‘আতঙ্কে’ বমপাড়ায় জুমচাষের ‘ক্ষতি’

ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, “চার পাড়ার কোনো পরিবার জুমচাষের প্রস্তুতি নেয়নি। এ বছর তারা জুমচাষ আর করবে না।“

উসিথোয়াই মারমাবান্দরবান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 March 2023, 04:03 AM
Updated : 4 March 2023, 04:03 AM

বান্দরবানে সশস্ত্র সংগঠন ‘বম পার্টি’ এবং নতুন জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযানের মধ্যে গহীন পাহাড় থেকে অনেক নৃ-গোষ্ঠীর পরিবার পাড়া ছেড়ে যায়। এর প্রভাব পড়েছে পাহাড়িদের বাৎসরিক জুম চাষে। নির্ধারিত সময় চলে গেলেও একমাত্র ফসলের জন্য জুমের প্রস্তুতি নিতে পারেনি অনেক বম পরিবার; ফলে খাদ্য সংকটের আশঙ্কার কথাও বলেছেন তারা।     

প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসেই জুমচাষের জন্য কাটা হয়ে যায় পাহাড়ের ঢালু জঙ্গল। কাটা জঙ্গল ও গুল্মলতা কড়া রোদে শুকানো হয় মার্চ মাস ধরে। তারপর এপ্রিলে ছোট ছোট গর্ত করে লাগানো হয় জুম ধানের বীজ ও অন্যান্য ফসল।

ধান ছাড়া জুমে এক সঙ্গে মিষ্টি কুমড়া, তুলা, তিল, লাউ, মরিচ, ভুট্টা ও মারফা অনেক সাথী ফসল রোপণ করা হয়। সাধারণত সেপ্টেম্বর মাস থেকে জুমের ধান কাটা শুরু হয়। জুম ধানের ওপর নির্ভর করে চলে পাহাড়ের দুর্গম এলাকার বাসিন্দারা। আবহাওয়া ভাল থাকলে সারা বছরের খোরাকি ধান পেয়ে যায় অনেকে।

রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উহ্লামং মারমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার ইউনিয়নে বম জনগোষ্ঠীর দুর্গম আরথাহ পাড়া, মুয়ালপি পাড়া, বাসত্লাং পাড়া ও মুননুয়াম পাড়াবাসী কেউ জুমচাষের জন্য এখনও জঙ্গল কাটেনি। এই সময় জুমচাষের জন্য জঙ্গল কেটে শেষ করার কথা। মার্চ মাসে কাটা জঙ্গল পুড়িয়ে এপ্রিলে ধান লাগানোর সময়।

“কিন্তু এই চার পাড়ার কোনো পরিবার জুমচাষের প্রস্তুতি নেয়নি। জঙ্গল কাটার সময় চলে যাচ্ছে। খবর নিয়ে জানলাম, এ বছর তারা জুমচাষ আর করবে না। তবে এই চারটি পাড়া ছাড়া দুর্গম এলাকায় জুমচাষের প্রস্তুতি নিতে পারেনি এমন আরও কোনো পাড়া রয়েছে কি-না সেটি আমার জানা নেই।”

ইউপি চেয়ারম্যান আরও বলেন, “জুমচাষ নির্ভর করে বাঁচে অনেক পরিবার। অনেক পরিবারে জমা ধান শেষ হয়ে আসছে। কিছু পাড়ায় এরই মধ্যে খাদ্যে টান পড়তে শুরু করেছে। জুম চাষ না করলে ওই এলাকায় খাদ্য সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।”

রুমা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মামুন শিবলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “‘বিদ্যমান পরিস্থিতি’র কারণে কোথাও কোথাও জুমচাষের জন্য জঙ্গল কাটা হয়নি বলে শুনেছি। কিন্তু এখন অনেকে জঙ্গল কাটা শুরু করেছে। হয়ত একটু দেরী হয়েছে।

“যখন এ ধরনের (খাদ্য সংকট) অবস্থা তৈরি হবে তখন পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।“

গত বছর অক্টোবর থেকে রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ, যা স্থানীয়ভাবে ‘বম পার্টি’নামে পরিচিত) এবং নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার হিল ফিন্দাল শারক্বীয়া’বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান চালাচ্ছে সেনাবাহিনী ও পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাব। মাঝে মধ্যে তাদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটছে। 

পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠনটি অর্থের বিনিময়ে জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয় বলে অক্টোবরে সংবাদ সম্মেলন করে জানায় র‌্যাব। এরপর জঙ্গি সংগঠনের ৩৫ জন এবং বম পার্টির ১৭ জনের গ্রেপ্তারের খবর আসে।

জানুয়ারির শেষে রুমা উপজেলার কয়েকটি পাড়া থেকে মারমা ও বম জাতিগোষ্ঠীর লোকজন গহীন পাহাড়ের বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে শহরে চলে আসেন। পাইন্দু ইউনিয়নের অন্তত ৫১টি মারমা ও ২০টি বম পরিবার সব কিছু ফেলে রুমা বাজারের মারমা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের হল রুমে এবং বম কমিউনিটি সেন্টারে এসে আশ্রয় নেয়। চার-পাঁচদিন পরে তারা আবার পাড়ায় ফিরে যান।

যৌথ বাহিনীর অভিযানের মধ্যে ‘আতঙ্কে’ বান্দরবানের রুমা থানা ও আশপাশের এলাকা থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বলে উপজেলা প্রশাসন ও থানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। এ কারণে অন্তত ছয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।

সোমবার রুমার সাপ্তাহিক হাটের দিন। সেদিন দূর-দূরান্ত থেকে পাড়াবাসী বাজারে তাদের পণ্য নিয়ে আসেন বিক্রির জন্য। মুয়ালপি ও আরথাহ পাড়ার কয়েকজন বম নৃ-গোষ্ঠীর জুম চাষির সঙ্গে যৌথ বাহিনীর অভিযান, মানুষের পাড়া ছেড়ে যাওয়া ও জুম চাষ নিয়ে কথা বলতে গেলে অধিকাংশই সন্দেহের চোখে তাকান। তারা কথা বলতে আগ্রহী ছিলেন না। সংবাদকর্মী পরিচয় পেয়ে এড়িয়ে যান। তাদের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ।

তবে মুয়ালপি পাড়ার বাসিন্দা ম্রোচাঅং মারমা জানান, তিনি ও তার পরিবার জানুয়ারি মাসে গোলাগুলির আতঙ্কে বাড়ি ছেড়েছিলেন। কোনো যানবাহন না পেয়ে তিন ঘণ্টা হেঁটেছেন; পালিয়ে ছিলেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আর কখন যে এরকম পরিস্থিতি শিকার হতে হয় ঠিক নাই। তখন থেকে ভয়ে কেউ জঙ্গল কাটতে যায়নি। যেখানে গিয়ে জঙ্গল কাটব এগুলো পাড়া থেকেও দূরে। দূরে গিয়ে জুমচাষের জন্য জঙ্গল কাটতে সবসময় ভয় ও আতঙ্ক তাড়া করে।”

“ঠিক সময়ে জঙ্গল কাটতে না পারলে সময়মত ধানও লাগানো যাবে না। সবকিছু উপযুক্ত সময়ে কাজ করতে না পারলে ধান ভাল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। জুমচাষ এমনিতে আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে। এ কারণে জুমচাষ করলেও ধান কম হওয়ার আশঙ্কা করছি আমরা।”

মুয়ালপি পাড়ার আরেক বাসিন্দা ক্রানুপ্রু মারমা বলেন, “মাত্র পাঁচদিন আগে জঙ্গল কাটা শুরু করেছি। অন্যান্য বছর এ সময় জঙ্গল কাটা শেষ হয়ে যায়। মার্চ মাস শুকানোর সময়। ভালভাবে শুকানোর পর আগুন দিয়ে পুড়াবো। এলাকার পরিস্থিতিতে ‘বিভিন্ন ঝামেলায়’ পড়ে এখন সবাই কমবেশি জঙ্গল কাটা শুরু করেছে মাত্র।”

“অন্যান্য বছর এই সময় পাঁচ আড়ি (এক আঁড়ি সমান এক কেজি চাল) ধান লাগানোর মত জঙ্গল কাটা শেষ করে ফেলি। কিন্তু এবারে মাত্র দুই আঁড়ি ধান লাগানোর মত জঙ্গল কাটতে পেরেছি। দেরিতে হলেও ৬-৭ আঁড়ি ধান লাগানোর মত জঙ্গল কাটব।

ক্রানুপ্রু মারমা আরও বলেন, “তা নাহলে বছর খোরাকির ধান পাওয়া যাবে না। জুমচাষ শুধু ধানের জন্য না, সেখানে আরও অন্যান্য ফসল লাগানো যায়। যেগুলো বাজার থেকে দাম দিয়ে কিনতে হয় না।“

জুমচাষ করার জন্য জঙ্গল কাটার কাজে কেউ বাধা দিয়েছে কি-না জানতে চাইলে বম পাড়ার লোকজন বলেন, সরাসরি কেউ বাধা দেয়নি। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পাড়ার বাইরে গিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ ছিল। এলাকায় মাঝে মাঝে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে। এ জন্য পাড়ার বাইরে গিয়ে জঙ্গল কাটতে সবার মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক ছিল।

দেরীতে হলেও সবাই জঙ্গল কেটে জুমচাষের প্রস্তুতি নিচ্ছে জানিয়ে রেমাক্রিপ্রাংসা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিরা বম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুর্গম পাহাড়ে জুমচাষের বিকল্প তো কিছু নাই। জুমচাষ না করলে তারা খাবে কী। আমার ইউনিয়নে যত দুর্গম এলাকায় হোক, এখন সবাই জুমচাষের জন্য তৈরি হচ্ছে। কেউ জঙ্গল কেটে শেষ করেছে। কেউ জঙ্গল কাটা শুরু করেছে। তবে একটু দেরী হয়েছে।”

রুমা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাহিদুল ইসলাম বলেন, “এখন তো জুমচাষের জন্য পুরোদমে জঙ্গল কাটার সময়। অনেক এলাকায় চাষি জঙ্গল কেটে জুমচাষের জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছে।

কয়েকটি বম পাড়ায় জুমচাষের প্রস্তুতি নেয়নি এ রকম কোনো তথ্য নেই জানিয়ে কৃষি কর্মকর্তা আরও বলেন, “জুমচাষ নিয়ে এপ্রিল মাসে একটা প্রতিবেদন দেওয়া হবে। গত বছর জুমক্ষেতে ইঁদুর আক্রমণ করেছিল। কোনো কোনো এলাকায় ধান ভাল হয়নি।

যেসব এলাকায় ইঁদুর আক্রমণে ধান ভাল হয়নি তাদেরকে সরকারি বিভিন্ন খাদ্য কর্মসূচির মাধ্যমে সহযোগিতা করা হয়েছিল বলেও জানান রুমা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।