স্থানীয়দের অভিযোগ, ভরাটকারীরা রাতের আঁধারে নানা কৌশলে একটু একটু করে পুকুরে মাটি ফেলছে।
Published : 28 Jun 2023, 06:42 PM
পুকুর-জলাশয়ের শহর হিসেবে কুমিল্লার খ্যাতি দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে। প্রায় দুই দশক ধরে কুমিল্লা নগরীতে একের পর এক পুকুর ও ডোবা ভরাট হয়ে গেছে।
এবার ভরাট করা হচ্ছে প্রায় ২৫০ বছরের পুরনো একটি পুকুর; স্থানীয়দের কাছে যেটি ‘হাতিপুকুর’ নামে পরিচিত।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের দ্বিতীয় মুরাদপুর এলাকায় অবস্থিত ‘হাতিপুকুর’ ভরাট বন্ধ এবং রক্ষার দাবিতে এরইমধ্যে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে স্থানীয়রা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিবাদের পরও ভরাটকারীরা রাতের আঁধারে নানা কৌশলে একটু একটু করে পুকুরে মাটি ফেলছে।
এলাকাবাসী জানায়, গত ৫ জুন দুপুরে কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের আলোচনা সভা চলছিল। সভা চলাকালে হঠাৎ হাতিপুকুর ভরাটের প্রতিবাদ ও পুনরায় পুকুরটি খনন করে জনসাধারণের জন্য অবমুক্ত করার দাবিসম্বলিত ব্যানার নিয়ে সভাকক্ষে ঢুকে পড়েন অন্তত ৫০ জন নারী-পুরুষ।
তারা ‘পুকুর ভরাট বন্ধ করো, করতে হবে’ ও ‘ভূমিদস্যুদের হাত থেকে পুকুর ভরাট বন্ধ করো’ লেখা প্ল্যাকার্ড বহন করছিলেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও পরিবেশকর্মীরা সভায় উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় জেলা প্রশাসক প্রতিবাদকারীদের পরে আসার অনুরোধ করেন। পরে দ্বিতীয় মুরাদপুর এলাকার বাসিন্দারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দক্ষিণ পাশের প্রবেশদ্বারে অবস্থান নেন। এক পর্যায়ে তারা জেলা প্রশাসকের দপ্তরে নিচতলায় মানববন্ধন করেন। এছাড়া পুকুরটি রক্ষার দাবিতে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেন তারা।
সরেজমিনে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাতিপুকুরে জায়গার পরিমাণ ২ একর ৩৭ দশমিক ৫ শতক। বর্তমানে পুকুরের দক্ষিণ অংশের ১ একর ৩২ দশমিক ৫ শতকের মালিক কুমিল্লা বঙ্গবন্ধু আইন কলেজের অধ্যক্ষ আইনজীবী আলী আজাদের পরিবার। আর উত্তর অংশের ১ একর ৫ শতক জায়গার বর্তমান মালিক নগরীর ১৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও রাজগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী আবদুল জলিলের পরিবার।
স্থানীয়দের অভিযোগ, গত কয়েকদিনে পুকুরের উত্তর অংশের ১২ শতকের বেশি জায়গা ভরাট করা হয়েছে। এর আগেও পুকুরের কিছু অংশ ভরাট করে দোকানপাট করা হয়েছিল।
উত্তর অংশের মালিক আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল সাংবাদিকদের বলেন, পুকুরটি তাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি। কয়েক বছর আগে পুকুরের উত্তর অংশে ময়লা ফেলতে শুরু করে স্থানীয় এলাকাবাসী। তখন সেখানে ময়লার স্তূপ পড়ে গেলে তারা সেখানে দোকান করেন। আর বর্তমানে এখন তারা পুকুরের পাড় বাঁধছেন, ভরাট করছেন না।
একটি রাজনৈতিক দলের ‘কিছু ছেলেপেলে’ মিলে এই আন্দোলন করছে দাবি করে তিনি বলেন, “ওরা আমার কাছে ৪০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে। ৪০ লাখ টাকা দিলে ভরাট করতে পারব বলে জানিয়েছে। আমি রাজি না হওয়াতে অপপ্রচার চালাচ্ছে।”
পুকুর ভরাটে ক্ষুব্ধ দ্বিতীয় মুরাদপুর এলাকার বাসিন্দা লিটন মিয়া, রাশেদা বেগম, নাইম মিয়াসহ কয়েকজন জানান, এই পুকুরটি ২৫০ বছরের পুরনো। প্রাচীনকাল থেকে পুকুরের পানি দিয়ে রান্না করে আসছিল প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠী। এ পুকুরে গোসল করেছেন তারা।
তাদের অভিযোগ, ছয় মাস আগে পুকুর সেচে (পানি অপসারণ করে) রাতে কৌশলে ভরাটের কাজ শুরু হয়। ধীরে ধীরে ভরাট করা হয় পুকুরের বেশকিছু অংশ। তাই এলাকাবাসী পুকুর ভরাট বন্ধের দাবিতে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে গিয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, মানুষের পানির কষ্ট দূর করতে প্রায় ২৫০ বছর আগে ত্রিপুরার রাজারা পুকুরটি খনন করেছিলেন। পরবর্তীতে কালক্রমে পুকুরটি লিজ দেওয়া হতো। ধীরে ধীরে একটি চক্র পুকুরটি নিজেদের নামে করে ফেলে। প্রাচীনকাল থেকে পুকুরটি স্থানীয় হাজার হাজার মানুষের পানির চাহিদা মিটিয়ে আসছিল। দীর্ঘদিন ধরে ময়লা ফেলে পুকুরের পানিকে দূষিত করা হয়েছে। বর্তমানে পুকুরের উত্তরপূর্ব কোণের অনেক অংশ রাতের আঁধারে ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। সেই স্থানে রাতারাতি টিনের বেড়া ও ঘর উঠিয়ে এবং বড় বড় গাছের চারা লাগিয়ে বোঝানো হচ্ছে এই অংশটি পুকুরের অংশ নয়; অনেক আগ থেকেই ভরাট হওয়া। পুকুরের দক্ষিণ পূর্ব কোণের বেশ কিছু অংশও ভরাট করা শুরু হয়েছে।
পুকুরের পশ্চিম পাড়ের বাসিন্দা ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধা আঞ্জুমা বেগম বলেন, “আমার স্বামী আর বাবার বাড়ি এখানেই। আমার বাবা-দাদা এই পুকুরে গোসল করতেন। আমার স্বামীও এখানে গোসল করতেন। তবে এখন আমার ছেলে-মেয়েরা গোসল করার মতো পরিস্থিতি নেই। ময়লা পানিতে কেউ নামলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর এখন তো পানি সরিয়ে পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। আমাদের কান্না কেউ শোনে না।”
পুকুরের দক্ষিণ পাড়ের বাসিন্দা বেলা রাণী সাহা বলেন, কয়েক মাস আগে পাশের তেলিকোনা এলাকায় আগুন লাগে। পরে হাতিপুকুরের পানি নিয়ে সেই আগুন নেভানো হয়। সেদিন পুকুরটি না থাকলে পুরা এলাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ত।
“আমরা বাঁচতে চাই। আমরা ঐতিহ্যবাহী পুকুরটির অস্তিত্ব রক্ষা চাই।”
পুকুরপাড়ের বাসিন্দা ইকবাল হোসেন, গোলাম হোসেন ও রফিকুল ইসলাম জানান, স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল এই পুকুর ভরাট করছে। তাদের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। গত ৫ তারিখ তারা নিরুপায় হয়ে ডিসি অফিসে ঢুকে পড়েছিলেন।
পরিবেশ অধিদপ্তর, কুমিল্লার উপ-পরিচালক মোসাব্বের হোসেন মুহাম্মদ রাজীব বলেন, “এভাবে পুকুর ভরাটের কোনো সুযোগ নেই। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। কোনোভাবেই পুকুর ভরাট করতে দেওয়া হবে না। কেউ ভরাট করতে চাইলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব। প্রয়োজনে ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।”
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), কুমিল্লার সভাপতি মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “গত ৫ জুন পরিবেশ দিবসের আলোচনা সভা চলছিল। হঠাৎ হাতিপুকুর রক্ষার দাবি নিয়ে কিছু লোক ডিসি সাহেবের সম্মেলনকক্ষে ঢুকে পড়েন। পরে তাদের বুঝিয়ে বের করা হয় সেখান থেকে। আমরা চাই পুকুরটি রক্ষায় যেন দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, “কুমিল্লা পুকুর ও দিঘির শহর। এগুলো আমাদের রক্ষা করতে হবে। এই পুকুরটি রক্ষার জন্য স্থানীয়রা স্মারকলিপি দিয়েছেন। আমরা বিষয়টি দেখছি। বেআইনিভাবে পুকুর ভরাট করতে দেওয়া হবে না।”
জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জারি করা এক আদেশে বলা হয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, জনগণের আশ্রয়স্থল রক্ষা ও অগ্নিনির্বাপণে সহায়তা করতে কোনো অবস্থায় খাল-বিল, পুকুর-নালাসহ প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট করা যাবে না এবং এর গতিপথ পরিবর্তন করা যাবে না।
‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন, ২০১০’ অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জলাধার বা পুকুর ভরাট সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং ভরাটকারীর বিরুদ্ধে আইনের ৭ ধারায় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট করে পরিবেশগত ক্ষতি ও বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রয়েছে।
জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী কোনো পুকুর-জলাশয়, নদী-খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। ওই আইনের ৫ ধারামতে জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণিও পরিবর্তন করা যাবে না।
মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০ এর ৫ ধারায় এ নিষেধের কথা বলা আছে।
‘৫৷ এই আইনের বিধান অনুযায়ী ব্যতীত, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসাবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণী পরিবর্তন করা যাইবে না বা উক্তরূপ জায়গা অন্য কোনভাবে ব্যবহার করা যাইবে না বা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনভাবে হস্তান্তর করা যাইবে না৷’