আসন ভাগাভাগির হিসাবে সরে গেছে নৌকা; জাতীয় পার্টির জামাই আর শ্বশুর দাঁড়িয়ে গেছেন পরস্পরের বিপক্ষে। সেই অঙ্কটাই নিজের পক্ষে নিতে চান স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগ নেতা।
Published : 29 Dec 2023, 12:24 AM
আশুগঞ্জ ও সরাইল উপজেলা নিয়ে গঠিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী নেই এবার। কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা এই শীতেও স্বতন্ত্র প্রার্থী মঈন উদ্দিন মঈনের জন্য প্রচারে ঘাম ছোটাচ্ছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মঈন ভাবছেন, একদিকে জামাই আর শ্বশুরের লড়াই, অন্যদিকে ‘নৌকার ভোট’- দুয়ে মিলে তার জন্য এক বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন।
আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে যে ২৬টি আসনে ছাড় দিয়েছে, তার মধ্যে এ আসনও রয়েছে। এখানে লাঙ্গলের প্রার্থী হয়েছেন মো. রেজাউল ইসলাম ভুঁইয়া।
তার বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন জাতীয় পার্টি থেকে দুইবারের (২০১৪ ও ২০০৮ সাল) সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধা। তার বড় মেয়ের জামাই রেজাউল।
জাতীয় পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব রেজাউল ইসলাম দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের এবং জিয়াউল হক মৃধা সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। সে কারণে রেজাউল ‘বহিরাগত’ হয়েও লাঙ্গলের মনোনয়ন পেয়েছেন, যদিও এ আসনে জিয়াউলের ভোট বেশি।
২০১৮ সালের নির্বাচনেও রেজাউল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে এখানে লড়াইয়ে নেমেছিলেন। তখন বিএনপির প্রার্থী ছিলেন উকিল আব্দুস সাত্তার, স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন মঈন উদ্দিন মঈন আর জিয়াউল হক মৃধা।
নির্বাচনের মাঠ বুঝতে পেরে ভোটের দুদিন আগে রেজাউল নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। সেই নির্বাচনে উকিল আব্দুস সাত্তার বিজয়ী হলেও মঈন উদ্দিন মঈন ৭৫ হাজার ভোট পেয়েছিলেন, যা এই আসনে নৌকায় পাওয়া সর্বোচ্চ ভোট। জিয়াউল সেবার পেয়েছিলেন ৪০ হাজার ভোট।
পাঁচ বছরের মধ্যে এই আসনে চতুর্থবারের মত নির্বাচন হচ্ছে। আগের দুটি উপ-নির্বাচনে ভোটারদের কোনো আগ্রহ না থাকলেও এবার ধীরে ধীরে এখানে ভোটের মাঠ জমতে শুরু করেছে বলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনটি থেকে উকিল আব্দুস সাত্তার ভূঁইয়া বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত হন। পরে দলীয় সিদ্ধান্তে গত বছরের ডিসেম্বরে সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
তাতে আসনটি শূন্য হলে চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি উপ-নির্বাচন হয়। দলছুট হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে ৮৩ হাজার ৯৯৭ ভোটে পুনরায় জয় পান সাত্তার। পরে বিএনপি তাকে বহিষ্কার করে।
চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর সাত্তার ভূঁইয়ার মৃত্যুতে আসনটি আবারও শূন্য হয়। ৫ নভেম্বর ফের উপ-নির্বাচন হয়। তাতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শাহজাহান আলম সাজু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নিয়ম রক্ষার নির্বাচনে পাস করে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিলেও সংসদের কোনো অধিবেশনে যোগ দেওয়ার সুযোগ তিনি পাননি।
দুই মাসের ব্যবধানে হতে যাওয়া জাতীয় সংসদের দ্বাদশ নির্বাচনে এবার নৌকার মনোনয়ন পেয়েও দলীয় সিদ্ধান্তে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে হল তার। তবে দলীয় সিদ্ধান্ত খুশি মনে মেনে নিয়েছেন বলে জানান শাহজাহান সাজু।
নৌকার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার পর এ আসনটিতে বদলে গেছে নির্বাচনের দৃশ্যপট। এবার এ আসনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সাতজন হলেও ত্রিমুখি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া গেছে।
আশুগঞ্জ উপজেলার আড়াইসিধা গ্রামের ভোটার আল মামুন বলেন, “আগের নির্বাচনগুলোতে ভোটারদের আগ্রহ ছিল কম। সুতরাং সেটা বিবেচনায় আনা ঠিক হবে না। এবার ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ বেশি দেখা যাচ্ছে।”
চর চারতলা গ্রামের ব্যবসায়ী জালাল উদ্দিন বলেন, “এক টার্মে চাইরবার নির্বাচন হওয়া নিয়ে আমার কিছু বলার নাই। তবে এইবারের ভোট নিয়ে এহনও কিছু বুঝতে পারতেছি না। যদিও মানুষ ভোট দিতে আগের থেইকা বেশি উৎসাহ দেখাইতেছে।”
একই এলাকার হাবিবুর রহমান বলেন, “নৌকার প্রার্থী না থাকলেও আওয়ামী লীগ নেতা মঈন উদ্দিন নৌকার ভোট পাবেন। যেহেতু আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগের যে কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে পারবেন- সেহেতু সবাই মঈন ভাইকেই ভোট দেবেন।”
২০১৮ সালের নির্বাচনে কলার ছড়ি প্রতীক পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী মঈন উদ্দিন মঈন এবারও একই প্রতীক নিয়ে ভোটে আছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত নির্বাচনে আমি জিততে-জিততে হেরে গেছি। এবার নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রেখে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছি। যদি সুষ্ঠু ভোট হয়, তাহলে আমি বিশ্বাস করি, সরাইল ও আশুগঞ্জের আমজনতা কলার ছড়িকে বেছে নেবেন।”
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার কোড্ডা গ্রামের বাসিন্দা রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়াকে ২০১৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর) আসনে মহাজোট থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল; পরে প্রত্যাহার দেখানো হয়। তার অভিযোগ, ওই সময় ‘প্রশাসনিক ক্যু’ হয়েছিল। এবার তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন থেকে নির্বাচন করছেন।
লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে থাকা রেজাউল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি জনসংযোগ করছি। আমার এখানে তো মঈন সাহেব আছেন; আরও কয়েকজন প্রার্থী আছেন। সবাই ভারী প্রার্থী। গত নির্বাচনে মঈন সাহেব ৭৫ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। সেই হিসেবে মঈন সাহেব কম নন। উনি (শ্বশুর) পেয়েছিলেন ৪০ হাজার ভোট। এখন বুঝতেই পারছেন, আমি ৭৫ হাজারকে ফেইস করেই জয় ছিনিয়ে আনব।”
এ আসন থেকে দুইবার সংসদে যাওয়া জিয়াউল হক মৃধাও জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী বলে জানালেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন থেকে সর্বোচ্চ পাঁচবার (১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০১৮, ২০২৩ সাল) সংসদ সদস্য হয়েছেন উকিল আব্দুস সাত্তার ভুঁইয়া। তিনি বিএনপি নেতা হলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দুইবার (১৯৯৬ এবং ২০২৩) সংসদ সদস্য হন।
স্থানীয় অনেকে বলছেন, বিএনপির জ্যেষ্ঠ এ নেতা ভাটি এলাকার মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন, উপজেলা সদরেও তার অনেক কর্মী-সমর্থক রয়েছে। সাত্তারকে টেকনোক্র্যাট হিসেবে ভূমি প্রতিমন্ত্রী করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
এখানে বিএনপির একটি বড় ভোট ব্যাংক রয়েছে। সেই ভোট-ব্যাংক কার দিকে যাবে সেটাও এই নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছেন ভোটাররা।
যদিও বিএনপি নেতারা বলছেন, তাদের কেউ ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন না। বরং তারা এই একতরফা ভোট বর্জনের জন্য মানুষের কাছে আহ্বান জানাচ্ছেন।
উকিল আব্দুস সাত্তার ভূঁইয়ার ছেলে মাইনুল হাসান তুষার বিএনএমের প্রার্থী হিসেবে লড়াই করছেন। তিনি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী হলেও তাকে নিয়ে খুব একটা আলোচনায় নেই ভোটের মাঠে।
সরাইল উপজেলা সদরের একজন প্রবীণের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, “ভোটের দিন যত এগিয়ে আসবে ততই ভোটারদের মনমানসিকতা পরিবর্তন হতে থাকবে। তারা মনে করতে পারেন লাঙ্গল সরকারি দলের মার্কা। তাহলে বিএনপির লোকেরা তাকে ভোট দেবে কেন?
“তারা যদি কেন্দ্রে যায়, তাহলে তারা লাঙ্গলের বিরুদ্ধেই ভোট দেবে। যদি দেখে মঈনের পজিশন ভালো, তাহলে মঈনকে ভোট দেবে। আর যদি দেখে জিয়াউলের মাঠ ভালো, তাহলে তাকে ভোট দেবে।”
চারদলীয় জোটের শরিক ইসলামী ঐক্যজোটের নেতাকে ২০০১ সালে এই আসনটি ছেড়ে দিয়েছিল বিএনপি। তখন এখান থেকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করে প্রায় এক লাখ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন মুফতি ফজলুল হক আমিনী। তিনি মূলত সেসময় বিএনপি ও সমমনা ইসলামী ভোট পেয়েছিলেন।
মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ছেলে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনী মিনার প্রতীক নিয়ে এবার ভোট করলেও তেমন সাড়া পাচ্ছেন না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ নির্বাচনি এলাকার মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ১০ হাজার ৭২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ১৭ হাজার ৩৯৫ এবং নারী ১ লাখ ৯২ হাজার ৬৭৬ জন। আর হিজড়া ভোটার আছেন একজন।