ব্যবসায়ীরা বলছেন, “এইবার তেমন বিক্রি নেই। গত বছরের তুলনায় বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে।”
Published : 11 Apr 2023, 08:14 PM
আশা ছিল, ঈদকে ঘিরে পাইকারি পোশাকের ব্যবসা চাঙ্গা হবে। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দা আর বঙ্গবাজারের আগুনের প্রভাবে তাদের সে আশায় গুড়েবালি বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের তৈরি পোশাকের (হোসিয়ারি) পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, একদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও সেবাখাতের খরচ বেড়ে যাওয়াতে সারাদেশের খুচরা বাজারে পোশাক বিক্রি কমে গেছে; অন্যদিকে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে থাকা প্রায় শত কোটি টাকার বকেয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা। সব মিলিয়ে ‘মন্দা’ দেখা দিয়েছে জেলার পাইকারি পোশাকের বাজারে।
সারাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বড় একটি বাজার দখল করে রেখেছে নারায়ণগঞ্জ। হাত বাড়ালেই সুতা থেকে থানকাপড় সবই মেলে এই শহরে। ব্যবসায়ীদের ভাষায়, ‘মফস্বল’ ও ‘ফ্যান্টাসি’ উভয় ধরনের পোশাক তৈরি হয় এখানে।
তার মধ্যে জেলার সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাকের (হোসিয়ারি) পাইকারি বাজার শহরের দেওভোগ ও নয়ামাটি এলাকায়। এর বাইরেও শহরের টানবাজার, বন্দর উপজেলা ও সদরের কয়েকটি স্থান মিলিয়ে নারায়ণগঞ্জে রয়েছে পাইকারি পোশাক শিল্পের কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা।
এসব এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পাঁচ হাজারেরও বেশি হোসিয়ারি কারখানা। এইসব কারখানায় তৈরি পোশাক বিক্রি হয় রাজধানীসহ সারাদেশে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত শতাব্দীর বিশের দশকের শুরুর দিকে শীতলক্ষ্যার তীরঘেঁষা নারায়ণগঞ্জ শহরের টানবাজার, নয়ামাটি এলাকায় হোসিয়ারি শিল্পের গোড়াপত্তন ঘটে৷ ধীরে ধীরে এ অঞ্চলে এ ব্যবসার প্রসার ঘটতে শুরু করে৷
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে শহরের দেওভোগে গড়ে ওঠে তৈরি পোশাকের পাইকারি বাজার৷ প্রায় ২০০ শতাংশ জায়গার ওপর এ মার্কেটে পাঁচ শতাধিক দোকান রয়েছে, কারখানা আছে শতাধিক৷ মার্কেটটিতে মেয়েদের পোশাক বেশি বিক্রি হয়৷ তবে ছেলে শিশুদেরও পোশাক তৈরি ও বিক্রি হয়৷
শহরের তৈরি পোশাকের বৃহৎ পাইকারি বাজার দেওভোগ মার্কেটের ব্যবসায়ী রিপন হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকার সদরঘাট, বঙ্গবাজারসহ ঢাকার বাইরে মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমাদের মাল কেনেন ব্যবসায়ীরা। পরে তারা পাইকারি ও খুচরা মূল্যে এসব বিক্রি করেন।”
দেশের অন্যান্য স্থানের পাইকারী ব্যবসায়ীরাও নারায়ণগঞ্জ থেকে তৈরি পোশাক কম কিনছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “রমজানের ঈদকে ঘিরে ব্যবসা চাঙ্গা হয়। শবে বরাতের আগে থেকে ঈদের পোশাক বিক্রি শুরু হয়, চলে রমজান মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। কিন্তু এইবার তেমন বিক্রি নেই। গতবছরের তুলনায় বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে।”
আরপি গার্মেন্টসের সত্ত্বাধিকারী আব্দুল মতিন নিজের দোকানের মালামাল দেখিয়ে বলেন, “এইবার হঠাৎ কইরা মার্কেট খারাপ হইয়া গেছে। খুচরা বাজারে চাহিদা কম। এই কারণে পাইকাররাও কম কিনতেছেন। দেখেন না এখনও গোডাউন ভর্তি মালামাল। অন্যবার এই সময় আসলে দেখতেন সব খালি হইয়া গেছে। নতুন অর্ডারের কাজ করতে হইতো।”
কথা বলতে বলতেই এক ক্রেতার সঙ্গে দরদাম নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন আব্দুল মতিন।
ওই ক্রেতা জানালেন, তার নাম আনোয়ার হোসেন। মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে তার দোকান আছে। দেওভোগ থেকে পোশাক কিনে তা নিজের দোকানে বিক্রি করেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে আনোয়ার বলেন, “ঈদের বাজারে প্রতি সপ্তাহে দুইদিন মাল কিনতে আসতে হতো। এইবার বিক্রি কম। দেড় মাস আগে যেই মাল নিছি তাও শেষ হয় নাই। তারপরও ভাবলাম রোজার শেষদিকে বিক্রি ভালো হইতে পারে। এই কারণে কিছু মাল নিতে আসছি।”
একই মার্কেটের এইচ কে ফ্যাশনের পরিচালক হাসিবুর রহমান বলেন, “এক পার্টি ঈদকে ঘিরে একাধিকবার আসেন মাল কিনতে। একবার মাল নেওয়ার সময় অতিরিক্ত অর্ডারও দিয়ে যান। কিন্তু এইবার একবার যে মাল কিনে নিছেন তাই নাকি বিক্রি হচ্ছে না।
“চারদিকে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় ঈদের মার্কেটিংয়ে খুচরা ক্রেতা কম বলে জানাচ্ছেন তারা। এই কারণে আমাদের বিক্রিও কম। ঈদের মৌসুমে কোটি টাকার ব্যবসা করি। কিন্তু এইবার তার অর্ধেকও হয় নাই।”
এদিকে নারায়ণগঞ্জে তৈরি পোশাকের বড় একটি অংশ যায় বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে। সারা বছর বাকিতে মালামাল বিক্রি চলে। ঈদকে সামনে রেখে এই বিক্রি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তবে ঈদের আগেই পুরো বছরের বকেয়া হিসাব মিটিয়ে দেওয়া হয়।
এবারও বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে প্রায় শত কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে নারায়ণগঞ্জের কয়েকশ ব্যবসায়ীর। ঈদের আগে এইসব বকেয়া পরিশোধের কথা থাকলেও আগুন এখন তা আর্থিক সংকটে ফেলে দিয়েছে নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীদেরও।
নয়ামাটির মার্ক ফ্যাশনের সত্ত্বাধিকারী রফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের বিক্রি চলে ১৫ রোজা পর্যন্ত। এরপর বকেয়া তোলার তাগাদা চলে। ঈদের তিনদিন আগেই অধিকাংশ বকেয়া পরিশোধ হয়ে যায়। আমরাও স্টাফদের বিদায় দিয়ে দেই চাঁদরাতের আগে।
“কিন্তু একে তো এইবার বাজার খারাপ। তার উপর বঙ্গবাজারের যেসব ব্যবসায়ীর কাছে বকেয়া আছে তাও তুলতে পারতেছি না। তাগো কাছে চাওয়ারও পরিস্থিতি নাই।”
“এইখানে ছোট-বড় অনেক ব্যবসায়ী আছেন। তারা সারাবছর তাদের পুঁজি খাটায়। ঈদই তাদের জন্য হালখাতা। এই সময় সব বকেয়া তোলা হয়। কিন্তু যারা যারা বঙ্গে মাল দিছেন তারা পড়ছেন ঝামেলায়। টাকা তুলতে পারতেছেন না, আবার চাইতেও পারতেছেন না,” বলেন অপর ব্যবসায়ী আশিকুর রহমান।
সোমবার বিকালে দেওভোগ মার্কেটে আল-মুজিব গার্মেন্টস নামে প্রতিষ্ঠানটিতে বসে কথা হয় ব্যবসায়ী মো. সেলিমের সাথে। তিনি বলেন, “বঙ্গবাজারে ৩০ জন পার্টির (পাইকারি ক্রেতা) কাছে প্রায় এক কোটি টাকা পাবো। এখন তাদের এই দুর্দিনে টাকা চাইতেও পারতেছি না। কিন্তু টাকা না পাইলে ঈদের আগে আমি আমার কর্মচারীদের বিদায় করমু কেমনে?”
“শুধু আমি না এই মার্কেটের আরও ২০-২৫ জন ব্যবসায়ীর অন্তত ৪০ কোটি টাকা বকেয়া আছে বঙ্গবাজারে। অনেকেই গেছেন বঙ্গবাজারে। পাওনা টাকা তোলার ব্যাপারে কিছু করা যায় কি-না তা জানতে।
“সবাই জানে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরাই ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু তাদের চেয়ে বেশি ক্ষতি হইছে আমাদের।”
বঙ্গবাজারে ৫০ হাজার থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত বকেয়া রয়েছে বলে জানান শহরের টানবাজারের হাবিব শপিং কমপ্লেক্স, রিভার ভিউ মার্কেট ও ফারজানা টাওয়ারের কয়েকজন ব্যবসায়ী।
হাবিব শপিং কমপ্লেক্সের তৃতীয় তলার ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০১৪ সাল থেকে ব্যবসা করি। করোনাভাইরাসের ধকল কাটানোর পর গতবছর একটু ভালো ব্যবসা করছি। এইবার ব্যবসা মন্দা যাইতেছে।”
একই মার্কেটের শহীদুল ইসলাম বলেন, “লাখ দশেকের মতো তিন-চারটা পার্টির কাছে বকেয়া। তাগো সবার দোকান ছিল বঙ্গে। এখন তাগোরে তো মাথায় বাড়ি দিয়া টাকা চাইতে পারি না।
“এদিকে আমারও শ্রমিক বিদায় করতে হইবো, থানকাপড় কিনছি, ওইখানে টাকা পাইবো। সব মিলাইয়া জটলা লাইগা গেছে।”
এবার বাজার ‘মন্দা ’বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ হোসিয়ারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাজমুল আলম সজলও।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “নারায়ণগঞ্জে পাঁচ হাজারেরও বেশি হোসিয়ারি কারখানা আছে। কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা এইখানে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধসহ নানা কারণে দেশে অথনৈতিক মন্দা চলছে। ঠিকমতো আনুসাঙ্গিক মালামাল ইমপোর্ট করা যাইতেছে না। তার উপর সবকিছুর দাম বাড়তি। এই নিয়া গতবছরের তুলনায় ব্যবসা একটু খারাপই।”
বঙ্গবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সাথে নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীদের লেনদেন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এইটা নিয়া রোববার আমরা মিটিং করছি। কে কার কাছে কতো টাকা বকেয়া এইটার একটা তালিকা করতেছি। তালিকা করার পর বিকেএমইএ ও এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে বসে আমরা একটা সমাধান বের করার চেষ্টা করবো। বকেয়া সব হয়তো পাবে না কিন্তু কিছু তো পাওয়ার ব্যবস্থা করতেই হবে।”
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকারের সহযোগিতাও কামনা করেন এই ব্যবসায়ী নেতা। তিনি বলেন, “এই সরকার ব্যবসাবন্ধব সরকার। এই পরিস্থিতিতে তারাও যদি সহযোগিতা করেন তাহলে ব্যবসায়ীরা কোনোমতে পুষিয়ে নিতে পারবে। আশা করছি, সরকার এই ব্যাপারে কিছু ভাবতেছেন।