ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ইকবাল হোসেন বলছেন, এতদিনেও বিচার কাজ শেষ না হওয়ার পেছনে ‘বিগত সরকারের অবহেলা রয়েছে’।
Published : 24 Apr 2025, 08:25 AM
সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা ও ইমারত বিধির মামলার বিচার শেষ হয়নি এক যুগেও।
হত্যা মামলায় ৫৯৪ জনকে সাক্ষীর মধ্যে ৯৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। তবে কবে এ মামলার বিচার শেষ হতে পারে, সে বিষয়ে কিছু বলতে পারছেন না রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।
উচ্চ আদালতের আদেশে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছেঝ ইমারত বিধি না মেনে ভবন তৈরির মামলার কার্যক্রম। স্থগিতাদেশের মেয়াদ পেরিয়ে গেলেও হাকিম আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ আর শুরু হয়নি।
ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ইকবাল হোসেন বলছেন, এতদিনেও বিচার কাজ শেষ না হওয়ার পেছনে ‘বিগত সরকারের অবহেলা রয়েছে’।
রানা প্লাজা ধসের পরপর বেশ কয়েকটি মামলা হলেও এ দুটিই মূল মামলা। দুই মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানা কারাগারে থাকলে অধিকাংশ আসামি জামিনে বা পলাতক রয়েছেন।
মামলা দায়েরের দুই বছরের বেশি সময় পর ২০১৫ সালের ১ জুন তদন্ত শেষে দুটি অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর।
এর একটিতে পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগে ভবন মালিক সোহেল রানা, তার বাবা-মা এবং তৎকালীন সাভার পৌরসভার মেয়র ও কমিশনারসহ ৪১ জনকে আসামি করা হয়।
আর ইমারত বিধি না মেনে রানা প্লাজা নির্মাণের অভিযোগে অপর অভিযোগপত্রে সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়।
দুই অভিযোগপত্রে মোট আসামি ছিলেন ৪২ জন। এর মধ্যে সোহেল রানাসহ ১৭ জন দুটি মামলারই আসামি। আসামিদের মধ্যে তিনজন ইতোমধ্যে মারা গেছেন।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ১০ তলা রানা প্লাজা ভবন ধসে পড়ে। ওই ভবনে থাকা কয়েকটি পোশাক কারখানার ৫ হাজারের মতো শ্রমিক তার নিচে চাপা পড়েন।
কয়েকদিনের উদ্ধার তৎপরতায় ১ হাজার ১৩৬ জনের লাশ তুলে আনা হয়। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তার মধ্যে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক আহত ও পঙ্গু হন।
ইতিহাসের সর্ববৃহৎ এই শিল্প দুর্ঘটনার পাঁচদিন পর ২৯ এপ্রিল ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পথে সোহেল রানাকে যশোরের বেনাপোল থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
হত্যা মামলা কতদূর?
রানা প্লাজা ধসের পরদিন অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে একটি মামলা করেন সাভার থানার এসআই আলী আশরাফ। ওই মামলায় সোহেল রানাসহ ২১ জনকে আসামি করা হয়।
এ ছাড়া রানা প্লাজা ধসে নিহত হওয়ার ঘটনাকে ‘হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে বর্ণনা করে আদালতে আরেকটি মামলা করেন পোশাক শ্রমিক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শিউলি আক্তার।
আদালতের নির্দেশে একে অবহেলাজনিত মৃত্যু মামলার সঙ্গে একীভূত করে তদন্ত করে সিআইডি। আদালতে দায়ের করা হত্যা মামলার বাদী শিউলি আক্তার পুলিশের মামলার সাক্ষী। এ মামলায় মোট ৫৯৪ জনকে সাক্ষী করা হয়।
২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকার তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান ৪১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে হত্যা মামলার বিচার শুরুর আদেশ দেন।
এ মামলায় অভিযুক্ত ৪১ আসামির মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন কেবল ভবন মালিক সোহেল রানা। আসামিদের মধ্যে রানার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কলু খালেক, আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন এরইমধ্যে মারা গেছেন।
অভিযোগ গঠনের পরপর সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফায়েত উল্লাহ এবং তৎকালীন কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানসহ আটজন মামলা বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। তাদের আবেদনে হাই কোর্ট মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুল জারি করে।
উচ্চ আদালতের ওই স্থগিতাদেশে আটকে যায় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়ার আদালতে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
বর্তমানে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ হেলাল উদ্দিনের আদালতে মামলাটি বিচারাধীন। এ মামলায় মোট ৫৯৪ জনকে সাক্ষীর মধ্যে প্রায় ৯৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে।
সর্বশেষ গত ১৫ এপ্রিল মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ছিল। তবে ওইদিন কোনো সাক্ষী আদালতে আসেননি। এজন্য আদালত আগামী ১৫ মে সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন।
এ বিষয়ে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ইকবাল হোসেন বলেন, “আগামী তারিখে সাক্ষ্য দিতে ১৭ সাক্ষীর বিরুদ্ধে সমন দেওয়া হয়েছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি মামলা নিষ্পত্তি করতে। এজন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি।”
বিচার শেষ হতে কেমন সময় লাগবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কতদিন সময় লাগবে সেটা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে দ্রুত সময়ে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে মামলার বিচার শেষ করা হবে। এতদিনেও বিচার কাজ শেষ না হওয়ার পেছনে বিগত সরকারের অবহেলা রয়েছে।”
ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আবুল কালাম খান বলেন, “এ মামলায় চার্জগঠনের আদেশের বিরুদ্ধে কয়েকজন আসামি উচ্চ আদালতে যান। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় প্রায় ৫ বছর মামলার কার্যক্রম বন্ধ ছিল।
“এরপর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। বর্তমানে ৯৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। আমরা গত বছর শেষের দিকে দায়িত্ব নিয়েছি। আশা করছি, সাক্ষী হাজির করে আগামী বছরে মধ্যে এ মামলা বিচার শেষ করতে পারব।”
আসামি সোহেল রানার আইনজীবী মাসুদ খান খোকন বলেন, “রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে সাক্ষী হাজির করতে পারে না। এ কারণে বিচার কাজ এগোচ্ছে না। আমরা চাই, এ মামলার বিচার দ্রুত শেষ হোক। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক।”
আটকে আছে ইমারত বিধির মামলা
রানা প্লাজা ধসের পর ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন সাভার থানায় মামলা করেন।
২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
এরপর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম মোস্তাফিজুর রহমান ২০১৬ সালের ১৪ জুন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।
অভিযোগ গঠনের ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন আসামি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন। যার মধ্যে নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বজলুস সামাদ এবং সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের রিভিশন আবেদন নামঞ্জুর হয়।
অন্যদিকে ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামের রিভিশন মঞ্জুর করে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এছাড়া ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর আসামি রেফায়েত উল্লাহার আবেদনে তার ক্ষেত্রে মামলার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেয় হাই কোর্ট। ছয় মাসের সেই স্থগিতাদেশের মেয়াদ অনেক আগে শেষ হয়ে গেলেও দীর্ঘদিনেও এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যায়নি।
মামলাটি ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম কে এম মহিউদ্দিনের আদালতে বিচারাধীন। সর্বশেষ গত ৯ এপ্রিল মামলায় উচ্চ আদালতের আদেশ দাখিলের তারিখ ছিল। তবে আসামিপক্ষ তা দাখিল করতে পারেনি। আগামী ৩১ অগাস্ট আদেশ দাখিলের জন্য রাখা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট আদালতে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর ইশতিয়াক হোসেন জিপু বলেন, “স্থগিতাদেশের ছয় মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। তবে তখনকার সময়কার রাষ্ট্রপক্ষ মামলা আগানোর কোনো উদ্দ্যোগ নেননি। আমরা দায়িত্ব পাওয়ার পর মামলাটা নিয়ে কাজ করছি।
“তারা (আসামিপক্ষ) যদি স্থগিতাদেশ এক্সটেন্ড করতে না পারেন, তাহলে মামলার বিচার শুরু হবে। আদালত তাদের উচ্চ আদালতের আদেশ দাখিল করতে বলেছে। তারা দাখিল করতে না পারলে সাক্ষ্য শুরু হবে। অনেকটা সময় চলে গেছে। আমরা সাক্ষী হাজির করে মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার উদ্যোগ নেব।'
এ মামলার আসামি মোহাম্মদ আলীর আইনজীবী রেফাত আহমেদ (মিন্টু) বলেন, “নানান কারণে দীর্ঘদিন ধরে মামলার বিচার হচ্ছে না। কোনো সাক্ষ্য হয়নি। এতে আমরা হয়রানির শিকার হচ্ছি। আমরাও চাই মামলাটি দ্রুত নিষ্পতি হোক। এই যন্ত্রণা আর কত পোহাব। যারা দোষী তারা সাজা পাবে। নির্দোষরা মুক্তি পাবে।”