ভৈরবে দুর্ঘটনায় পড়া কনটেইনার ট্রেনটির ইঞ্জিন উল্টো দিকে চলছিল।
Published : 24 Oct 2023, 01:56 AM
ঢাকায় ‘টার্ন টেবিল’ নষ্ট থাকায় ট্রেনের ইঞ্জিন বা লোকোমোটিভ ঘোরানো যায় না; আর এতে ইঞ্জিনগুলোকে উল্টো করেই ট্রেন চালাতে হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে।
এ কারণে দীর্ঘ পথে ট্রেন চালানোর সময় ‘সিগন্যাল ও লেভেল ক্রসিং’ দেখতে না পাওয়ায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে যে চলতে হচ্ছে, সে কথা জানিয়ে রোববারই ঢাকার বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলীকে চিঠি দিয়েছিল রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল।
পরদিনই কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় ১৭ জনের প্রাণহানি পর বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। ঘটনার সময় কনটেইনার ট্রেনটির ইঞ্জিন উল্টো দিকেই চলছিল।
সোমবার ভৈরবে দুর্ঘটনায় পড়া ৩০২৮ লোকোমোটিভটি (ইঞ্জিন) ৩২টি কন্টেইনারবাহী বগি নিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল। বিকাল পৌনে ৪টায় ভৈরব স্টেশনের আউটারে ঢাকামুখী যাত্রীবাহী এগার সিন্ধুর এক্সপ্রেস ট্রেনের পেছনের তিনটি বগিতে ধাক্কা দেয় কনটেইনারবাহী ট্রেনটি।
রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, ভৈরব আউটারে সিগন্যাল দেওয়া ছিল, কনটেইনারবাহী লোকোটির সেখানে থেমে অপেক্ষা করার কথা ছিল। কিন্তু কনটেইনার ট্রেনটি পরিচালনার সঙ্গে যুক্তরা সিগন্যাল অমান্য করে মূল লাইনে উঠতে গিয়ে এগার সিন্ধুর ট্রেনটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দিলে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটে।
এর আগে ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার মন্দবাগ স্টেশনে ঢাকামুখী তুর্ণা-নিশীথা এক্সপ্রেস ট্রেনটির ইঞ্জিন চট্টগ্রামমুখী উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের পেছনের কয়েকটি বগিতে আঘাত করলে সেসময়েও ১৭ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়।
পরে তদন্তে উঠে আসে, তুর্ণার চালক সিগন্যাল অমান্য করে একই লাইনে চলে এসে উদয়নের পেছনের বগিগুলোতে আঘাত করে। তুর্ণাকে চলার পথ করে দেওয়ার জন্য উদয়নকে লুপ লাইনে নেওয়া হচ্ছিল; তখন আউটার সিগন্যালে লাল বাতি জ্বললেও তুর্ণার চালক তা ‘ঠিকমতো পর্যবেক্ষণ না করে’ সামনে এগিয়ে ওই দুর্ঘটনা ঘটান।
ভৈরবের ঘটনায় প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি পেশাগত মূল্যও দিতে হয়েছে এ ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে জড়িতদের। সিগন্যাল অমান্য করার অভিযোগে কনটেইনারবাহী ট্রেনটির লোকো মাস্টার (চালক), সহকারী লোকো মাস্টার ও গার্ডকে (পরিচালক) সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে ট্রেনটির চালক কেন সিগন্যাল অমান্য করলেন এই অনুসন্ধানের দায় ‘তদন্ত কমিটির’ ওপর ছেড়ে দিয়েছেন রেলের কর্মকর্তারা।
তবে কনটেইনার ট্রেনের বরখাস্ত হওয়া লোকো মাস্টার জাহাঙ্গীর আলমের দুজন সহকর্মী জানিয়েছেন, ৩০২৮ লোকোমোটিভকে উল্টো হয়ে (লং হুডে) চলতে থাকায় চালককে বসতে হচ্ছিল লোকোটির একেবারে পেছনের দিকে। ৬০ ফিট লম্বা লোকোটির পেছনে বসে চালক একটু বিলম্বে সিগন্যাল দেখতে পান।
“তিনি ট্রেনটির গতিরোধের জন্য ব্রেক করেছিলেন, কিন্তু ৩২ র্যাকের গাড়িটি যথাসময়ে থামাতে পারেননি। মালবাহী গাড়িগুলোর ব্রেকও (ডিস্ট্রিবিউটর ভাল্ব) ঠিকমতো কাজ করেনি। যার কারণে এই দুর্ঘটনাটি ঘটে।”
রেলওয়ে চট্টগ্রামের (পুর্বাঞ্চল) বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী সাজিদ হাসান নির্ঝর স্বাক্ষরিত রোববারের চিঠিতে বলা হয়, টার্ন টেবিল (গোল একটা প্ল্যাটফরম, যার উপর ট্রেনের ইঞ্জিন উঠিয়ে ঘোরানো হয়) নষ্ট থাকায় ২৬০০, ২৯০০ ও ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনগুলোকে পেছনের দিক সামনে রেখে কাজ করতে হয়। অনেক স্থানে নিরাপদ দূরত্ব থেকে সিগন্যাল এবং লেভেল ক্রসিং দেখা যায় না। এতে সুষ্ঠুভাবে ট্রেন পরিচালনার ক্ষেত্রে লোকোমাস্টারদের বিভিন্ন সমস্যা ও ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
“বিশেষ করে ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনগুলো দৈর্ঘ্য বেশি হওয়ায় এই ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে যে কোনো সময়ে সিগন্যাল ওভারশ্যুট (এড়িয়ে যাওয়া) বা লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।”
ভৈরবের দুর্ঘটনার জন্য কনটেইনার ট্রেনটি পরিচালনাকারীদের দায়ী করে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “আমরা পেয়েছি ওই কনটেইনারবাহী ট্রেনটির চালক ও সহকারী চালক সিগন্যাল অমান্য করায় এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। তাদের দাঁড়ানোর কথা ছিল ভৈরব স্টেশনের আউটার সিগন্যালে।
“কিন্তু তারা সেটি না করে সিগন্যাল অমান্য করে ট্রেনটি চালিয়ে চলে আসে। একই সময় ভৈরব স্টেশন থেকে বের হয়ে ঢাকার পথে আসছিল যাত্রীবাহী এগার সিন্ধুর এক্সপ্রেস। চট্টগ্রামমুখী মালবাহী ট্রেনটির ইঞ্জিন একই লাইনে উঠে এগার সিন্ধুরের পেছন থেকে তৃতীয় বগিতে আঘাত করে।”
কোনো স্টেশনের আউটার হচ্ছে ট্রেনগুলোকে অপেক্ষায় রাখার জায়গা। অন্য ট্রেনকে জায়গা দিতে আউটার এলাকায় ট্রেন থামার সংকেত বাতি (সিগন্যাল) আগেই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে।
সেই সংকেত বাতি জ্বলেনি, নাকি কনটেইনার ট্রেনের চালক সংকেত দেখতে পাননি- এমন প্রশ্নের উত্তরে রেল কর্মকর্তা নাজমুল বলেন, “এটা তো তদন্তের বিষয়। তিনি সিগন্যাল দেখেননি, না অন্য কোনও কারণ ছিল- এসব খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি কাজ করবে।”
রেল চালকরা ইঞ্জিন উল্টো করে চালানোতে যে ঝুঁকির কথা বলছেন তা মানতে চাইছেন না রেলের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক নাজমুল।
তিনি বলেন, ৩০২৮ লোকোটিকে নতুনই বলা যায়। হুন্দাই রোটেম-ইএমডির তৈরি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এই লোকোগুলো সোজা ও উল্টো দু’দিক থেকেই চালানোর উপযোগী করে তৈরি করা।
“লোকোগুলোর সিস্টেমই হচ্ছে (চালক) যে পাশেই বসুক, তার দুই পাশেই দেখতে পারবে। এটা ঘোরানো বা না ঘোরানোর বিষয় না। এক পাশে সামনে বেশি জায়গা থাকবে, আরেক পাশে কম জায়গা থাকবে। দুই পাশে তো দুজন চালকের বসার ব্যবস্থা থাকছেই। ঘোরানো বা না ঘোরানোর বিষয়টা এখানে তোলা অযৌক্তিক।”
তবে সামনে শীত মৌসুম থাকায় উল্টো দিকে ইঞ্জিন চালাতে যে ‘সিগন্যাল ওভারশ্যুট’ ঝুঁকি বেড়ে যাবে তা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে রোববারের চিঠিতে।
এতে বলা হয়েছে, ৬০ ফুট লম্বা ইঞ্জিনের পেছনে বসে চালকের ঘন কুয়াশায় সিগন্যাল ও লেভেল ক্রসিং দেখা আরও কঠিন হয়ে উঠবে। তখন ট্রেনের সময়সূচিও ঠিক রাখা ‘অসম্ভব’ হয়ে পড়বে।
আরও পড়ুন-