ওই ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে পুলিশ সুপারকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইসি রাশেদা সুলতানা।
Published : 24 Dec 2023, 12:06 AM
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে এক ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার দগ্ধ হওয়ার ঘটনা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
হাসপাতালে তিন দিন ধরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার দুপুরে মারা যান ফজলু শেখ নামের ৪৫ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি। তবে ফজলু কোথায়, কীভাবে দগ্ধ ও জখম হন তা নিয়ে শুরুতে ধন্দে পড়ে ঢাকার পুলিশ। নিহতের স্বজনরাও তার দগ্ধ হওয়ার ঘটনা বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
তার জামাতা রকি শুক্রবার জানান, কীভাবে তার শ্বশুর আহত হন তা তারা জানতে পারেননি। কে তাকে হাসপাতালে আনে তাও তারা জানেন না।
“আমার শাশুড়ি রাশিদা সংবাদ পান, শ্বশুর দুর্ঘটনায় আহত অবস্থায় ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি। শাশুড়ি এসে গুরুতর অবস্থায় স্বামীকে দেখতে পেয়ে কান্নাকাটি করতে করতে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে ফাঁকে হাসপাতালে ফজলুকে নিয়ে আসা লোকজন কেটে পড়ে।”
শরীরের অনেকটা পুড়ে যাওয়া ফজলুর মৃত্যুর পর হাসপাতাল থেকে যে সনদ দেওয়া হয় সেখানে মৃত্যুর কারণ হিসেবে ‘বোম্ব ব্লাস্ট’ লেখা রয়েছে।
তবে পুলিশ ঘটনাস্থল খুঁজে পাচ্ছিল না জানিয়ে শুক্রবার শাহবাগ থানার ওসি মোস্তাজিরুর রহমান জানিয়েছিলেন, গত মঙ্গলবার ক্ষতসহ দগ্ধ অবস্থায় ওই ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করেন এক ব্যক্তি। হাসপাতালে ফজলুর পরিচয় দেওয়া হয়েছিল ‘ঝালমুড়ি বিক্রেতা’, অস্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছিল ঢাকার সাভার।
“যে ব্যক্তি তাকে ভর্তি করিয়েছেন, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায়, কীভাবে ফজলু শেখ আহত হয়েছেন তা জানা যাচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে এটুকু নিশ্চিত হয়েছি যে, ঘটনাস্থল রাজধানী বা সাভারেও নয়।”
পরে শনিবার ওসি জানান, সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে বোমা বিস্ফোরণে ফজলু আহত হয়েছিলেন।
“আহত আরেক ব্যক্তির বিষয়েও আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। নিহত ফজলুর বিরুদ্ধে খুন ও ডাকাতিসহ তিনটি মামলা রয়েছে।”
ঘটনাস্থল বেলকুচি থানা হওয়ায় ওই থানায় এ বিষয়ে মামলা হওয়ার কথা। তবে শাহবাগ থানার ওসি মোস্তাজিরুর বলেন, “বেলকুচি থানার পুলিশ এ বিষয়ে কোনও আগ্রহ দেখায়নি।”
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান জানান, নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের ঊধ্বতন কর্মকর্তারা শনিবার সিরাজগঞ্জে আসেন। সেই কারণে ব্যস্ত থাকায় তারা ঢাকার পুলিশের সঙ্গে ঠিকমতো সমন্বয় করে উঠতে পারেননি।
তবে ঢাকার প্রক্রিয়া শেষ করে স্বজনেরা সিরাজগঞ্জে এসে অভিযোগ দিলে মামলা নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।
কী ঘটেছিল বেলকুচিতে
গত মঙ্গলবার দুপুরে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার সুবর্ণসাড়া গ্রামের সরকার বাড়িতে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ পান স্থানীয়রা।
বেলকুচি পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারেক রহমান জানান, বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর কৌতূহলী লোকজন ওই বাড়িতে যান। তবে বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তাৎক্ষণিক আহত দুই ব্যক্তিকে একটি কালো রঙের মাইক্রোবাসে দ্রুত সরিয়ে নিতে দেখেছেন স্থানীয়রা। তবে তাদের সর্ম্পকে কাউকে কিছুই জানানো হয়নি। সরকার বাড়ির পাকা ভবনের যে কক্ষে বিস্ফোরণ হয়েছে সেটি দ্রুত মেরামত করে ফেলা হয়।
ওই বাড়ির প্রধান মোতালেব হোসেন সরকার শ্রমিক লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে স্থানীয়ভাবে পরিচিত। তিনি সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের নৌকার প্রার্থীর পক্ষে জোরেশোরে কাজ করছিলেন।
মঙ্গলবার বিস্ফোরণের পর মোতালেব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “আমরা নৌকার সমর্থক। প্রচার কাজে ব্যস্ত আছি। মঙ্গলবার দুপুরে বাড়ির মহিলারা রান্নার সময় হঠাৎ বিকট শব্দে প্রেশার কুকার বিস্ফোরিত হয়েছিল। বিষয়টি রংচং লাগিয়ে বোমা বিস্ফোরণের গুজব ছড়ানো হচ্ছে, আসলে তা সত্য নয়।”
তবে ফজলু শেখের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে মোতালেব গা ঢাকা দিয়েছেন, তার ফোনও বন্ধ।
মোতালেবের বাড়িতে বিস্ফোরণের পর দুজনকে আহত অবস্থায় বের হতে দেখেছিলেন স্থানীয়রা। দগ্ধ দুজনের মধ্যে জিন্নাহ আলী (৪৫) নামের এক ব্যক্তিও ছিলেন বলে তাদের ভাষ্য।
তবে জিন্নাহ এখন কোথায় আছে, সে বিষয়ে কিছু জানা সম্ভব যায়নি। জিন্নাহ সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার সৌদিয়া চাঁদপুর গ্রামের তাছের আলীর ছেলে।
ঘটনার দিন বেলকুচি থানার ওসি আনিসুর রহমান জানিয়েছিলেন, ঘটনার খবর শুনে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। তবে তাদেরকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তাই কোনো আলামতও সংগ্রহ করতে পারেনি পুলিশ।
‘মোতালেব বোমা বানাতে ফজলুকে নিয়ে যায়’
নিহত ফজলুর স্বজনরা জানিয়েছেন, ফজলুর বাড়ি কুষ্টিয়া সদরের মিলপাড়া গ্রামে, বাবার নাম তোফাজ্জল শেখ।
ফজলুর বড় ভাই মজনু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কুষ্টিয়ায় বাড়ি হলেও ফজলু দীর্ঘদিন ধরে রাজবাড়িতে থাকতেন। পাঁচ মাস আগে একটি মামলায় সিরাজগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার হলে ওই সময় পুলিশ তাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল।
“আমরা গত বুধবার জানতে পারি, ফজলু বোমায় আহত হয়েছে। হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারি, মোতালেব নামে এক শ্রমিক লীগ নেতা আমার ভাইকে বোমা বানানোর জন্য সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। সেই বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে আমার ভাই আহত হয়। ঘটনার পর ফজলুর কোনো খোঁজ কাউকে জানায়নি মোতালেব।”
ফজলুর ছোট ভাই বিপুল শেখও একই ধরনের কথা বলছেন। তার ভাষ্য, “মোতালেব নামে সিরাজগঞ্জের এক আওয়ামী লীগ নেতা বোমা বানানোর জন্য আমার ভাই ফজলুকে নিয়ে গিয়েছিল। তার জন্যই আমার ভাই মারা গেছে। আমরা মোতালেবের বিচার চাই।”
ফজলুর স্বজনদের অপেক্ষায় স্থানীয় পুলিশ
কারও অপমৃত্যু হলে আইন অনুযায়ী মৃতদেহের বাহ্যিক বিবরণ ও প্রাথমিক ঘটনা উল্লেখ করে পুলিশ যে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে সেখানেও বলা হয়েছে, বোমা বিস্ফোরণে ফজলুর মৃত্যু হয়েছে।
ঢাকায় ফজলুর মৃতদেহের ‘সুরতহাল প্রতিবেদন’ তৈরি করেছেন শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক সানারুল হক।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৯ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে সুবর্ণপুর (সুবর্ণসাড়া হবে) গ্রামে মোতালেবের বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণে ভিকটিম ফজলু শেখ গুরুতর আহত হন। ওইদিন বিকেল ৪টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২২ ডিসেম্বর (শুক্রবার) তার মৃত্যু হয়।
শনিবার সিরাজগঞ্জে নির্বাচন সংক্রান্ত সভা করতে এসেছিলেন নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা।
জেলা প্রশাসন, পুলিশ, প্রার্থী ও প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা শেষে বোমা বিস্ফোরণের বিষয়ে সাংবাদিকরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “বোমা বিস্ফোরণে একজনের মৃত্যুর বিষয়টি আমি জেনেছি। সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপারকে বিষয়টি তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”
সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান বলেন, “ঢাকার প্রক্রিয়া শেষ করে স্বজনেরা সিরাজগঞ্জে এসে অভিযোগ দিলেই আমরা মামলা নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।”
যদি স্বজনরা মামলা করতে না চান, সেক্ষেত্রে পুলিশ কী করবে-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “সেটারও একটা প্রক্রিয়া আছে। তবে আমরা আগে স্বজনদের জন্য অপেক্ষা করব।”
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক গোলাম মর্তুজা অন্তু)