‘শুকনা কথায় খৈ ভিজবে না’, বলছেন কুমিল্লার ৩৪ হাজার তরুণ ভোটার

“ভোট এলেই মেয়র প্রার্থীরা প্রতিশ্রুতি দেন, নারীবান্ধব নগরী গড়ে তুলবেন। কিন্তু মেয়রের চেয়ারে বসলেই সব ভুলে যান।”

আবদুর রহমান, কুমিল্লা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 March 2024, 02:28 PM
Updated : 7 March 2024, 02:28 PM

এবারের কুমিল্লা সিটি করপোরেশন উপনির্বাচনে তরুণ ভোটার ৩৪ হাজার ৮৯২ জন। ভোটের মাঠে থাকা মেয়র পদের চার প্রার্থীর নজর এই ভোটারদের দিকে; নিজেদের পক্ষে ভোট টানতে দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি।

তবে ভোটাররা বলছেন, ‘মিষ্টি কথায়’ তাদের মন ভরবে না; নগরপিতা নির্বাচন করবেন ‘দেখে-শুনেই’। নগরীর সব ধরনের উন্নয়নকাজ টেকসই করার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ ও নারীদের জন্য কর্মমুখী প্রকল্প চান তারা।

আগামী ৯ মার্চ কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে; বৃহস্পতিবার রাতেই শেষ হচ্ছে নির্বাচনের প্রচার। এবার মেয়র পদে লড়ছেন আওয়ামী লীগের দুইজন এবং বিএনপির দুইজনসহ মোট চারজন স্বতন্ত্র প্রার্থী।

চার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক চিকিৎসক তাহসিন বাহার সূচনা রয়েছেন।

বাকি তিন প্রার্থী হলেন- দুইবারের সাবেক মেয়র ও বিএনপির সাবেক নেতা মনিরুল হক সাক্কু, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সার এবং মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি নুর-উর রহমান মাহমুদ তানিম।

এই চার প্রার্থীর মধ্যে নগরপিতা কাকে দেখতে চান? এ প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী নগরীর ছোটরা এলাকার বাসিন্দা রাবেয়া আক্তারের কাছে। এবারই প্রথম ভোট দেবেন তিনি।

উত্তরে রাবেয়া বলেন, “নগরীর প্রতিটি সড়কে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত যানজট লেগে থাকে। বর্ষাকালে লোকজনের ঘরে পানি ঢুকে। এছাড়া অনেক সড়কের অবস্থা বেহাল। এসব সমস্যার সমাধান করতে পারবেন, এমন মেয়র চাই। চাই পরিকল্পিত ও পরিচ্ছন্ন নগরী।”

কুমিল্লা নগরী এখনও পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি বলে আক্ষেপের সুর কুমিল্লা বাগিচাগাঁও এলাকার নতুন ভোটার পারভীন আক্তারের গলায়। বলেন, “বলতে গেলে কুমিল্লা এখন একটা ঘিঞ্জি শহরে পরিণত হয়েছে; উন্নয়ন কাজগুলো পরিকল্পিত হওয়া দরকার।

“আমরা নগরীর সব ধরনের উন্নয়নকাজ টেকসই করার দাবি জানাচ্ছি। এতে যিনি ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে মনে হয়, তাকেই আমরা ভোট দেব।”

নগরীর ঠাকুরপাড়া এলাকার তরুণ ভোটার জিসান চৌধুরীর চাওয়া বেকার সমস্যা দূর হোক।স্থানীয়ভাবে ও সিটি করপোরেশন থেকে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের কোনো উদ্যোগ অতীতে নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

জিসান বলেন, “কুমিল্লার অনেক তরুণ বেকার। আমরা চাই, নতুন মেয়র তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবেন। যিনি তরুণদের জন্য কাজের প্রতিশ্রুতি দেবেন, তাকেই আমরা ভোট দেব।”

কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ঝুমুর আক্তার বলেন, “ভোট এলেই মেয়র প্রার্থীরা প্রতিশ্রুতি দেন, নারীবান্ধব নগরী গড়ে তুলবেন। কিন্তু মেয়রের চেয়ারে বসলেই সব ভুলে যান। শুধু আশ্বাস নয়, নারীদের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করে কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

“যিনি এগুলো করে নারীবান্ধব নগরী গড়তে পারবেন, তাকেই মেয়র হিসেবে দেখতে চাই।”

নগরীর হাউজিং এলাকার তরুণ ভোটার বোরহান উদ্দিন বলেন, “কুমিল্লা নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি খুবই খারাপ। সড়কের মধ্যে নালার পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত তরল ময়লা ফেলা হয়। সড়ক সম্প্রসারণও কম হচ্ছে। অতীতে সড়কের ও নালার উন্নয়নকাজ টেকসই হয়নি। সমন্বয় করে নগরীর পরিকল্পিত উন্নয়ন চাই।”

একই অভিযোগ ও দাবি করে ওই এলাকার সোহাগ হোসেন বলেন, “যিনি এগুলো করতে পারবেন, তাকেই আমরা ভোট দেব।”

কুমিল্লা সিটি ভোটে মেয়র পদের উপনির্বাচনে এবার অংশ নেওয়া চার প্রার্থীর মধ্যে বিএনপিপন্থী ‘টেবিল ঘড়ি’ প্রতীকের মনিরুল হক সাক্কু কুমিল্লা সিটির সাবেক দুইবারের মেয়র।

তরুণ ভোটেরদের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি কি-জানতে চাইলে বলেন, “আমি বিগত সময়ে মেয়র থাকা অবস্থায় তরুণদের তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে কাজ করেছি। সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে নির্মিত কুমিল্লা নিউ মার্কেটের পঞ্চম তলায় ১১৯টি দোকান বরাদ্দ দিয়েছি তরুণদের।”

এবারও মেয়র নির্বাচিত হলে তরুণদের জন্য কর্মমুখী পরিবেশ এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে চান বলে জানান সাক্কু।

নারীদের নিয়ে পরিকল্পনায় তিনি বলেন, “বিগত সময়ে নারীদের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে তাদের স্বাবলম্বী করে তুলেছি, সামনে আরও বড় পরিকল্পনা আছে। আমি মনে করি, কুমিল্লার তরুণরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। প্রয়োজনে তারা অভিভাবকদের সঙ্গে আলাপ করে যাকে ভালো লাগে, তাকে রায় দেবে এটাই আমার প্রত্যাশা।

“কুমিল্লার বেশিরভাগ তরুণ শিক্ষিত, আশা করছি তারা কারও কথায় প্ররোচিত হবে না।”

কুমিল্লার তরুণরা এখন পরিবর্তন চায় বলে ‘ঘোড়া প্রতীকের’ প্রার্থী কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সারের বিশ্বাস।

এজন্য তরুণ ভোটারদের স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, “তারাই আগামীর বাংলাদেশ। আমি নির্বাচিত হয়ে তারুণ্য নির্ভর কুমিল্লা সাজাতে চাই। আমার ইশতেহারে তরুণদের জন্য কর্মমুখী প্রকল্প গ্রহণ, উদ্যোক্তা তৈরি, প্রশিক্ষিত করে তোলা এবং তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বেশ কিছু উদ্যোগের কথা বলেছি। নির্বাচিত হলে প্রতিটি বাস্তবায়ন করব।”

মেয়র নির্বাচিত হলে মাদকমুক্ত কুমিল্লা গড়ার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছেন তিনি। বলেন, “কুমিল্লার তরুণদের যেন কেউ গ্যাংস্টার বানাতে না পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখব। আর নারীদের উদ্যোক্তা তৈরি করার জন্য কাজ করব। স্বাস্থ্য সেবাসহ সকল ক্ষেত্রে নারীদের জন্য কল্যাণকর নগরী গড়ব। আমি অতীতের মেয়রদের মতো নারীদের বঞ্চিত করব না।”

অতীতে তরুণ ভোটারদের জন্য বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলেও অভিযোগ করেছেন এ মেয়র প্রার্থী। বলেন, “আমি এই নতুন প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি হিসেবে কুমিল্লাকে নতুন করে গড়তে চাই। যে কুমিল্লার সঙ্গে আধুনিকতা ও প্রযুক্তির একটা সমন্বয় থাকবে।

“আর আমি নিজেও তরুণ সমাজের প্রার্থী, এ জন্য তরুণদের সঙ্গে আমার সবচেয়ে বেশি সম্পর্ক। চারদিকে তরুণ ভোটারদের গণজোয়ার দেখছি ঘোড়া মার্কার পক্ষে।”

এদিকে নিজেকে তরুণ প্রজন্মের প্রার্থী দাবি করে ‘বাস’ প্রতীকের তাহসিন বাহার সূচনা বলেন, “প্রচারের শুরু থেকেই যেখানে যাচ্ছি, সেখানে তরুণ ভোটারদের অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছি। তরুণ ভোটারদের জন্য আমার বার্তা হচ্ছে, এবারের ভোটটা অবশ্যই যেন উন্নয়নের পক্ষে বাস মার্কায় হয়। কুমিল্লার উন্নয়নের নতুন অধ্যায় সূচনা করতে চাই আমি।

“কুমিল্লার মানুষের সমস্যাগুলো আমার জানা আছে। নির্বাচিত হলে একটা পরিকল্পিক সুন্দর নগরী গড়ে তুলব; অবশ্যই সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করব। আমি যেহেতু চিকিৎসক, এজন্য আমি নারীদের স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্ব দেব। আমার মেধা ও শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে তারুণ্যনির্ভর ও স্মার্ট কুমিল্লা গড়তে চাই।

“তরুণরাই আমার পথচলার শক্তি। আমি নির্বাচিত হলে তরুণ ও যুবকদের জন্য বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নেব। তাদের সঙ্গে নিয়েই আমি মাদক মুক্ত কুমিল্লা গড়ব।” যোগ করেন সূচনা।

‘হাতি’ প্রতীকের প্রার্থী কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি নুর-উর রহমান মাহমুদ তানিমের কাছেও প্রশ্ন ছিল মেয়র হলে কী করবেন? ‍তিনি প্রতিশ্রুতি বলার চাইতে, সাক্কু আর সূচনার সমালোচনাই বেশি করলেন।

তানিম বলেন, “একজন মানুষ তিনবার পৌরসভার চেয়ারম্যান ও সিটি মেয়র হয়েছেন। তাই নতুন ও তরুণ ভোটাররা এখন পরিবর্তন চায়। কারণ চতুর্থবার নির্বাচিত হলে তিনি আর কী করবেন? তিনি তো আগের মতোই থাকবেন।

“আরেকজন তো এমপি সাহেবের কন্যা, তিনি মেয়র হলে তো এমপি সাহেবের পেছনে পেছনে হাঁটবেন। এমপি সাহেবের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করা ছাড়া তরুণদের জন্য কিছুই করবেন না। প্রথমদিকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকলেও কুমিল্লার তরুণ ও নতুন ভোটাররা এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে তারা কাকে ভোট দেবে।”

তিনি বলেন, “তরুণরাই আমাদের পথচলার শক্তি। আমি নির্বাচিত হলে কুমিল্লার তরুণদের স্বাবলম্বী করতে কাজ করব। সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে এজন্য বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে। তাদের প্রশিক্ষণের তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তোলা হবে। নারীরা যেন দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারে, তার জন্যও প্রকল্প নেওয়া হবে সিটি করপোরেশন থেকে।”

উপনির্বাচনে জীবনের প্রথম ভোট দেবেন বলে এক ধরনের উৎসাহ-উদ্দীপনা কাজ করছে কুমিল্লা নগরীর মহিলা কলেজ রোড এলাকার বাসিন্দা নিপা আক্তারের হৃদয়ে। তরুণদের বেশিরভাগই রাজনীতি বুঝে না বলে আক্ষেপ তার।

কেমন নগরপিতা চান? জানতে চাইলে নিপা বলেন, “নগরীর উন্নয়ন ও নগরবাসীর সেবা করবেন, এমন একজন ব্যক্তিকে চাই।”

নগরীর রানীর বাজার এলাকার ভোটার সামি ইসলাম বলেন, “আমরা মাদক ও সন্ত্রাস মুক্ত ও আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর কুমিল্লা চাই। এজন্য যিনি কাজ করতে পারবেন, তাকেই ভোট দিব। আমাদের কাছে দল বড় কথা নয়, যোগ্য ব্যক্তি বড় কথা।”

২০১৭ সালের ৩০ মার্চ অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৭ হাজার ৫৬৬ জন। আর ২০২২ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মোটার ছিল ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০ জন। পাঁচ বছরের ব্যবধানে নতুন ভোটার বেড়েছে ২২ হাজার ৩৫৪ জন।

২০২২ সালের ১৫ জুনের ভোটের পর প্রায় ২১ মাসের ব্যবধানে নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডে নতুন ভোটার হয়েছেন ১২ হাজার ৫৩৮ জন। সে হিসেবে ২০২২ সালের নির্বাচন ও এবারের উপনির্বাচন মিলিয়ে নগরীতে তরুণ ভোটারের সংখ্যা এখন ৩৪ হাজার ৮৯২ জন।

এবার ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৪২ হাজার ৪৫৮। এর মধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ২৪ হাজার ২৭৪ এবং পুরুষ ভোটার ১ লাখ ১৮ হাজার ১৮২ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন দুইজন। পুরুষের চেয়ে নারী ভোটার ৬ হাজার ৯২ জন বেশি।