দুই ট্রেনের সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ১৭ জনের প্রাণহানির খবর এসেছে।
Published : 24 Oct 2023, 12:38 AM
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে একটি কনটেইনার ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষের পর এগার সিন্ধুর এক্সপ্রেসের দুটি বগি উল্টে অন্তত ১৭ জনের প্রাণ গেছে; যাদের মধ্যে রাতেই ১৬ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
সোমবার বিকাল পৌনে ৪টার দিকের ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। দুই ট্রেনের সংঘর্ষে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া বগির মধ্যে থেকে চাপা পড়া মানুষের মৃতদেহ বের করতে দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। আহতদের অনেককে উদ্ধার করা হয়েছে বগির ভেতর থেকে। কেউ কেউ সংঘর্ষের সময় ছিটকে পড়ে আহত হয়েছেন।
অর্ধশতাধিক আহতদের স্থানীয় হাসপাতালের পাশাপাশি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পঙ্গু হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা হয়েছে।
কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. সাইফুল ইসলাম রাত ১১টার দিকে বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, নিহতদের মধ্যে ১৬ জনের মরদেহ রাতেই স্বজনদের কাছে ভৈরব হাসপাতাল থেকেই হস্তান্তর করা হয়েছে।
সোমবার বিকাল পৌনে ৪টার দিকে ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনের আউটারে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
ঢাকা রেলওয়ে পুলিশের সুপার আনোয়ার হোসেন দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মালবাহী ট্রেনটি এগার সিন্ধুর ট্রেনের পেছনের দুটি বগিতে আঘাত করে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।”
ঘটনাস্থল থেকে ১৭ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট ঘটনাস্থলে উদ্ধার কাজ করছে জানিয়ে সংস্থাটির সিনিয়র স্টাফ অফিসার শাহজাহান শিকদার বলেন, আহতের সংখ্যা শতাধিক হতে পারে বলে তারা ধারণা করছেন।
ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বুলবুল আহম্মদ জানান, দুর্ঘটনায় আহত এ পর্যন্ত ৭০ জনকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। ২১ জনকে ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও স্থানীয় বিভিন্ন ক্লিনিকে অনেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানান তিনি।
আহতদের মধ্যে নয়জনকে পঙ্গু হাসপাতালে আনা হলে চারজনকে সেখানে ভর্তি করা হয়েছে। এদের শরীরের কিছু অংশ ভেঙেছে, কোথাও কাঁটাছেড়া রয়েছে। তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান এ হাসপাতালের পরিচালক ডা. কাজী শামীমুজ্জামান।
তিনি জানান, দুর্ঘটনায় আহতদের মধ্যে মাথায় আঘাত পাওয়া দুইজনকে নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে এবং তিনজনকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
ভয়াবহ এ দুর্ঘটনার পর ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম, সিলেট ও কিশোরগঞ্জের সাত ঘণ্টা রেল যোগাযোগ বন্ধ ছিল। দুই পাশের বিভিন্ন স্টেশনে আটকা পড়ে বেশ কয়েকটি ট্রেন। ঢাকা থেকে উদ্ধারকারী ট্রেন যাওয়ার পর একটি লাইন ক্লিয়ার হলে রাত পৌনে ১১টার দিকে ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
কনটেইনার ট্রেনটি চট্টগ্রামের দিকে ছেড়ে যায়। সাত ঘণ্টা পর রাত ১০টা ৪০ মিনিটে আবার ট্রেন চলাচল শুরু হয় বলে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় মহাব্যবস্থাপক নাজমুল ইসলাম জানান।
এদিকে খবর পেয়ে সন্ধ্যা ৬টার দিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এসময় তিনি নিহতদের দাফন-কাফনের জন্য ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান এবং আহতদের যথাযথ সুচিকিৎসার নির্দেশনা দেন।
যেভাবে দুর্ঘটনা
নাজমুল ইসলাম বলেন, কিশোরগঞ্জে থেকে ছেড়ে আসা এগার সিন্ধুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। আর কনটেইনারবাহী ট্রেনটি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল।
“আমরা পেয়েছি ওই কনটেইনারবাহী ট্রেনটির চালক ও সহকারী চালক সিগন্যাল অমান্য করায় এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। তাদের দাঁড়ানোর কথা ছিল ভৈরব স্টেশনের আউটার সিগন্যালে।
“কিন্তু তারা সেটি না করে সিগন্যাল অমান্য করে ট্রেনটি চালিয়ে চলে আসে। একই সময় ভৈরব স্টেশন থেকে বের হয়ে ঢাকার পথে আসছিল যাত্রীবাহী এগার সিন্ধুর এক্সপ্রেস। চট্টগ্রামমুখী মালবাহী ট্রেনটির ইঞ্জিন এগার সিন্ধুরের পেছন থেকে তৃতীয় বগিতে আঘাত করে।”
কোনো স্টেশনের আউটার হচ্ছে ট্রেনগুলোকে অপেক্ষায় রাখার জায়গা। অন্য ট্রেনকে জায়গা দিতে আউটার এলাকায় ট্রেন থামার সংকেত বাতি (সিগন্যাল) আগেই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে।
সেই সংকেত বাতি জ্বলেনি, নাকি কনটেইনার ট্রেনের চালক সংকেত দেখতে পাননি- এমন প্রশ্নের উত্তরে রেল কর্মকর্তা নাজমুল বলেন, “এটা তো তদন্তের বিষয়। তিনি সিগন্যাল দেখেননি, না অন্য কোনও কারণ ছিল- এসব খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি কাজ করবে।”
রেলের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক জানান, এগার সিন্ধুর যখন ঢাকার দিকে যাচ্ছিল, তখন এটার পেছনের অংশে ধাক্কা দেয় মালবাহী ট্রেনটি।
“সেখানে একটা সাইড কলিশন হয়েছে। যার ফলে হতাহত আছে। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস সেখানে কাজ করছে। আমাদের উদ্ধারকারী ট্রেন ঢাকা থেকে রওনা হয়েছে।"
এ ঘটনায় কনটেইনারবাহী ট্রেনের চালক (লোকো মাস্টার), সহকারী লোকো মাস্টার ও পরিচালককে (গার্ড) সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সফিকুর রহমান।
ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা
কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলায় ট্রেন দুর্ঘটনার ভয়াবহতা উঠে এসেছে এক যাত্রীর বর্ণনায়।
রবিন নামের ওই যাত্রী যাচ্ছিলেন ঢাকায়। কিশোরগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা এগার সিন্ধুর এক্সপ্রেস ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন ছাড়ার পরপরই ঘটে দুর্ঘটনা।
তিনি বলেন, “ট্রেনের তৃতীয় বগিতে ছিলাম, ট্রেন ছাড়ার দুই মিনিট হইছে, তখনও গতি ওঠেনি, এর মধ্যে বিশাল এক ঝাঁকুনি। আল্লাহ আল্লাহ করে কোনো মতে বের হয়ে দেখি- সামনের দুইটি বগি উল্টে পড়ে আছে।
“রক্তাক্ত অবস্থায় মানুষ বগিগুলো থেকে বের হচ্ছে। অনেকের হাত কাটা, কারো মাথা ফাটা, কারো পা কাটা।”
নিজে বেঁচে যাওয়া রবিন ট্রেন থেকে বেরিয়ে অনেককে উদ্ধারে সহায়তাও করেন।
“এর মধ্যে আমার এক বন্ধুকে খুঁজে পাচ্ছি না। পরে তাকে পা কাটা অবস্থায় পেয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিয়ে আসি।”
তদন্ত কমিটি
রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সফিকুর রহমান জানান, দুর্ঘটনা তদন্তে তারা দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। একটিকে তিন কর্ম দিবসের মধ্যে এবং অপরটিকে ও পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এর বাইরে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তরফে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, উদ্ধারকৃত লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে। লাঙ্গ শনাক্তে ফিঙ্গার প্রিন্ট প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।
যাত্রীর মালামাল ভৈরব রেলওয়ে থানায়
ট্রেন দুর্ঘটনার পর উদ্ধার হওয়া অনেক যাত্রীর লাগেজ এখন ভৈরব রেল স্টেশনে রাখা হয়েছে। পুলিশ বলছে, যাত্রীদের উদ্ধারের পাশাপাশি তাদের লাগেজ বা মূল্যবান জিনিসপত্র যেন খোয়া না যায়, পুলিশ সে দিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে।
ঢাকা রেলওয়ে পুলিশের সুপার আনোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুর্ঘটনার পরপরই তাদের সদস্যরা ঘটনাস্থলে পোঁছে উদ্ধার অভিযান শুরু করেন ।
“আহতদের উদ্ধারের পাশাপাশি কোনো যাত্রীর মালামাল যেন খোয়া না যায়, সে ব্যাপারেও আমরা সতর্ক ছিলাম। ভৈরব রেলওয়ে থানায় অনেক যাত্রীর লাগেজ আমরা সংরক্ষণ করে রেখেছি। যার লাগেজ তিনি উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন।"
দুর্ঘটনার পর অনেকেই যাত্রীদের মালামাল লুট করার চেষ্টা করে জানিয়ে আনোয়ার হোসেন বলেন, তাদের সদস্যরা সতর্ক ছিলেন, কাউকে সুযোগ দেওয়া হয়নি।