“সবাই খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমাতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখনি পাড়ার কাছ থেকে গোলাগুলির আওয়াজ আসে।”
Published : 08 Apr 2023, 01:14 AM
বান্দরবানের পাহাড়ে দুটি সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে গোলাগুলি ও আট লাশ উদ্ধারের ঘটনায় খিয়াংদের এক পাড়ার বাসিন্দারা ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে নিজেদের জীবন বাঁচাতে ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার রাতে রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলার মাঝামাঝি খামতাং পাড়ায় গোলাগুলি শুরুর পরপরই অন্তত ৮০টি পরিবারের আড়াইশ মানুষ অন্ধকারে যে যেভাবে পারে বাড়িঘর ছেড়ে পাশের জঙ্গলে, গির্জায় গিয়ে আশ্রয় নেন। তাদের অধিকাংশই সেখানে রাত কাটান বলে জানান পাড়ার কারবারি (পাড়া প্রধান)।
শুক্রবার ভোরের আলো ফোটার পর তারা কাছের উপজেলা সদরে গিয়ে ওঠেন। তাদের অধিকাংশই খিয়াং নৃগোষ্ঠীর মানুষ, ধর্মে খ্রিস্টান। নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তারা পরিস্থিতি নিয়েও কথা বলতে চাইছেন না।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে খবর পেয়ে দুপুরের দিকে পুলিশ গিয়ে খামতাং পাড়া থেকে আটটি গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করে। পরে সেগুলো ময়নাতদন্তের জন্য বান্দরবান সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।
রোয়াংছড়ির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খোরশেদ আলম চৌধুরী (যিনি একইসঙ্গে রুমা উপজেলারও দায়িত্বে রয়েছেন) শুক্রবার রাতে বলেন, গোলাগুলির ঘটনার পর প্রায় ৫০ জনের একটি দল ভয়ে সকালে এসে রোয়াংছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়। পরে ধীরে ধীরে ১৮৫ জন আশ্রয় নিয়েছেন সেখানে।
“এ ছাড়া আরও প্রায় ৬৪ পাহাড়ি নারী-পুরুষ ও শিশু রামু উপজেলা সদরের বম কমিউনিটি সেন্টারে গেছে বলে শুনেছি। সারাদিনই বিভিন্ন সময়ে মানুষ এসেছে।”
তাদের পরিবার প্রতি পাঁচ কেজি করে চাল এবং অন্যান্য সামগ্রী দেওয়া হয়েছে জানিয়ে ইউএনও বলেন, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে এ ব্যাপারে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
“রোয়াংছড়ির আশ্রয়প্রার্থীদের দুপুরের খাবার দেওয়া হয়েছে। রাতেও দেওয়া হবে। তাদের কম্বল সরবরাহ করা হবে। সেনাবাহিনী ও উপজেলা প্রশাসন সমন্বিতভাবে এই কাজ পরিচালনা করছে। সেখানে অতিরিক্ত টয়লেটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তারা যতদিন এখানে থাকবে, ততদিন এই ব্যবস্থা চালু থাকবে,” বলেন ইউএনও।
তবে বমদের সামাজিক সংগঠন বম স্যোশাল কাউন্সিলের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি সান বম রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, গোলাগুলির পর খামতাং পাড়া থেকে পালিয়ে আসা ২২টি পরিবারের ৭৫ জন সারাদিনে বম কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নিয়েছে।
“শুক্রবার সারাদিন আমরা নিজেদের উদ্যোগে কিছু টাকা সংগ্রহ করেছি। ১০ হাজার টাকার মত হয়েছে। শনিবার এগুলো আশ্রয়প্রার্থীদের দেওয়া হবে। এখানে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানাভাবে তাদের সহযোগিতা করা হচ্ছে। তারা যতদিন এখানে থাকবেন, বাড়ি যেতে না পারবেন ততদিন এখানে তাদের দেখভাল করা হবে।”
রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উ হ্লাং মং মারমা বলেন, “পাড়া ছেড়ে যারা এসেছেন তাদের নামের তালিকা করা হচ্ছে। তারা আতঙ্কিত, ভীত। আরও আসছে বলে শুনেছি।”
পাহাড়ে আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিভেদ ও হানাহানির মধ্যে গত বছর অক্টোবর থেকে রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ, যা স্থানীয়ভাবে ‘বম পার্টি’নামে পরিচিত) এবং নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার হিল ফিন্দাল শারক্বীয়া’র বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান চালাচ্ছে সেনাবাহিনী ও পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাব। মাঝে মধ্যে তাদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটছে।
এর জের ধরে জানুয়ারির শেষে রুমা উপজেলার কয়েকটি পাড়া থেকে মারমা ও বম জাতিগোষ্ঠীর লোকজন গহীন পাহাড়ের বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে শহরে চলে আসেন।
সেসময় পাইন্দু ইউনিয়নের অন্তত ৫১টি মারমা ও ২০টি বম পরিবার সব কিছু ফেলে রুমা বাজারের মারমা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের হল রুমে এবং বম কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নেয়। চার-পাঁচদিন পরে তারা আবার পাড়ায় ফিরে যায়।
মার্চের শুরুর দিকে স্থানীয় কারবারি, উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন জানায়, অভিযানের মধ্যে ‘আতঙ্কে’ বান্দরবানের রুমা থানা ও আশপাশের এলাকা থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। অন্তত ছয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সে সময় বন্ধ হয়ে যায়। বাড়িছাড়া হওয়ায় অনেকে জুম চাষের ক্ষতির কথাও বলেছিলেন; যা পাহাড়ি মানুষদের সারা বছরের খাবারের সংস্থানের উপায়।
আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পাহাড়ে পুরনো রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে হানহানি প্রায়ই লেগে থাকে; হত্যার ঘটনাও গণমাধ্যমে আসে। যদিও কোনো পক্ষই এর দায় নেয় না এবং সশস্ত্র অবস্থানের কথাও সবসময় অস্বীকার করে আসছে এসব সংগঠন।
এ অবস্থার মধ্যে নতুন সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের সঙ্গেও পুরনো সংগঠনগুলো আধিপত্য বিস্তারের খবর মাঝে মাঝে গণমাধ্যমে এসেছে।
তবে দীর্ঘদিন পর বৃহস্পতিবার রাতে পাহাড়ে আবার আটজনকে হত্যার মত বড় ঘটনা ঘটল। পুলিশ বলছে, যাদের উদ্ধার করা হয়েছে, তাদের কয়েকজনের গায়ে ‘ইউনিফর্ম’ ছিল, যেমনটা সামরিক বাহিনীর থাকে।
যদিও পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন বা পাড়াবাসী কেউ বলছে না, কোন দুটি সংগঠনের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে।
জেলা পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুপুরে যখন পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম ব্রিফ করছিলেন, তখন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি কোনো সংগঠনের নাম উল্লেখ করেননি এবং নিহতরা কোন সংগঠনের সদস্য সেটাও বলেননি।
খামতাং পাড়ার সাবেক কারবারী উথুলি খিয়াং বৃহস্পতিবার রাতেই পরিবার নিয়ে অন্যত্র সরে গেছেন।
বিকালে তিনি গোলাগুলির ঘটনার বর্ণনা দিয়ে টেলিফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে পাড়ার সবাই খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমাতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তখনি পাড়ার কাছ থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ আসতে থাকে। আমরা ঘর থেকে সেই আওয়াজ শুনতে পাই।
“তখন ভয় আর আতঙ্কে যে যেভাবে পারে বাড়িঘর রেখে পালিয়ে যায়। অনেকেই রাতের আঁধারে বাড়ির কাছে ঘন জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নেয়। রাতটা সেখানেই কাটায়। পরে সকালে সূর্য উঠার পর যে যেদিকে সুবিধা চলে গেছে। কেউ রুমা এসেছে, কেউ রোয়াংছড়ি গেছে।”
সশস্ত্র কোন দুটি সংগঠনের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে জানতে চাইলে উথুলি খিয়াং বলেন, অন্ধকারের মধ্যে পাড়ার কেউ এটা বুঝতে পারেননি, তারা শুধু গোলাগুলির আওয়াজ শুনেছেন। পরে সকালে আটজনের লাশ উদ্ধারের কথা জেনেছেন।
খামতাং পাড়ার কারবারির মেয়ে সারি খিয়াং সাংবাদিকদের বলেন, “রাতে গোলাগুলি শুরু হলে ভয়ে আমরা ও পাড়ার অনেকে গিয়ে গির্জার দুটি ভবনে আশ্রয় নিই। গির্জার ভবন পাকা। বাইরে প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছিল। যাতে গুলি না লাগে তাই গির্জায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। রাতে সেখানেই ছিলাম সবাই।
“সকাল ৬টার দিকে সবাই বেরিয়ে আসি রুমা চলে যাব বলে। টানা প্রায় তিন ঘণ্টা হেঁটে চান্দাপাড়ায় এসে আশ্রয় নিই। সবাই তখন ক্লান্ত ছিল। চান্দাপাড়ার লোকজন ও যুবকরা আমাদের দুপুরের খাবার দিয়েছে। পরে তারাই আমাদের জিপ গাড়িতে করে রুমাতে পাঠিয়েছে। রুমা এসে বম কমিউনিটি সেন্টারে উঠেছি। জানি না কতদিন এখানে এভাবে থাকতে হবে।”
কাদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে জানতে চাইলে সারি খিয়াং বলেন, “রাতে গোলাগুলি হয়েছে, আমরা জানি না কারা গোলাগুলি করেছে। শুধু গুলির শব্দ শুনেছি।“
একই পাড়ার শৈ ব্লা প্রু খিয়াং সাংবাদিকদের জানান, তার বড় পরিবার। ঘরে অনেক কাঠ রয়েছে। এসব ফেলে রেখে তিনি বাড়ি ছাড়তে রাজি ছিলেন না। কিন্তু যখন দেখলেন পাড়ার অন্যরাও চলে যাচ্ছে, তখন বাধ্য হয়ে তাকেও রুমায় চলে আসতে হয়েছে।
বম কমিউনিটি সেন্টারে আশ্রয় নেওয়া শৈ ব্লা প্রু বলেন, “যত দ্রুত সম্ভব আমি আমার ঘরে ফিরতে চাই। এখানে এভাবে অসহায় অবস্থার মধ্যে থাকতে চাই না। পাহাড়িরা পাড়া ছাড়া থাকতে পারে না।”
কারা কারা গোলাগুলি করেছে তা জানেন না বলে দাবি করেন তিনিও। বলেন, “সকালে শুনি পুলিশ আটটি লাশ উদ্ধার করেছে।”
দুপুরের পর রোয়াংছড়ি থানা পুলিশের একটি দল একটি পিকআপে করে আটজনের মৃতদেহ বান্দরবান সদর হাসপাতালে নিয়ে আসে ময়নাতদন্তের জন্য। সাদা প্লাস্টিকের ব্যাগে মোড়ানো আটটি মরদেহ হাসপাতালের মর্গে রেখে দরজায় তালা দেওয়া হয়।
এ সময় সেখানে সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু চেষ্টা করেও পুলিশের কাছ থেকে গোলাগুলি বা নিহতদের ব্যাপারে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এর আগে দুপুরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে ‘ভা তে কুকি’ নামের একটি পেইজ থেকে রোয়াংছড়ির এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেওয়া একটি পোস্ট স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের নজরে আসে। এই পেইজটি থেকে কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্টের কার্যক্রমের প্রচার চলতে দেখা যায়।
সেখানে এই হত্যাকাণ্ডে নিহত সাতজনের নাম প্রকাশ করা হয়। পরে আরেকটি পোস্টে চারজনের জাতীয় পরিচয়পত্রসহ ছয়জনের ছবি প্রকাশ করা হয়। তারা সবাই বম সম্প্রদায়ের। ‘ব্রাশফায়ারে’ এই হত্যাকাণ্ডের জন্য কোনো দলের নাম উল্লেখ না করে ‘মদদপুষ্ট সংস্কারপন্থিদের’ দায়ী করা হয়েছে।
ওই এলাকায় সংস্কারপন্থি বলতে পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফকে (গণতান্ত্রিক) বোঝান স্থানীয়রা। তবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ওই পেইজের তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে পারেনি। জেলা পুলিশ সুপারও এ বিষয়ে ‘অবগত নন’ বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
গোলাগুলির ওই ঘটনায় নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর বান্দরবান জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক উবা মং মারমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের কোনো সশস্ত্র সংগঠন বা শাখা নেই। আমরা নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিকভাবে দাবি-দাওয়া আদায়ে বিশ্বাসী। খামতাং পাড়ায় যে ঘটনা ঘটেছে সেটি হয়তো কুকি-চীন পার্টির আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে ঘটেছে।”
এদিকে ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে প্রসীত খিসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ। সংগঠনটির প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগের নিরন চাকমা স্বাক্ষরিত এই বিবৃতিটি বিকালে স্থানীয় সংবাদকর্মীদের ইমেইলে পাঠানো হয়।
পুরনো খবর:
গোলাগুলির আতঙ্ক, রুমার পাড়ায়-পাড়ায় স্কুল বন্ধ
‘আতঙ্কে’ বমপাড়ায় জুমচাষের ‘ক্ষতি’
পাহাড়ে সশস্ত্র দল; এই ‘বম পার্টি’ কারা?
বম পার্টির সঙ্গে নতুন জঙ্গি দলের ‘মাসিক চুক্তির’ খবর দিল র্যাব
নতুন জঙ্গি দল: পাহাড়ে অভিযান, তথ্য দিলে লাখ টাকা পুরস্কার
নতুন জঙ্গি দলের ‘পাহাড়ি যোগ’ পেয়েছে র্যাব
জঙ্গি আর পাহাড়ি দলের মিলে যাওয়ার বিপদ যেখানে
র্যাবের জালে নতুন জঙ্গি দল, কারা এরা?
নিখোঁজ ‘৫৫ জন’ নতুন জঙ্গি দলে, ৩৮ জনের তালিকা দিল র্যাব
নিখোঁজ ৪ তরুণসহ সাতজনকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব জানাল নতুন জঙ্গি দলের নাম