এ অবস্থায় প্রশাসনের কাছে জীবনের নিরাপত্তা ও আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছেন স্থানীয়রা।
Published : 15 Dec 2022, 09:35 PM
নেত্রকোণার গারো পাহাড় জনপদ বন্যহাতির আক্রমনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ি এলাকা নেত্রকোণার দুর্গাপুর উপজেলা।
গত এক সপ্তাহ ধরে উপজেলার পাহাড়ি জনপদে সন্ধ্যা থেকে ভোর নাগাদ চলে দলবদ্ধ বন্যহাতির তাণ্ডব। এরই মধ্যে হাতির তাণ্ডবে একজন নিহত এবং ৩৫টি ঘর আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, গত ৭ ডিসেম্বর হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা গেছেন পশ্চিম বিজয়পুর গ্রামের বোনেশ রিচিল (৭৫) নামের এক কৃষক।
এ ছাড়া ধান ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষয় সাধন হয়। হাতি থেকে বাঁচতে ওই জনপদের মানুষ আতংকের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
এ অবস্থায় স্থানীয়রা প্রশাসনের কাছে জীবনের নিরাপত্তা ও আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছেন।
প্রশাসন বলছে, তারা এলাকাবাসীর পাশে আছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার কুল্লাগড়া ও সদর ইউনিয়নের আড়াপাড়া, বিজয়পুর ও ভবানীপুর গ্রামসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে মেঘালয়ের পাহাড় থেকে বন্য হাতির দল এসে তাণ্ডব চালিয়ে প্রাণহানী, ফসল ও ঘর-বাড়ির ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে।
হাতির তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে কেউ খোলা আকাশের নীচে, আবার কেউ কেউ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন।
আতঙ্কগ্রস্তরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতে মশাল জ্বালিয়ে ফসল ও বাড়ি-ঘর রক্ষার চেষ্টা করছে। প্রশাসনের কাছে জান-মালের নিরাপত্তাসহ সার্বিক সহযোগিতা চেয়েছেন এলাকাবাসী।
কুল্লাগড়া ইউনিয়নের আড়াপাড়া গ্রামের সাবিনা রংদি।
দুই মেয়েসহ চারজনের সংসার। গ্রামের টিলার পাশ ঘেঁষে টিনের চালা তোলে একটি ঘরে বসবাস করে আসছিলেন।
গত ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর বন্য হাতির দল এসে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে তার বসতঘরটি।
গত রোববার (১১ ডিসেম্বর) বিকালে বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায়, উঠানসহ আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঘরের ভাঙা সব জিনিসপত্র। চালের টিন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। দিনমজুর স্বামীকে নিয়ে তছনছ হওয়া ঘরের জিনিসপত্র গুছিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন সাবিনা রংদি।
এ সময় তিনি বলেন, “আমাদের একটাই থাকার ঘর। সব ভাইঙ্গাচুইর্যা ফালাইছে। হাড়িপাতিল, ডেগ, রান্নাবান্নার জিনিস, খাট সবই ভাংছে। বাড়িতে থাকার মতো কোনো বাও নাই।রাস্তার মধ্যে গিয়া দাঁড়াইয়া থাকতাছি।
“রাইতবিইতে হাতির দল আসে, ভাইংগা দিয়া যায়। প্রত্যি রাইতেই আসে। খাইবো কী আর রান্দুম কী? সময় পাই না। হাতি আইতে থাকে। বাচ্চাকাচ্চা নিয়া দৌড় দিতে অয়। রাইতে শীতের মধ্যে পোলাপাইন লাইয়াই দৌড় দেয়ন লাগতাছে। আমরা এহন কী করমু?”
পাশের বাড়ির অনিতা রংদির সাত সদস্যের পরিবার। একই কথা তিনিও বলেন। তার ঘরও একই রাতে গুড়িয়ে দেয় হাতির দল। তার পর থেকেই খোলা আকাশের নীচে থাকছেন।
তিনি বলেন, “সইন্ধ্যা নামলেই ডরে ডরে থাহি। আমরার আতংক আর শেষ অইতাছে না। রোজই হাতি নামতাছে। হেরা আইলেই আমরা দৌড়ে পালায়া যাই।”
বিরবি দাসের বাড়ি একই গ্রামের টিলায়। স্বামী-সন্তান নিয়ে চারজনের সংসার। তার বাড়িটির এখন আর ভিটে ছাড়া কোনো চিহ্ন নেই।
টিলার ঢালে ভাংচুর অবস্থায় ছড়িয়ে আছে ঘরের আসবাবপত্র-চালের টিন, বাঁশ, কাঠ।
সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বিরবি দাস ছোট একটি হাঁড়িতে ভাত রান্নার চাল চড়িয়েছেন। কথা হয় তার সঙ্গে।
তিনি জানান, এবার তিনি অন্যের জমি বর্গাচাষ করে ২০ মণ ধান ঘরে তুলেছিলেন। তার সারা বছরের খোরাক।
এক রাতে বন্যহাতি এসে তার ধান খেয়ে সাবাড় করে দিয়ে গেছে; কিছুই রাখেনি।
একটি এনজিও ত্রাণ হিসেবে চাল দিয়ে যায়। আরেক রাতে এসে হাতি সেগুলোও খেয়ে গেছে।
কথা শেষ হতে না হতেই খবর আসে হাতির দল আসছে। তখন সব ফেলে আমাদের নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে বেশ খানিকটা দূরের পাকা রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ান বিরবি। চুলায় চড়ানো চাল শূন্য ভিটেতেই পড়ে আছে।
গ্রামটির ত্রিনলা দারিং বলেন, “অন্যান্য বছর মাঝে-মধ্যে হাতি আইয়া ক্ষেতের ধান খাইয়া যায়। আর এইবার হাতির দল ক্ষেতের ধান খাইয়া শেষ কইরা এহন বাড়ি-ঘরে ঢুইকা ক্ষয়-ক্ষতি করতাছে। বাড়িত থাহা ধান, চাউলসহ যা পায়, সবই খাইয়া যাইতাছে। বাড়ি-ঘরও ভাংচুর কইরা শেষ কইরা দিয়া যাইতাছে।”
গ্রামের আরেক নারী হ্যাপী রিচিং-এর ভাষ্য, “ভারতের মেঘালয়ের জঙ্গলের পাশে বাংলাদেশের ভেতরে আমাদের বাড়ি-ঘর। খাওনের সন্ধানে ভারতের বন থেইকা দলের দল হাতি নামতাছে। একেকদিন ৭০ থেকে ৮০টা হাতি দল বাইন্ধ্যা নামতাছে। ক্ষয়-ক্ষতি করতাছে।
“আমরা এলাকার সব মানুষ সারা রাইত সজাগ থাইক্যা পাহাড়া দিতাছি। মশাল জ্বালাইয়া, ভেপু বাজাইয়া ,পটকার শব্দ কইর্যা হাতি তাড়ানোর চেষ্টা করতাছি। আতংক আমরার পিছন ছাড়তাছে না। প্রশাসনের লোকজন আইছিল একদিন। ইউএনও সাব আইসা দুই হাজার কইর্যা ট্যাকা আর দুইটা কইর্যা কম্বল দিয়া গেছে। আমরার নিরাপত্তা নাই; নিরাপত্তা চাই।”
বিজয়পুরের কমলাবাগান এলাকার জামাল মিয়ার বাড়িতেও বন্যহাতির আক্রমণ।
তার ভাষায়, “রাইত ৮টার দিকে ঘরের ভিতরে আমি, বউ আর আমার সন্তান। হঠাৎ হাতি আইস্যা বাড়ি ভাংতে শুরু করছে। তহন জীবন বাঁচাইতে ঘরের জানালা দিয়া বাইর হয়া কোনো রকমে বউ-পোলাপান লইয়া জীবনডা বাঁচাই।”
দুর্গাপুর রেঞ্জ কার্যালয়ের বন কর্মকর্তা মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, “খাদ্যের সন্ধানে ভারত থেকে হাতি নেমে আসছে। এলাকাবাসীর সঙ্গে বন বিভাগের কর্মীরা কাজ করছেন। হতাহত, বাড়ি ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা দিতে আইন আছে। সে অনুযায়ী তাদের সহযোগিতা করা হবে।”
দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ রাজীব-উল-আহসান বলেন, “প্রাথমিক তথ্য মতে ৩৫টি ঘর আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত ৭ ডিসেম্বর হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা গেছেন পশ্চিম বিজয়পুর গ্রামের কৃষক বোনেশ রিচিল (৭৫)।
“হাতি ২০০ মণ ধান খেয়েছে। এ ছাড়া ক্ষেতের কাঁচা ধান খেয়েছে প্রচুর। ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ সহায়তাসহ নিরাপত্তা বিধানে সচেতনতা কাজ করা হচ্ছে। প্রথমে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে দুই হাজার করে টাকা ও দুটি করে কম্বল দেওয়া হয়।”
“মৃতের সৎকারের জন্য ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ২ লাখ টাকা আর ২ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ এসেছে। এগুলো বিতরণ করা হচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় কাজ করছেন,” বলেন ইউএনও।
দুর্গাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ঝুমা তালুকদার বলেন, “এবার এতো বেশি হাতি এসে উপদ্রব করছে যা আগে কখনও দেখিনি। এটা নতুন অভিজ্ঞতা। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা সমন্বয় রেখে হাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করা হচ্ছে।”