব্যবস্থাপক নাজমুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা ফোন ধরেননি।      

তবে রেল মন্ত্রণালয়ের জেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা সিরাজ উদ-দৌলা খানের পাঠানো বার্তায় বলা হয়, হতাহতের পরিবারের স্বজনদের আর্থিক সহযোগিতাসহ যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণে নির্দেশ দিয়েছেন রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

>>>>>>>>>>>>>