রাখাইনের পরিস্থিতি দেখে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি দলটি শুক্রবার বিকালে টেকনাফ ফিরবে।
Published : 05 May 2023, 12:36 PM
প্রত্যাবাসন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ‘পরিবেশ-পরিস্থিতি’ দেখতে মিয়ানমারে গেল বাংলাদেশ আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল।
তাদের সহযোগিতা করতে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের নেতৃত্বে ৭ জন সরকারি কর্মকর্তাও তাদের সঙ্গী হয়েছেন।
শুক্রবার সকাল সোয়া ৯টায় টেকনাফ উপজেলা সদরের জালিয়াপাড়ায় নাফ নদীর টেকনাফ জেটিঘাট দিয়ে স্পিডবোটে করে রওনা হয় রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি দলটি।
রওনা হওয়ার আগে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, প্রতিনিধি দলটি বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ‘রাখাইনের সার্বিক পরিস্থিতি কতোটুকু অনুকূলে’ তা দেখতে মিয়ানমার যাচ্ছে।
রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলে টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পের বাসিন্দা তিন জন নারী এবং ১৭ জন পুরুষ রয়েছেন। তারা সবাই প্রত্যাবাসনের জন্য যাচাই-বাছাই করে মিয়ানমারের তৈরি রোহিঙ্গাদের তালিকাভুক্ত।
মিজানুর রহমান বলেন, “প্রতিনিধি দলের হয়ে যেসব রোহিঙ্গা রাখাইনে যাচ্ছেন, তারাই মূলত মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন। সেখানে (রাখাইন রাজ্য) প্রত্যাবাসনের জন্য তৈরি অবকাঠামোসহ অন্যান্য ব্যবস্থা প্রতিনিধি দলের সদস্য রোহিঙ্গারা স্বচক্ষে দেখবেন।"
তিনি বলেন, “যেহেতু রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা হবে, তাই তাদের সরেজমিন অভিজ্ঞতা প্রত্যাবাসন কার্যক্রমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলটি রাখাইনের পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখে আশ্বস্ত হলে- তা প্রত্যাবাসনের জন্য সহায়ক হবে।”
রাখাইনের পরিস্থিতি ঘুরে দেখে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি দলটি শুক্রবার বিকালে টেকনাফে ফিরে আসবে বলে জানান মিজানুর রহমান।
এর আগে গত ১৫ মার্চ টেকনাফ হয়ে বাংলাদেশে আসেন মিয়ানমার সরকারের ১৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা নাগরিকদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তারা বাংলাদেশের দেওয়া রোহিঙ্গাদের তালিকা যাছাই-বাছাই করেন।
প্রতিনিধি দলটি টানা সাতদিন টেকনাফের স্থলবন্দর রেস্ট হাউজে অবস্থান করে বাংলাদেশে আশ্রিত ১৪৭ রোহিঙ্গা পরিবারের মোট ৪৮৬ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। আর তাদের দেওয়া বক্তব্য রেকর্ড করেন।
২২ মার্চ সকালে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলটি নাফ নদী পার হয়ে মিয়ানমারে ফিরে যায়।
সে সময় মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, যাদের প্রত্যাবাসন করা হবে সেই সব রোহিঙ্গা যাতে আগে থেকে রাখাইনের সার্বিক পরিবেশ দেখে আসতে পারেন, তার ব্যবস্থা করতে হবে।
তারই ধারাবাহিকতায় টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা, নয়াপাড়া ও জাদিমুড়া এলাকায় ২৪, ২৬ ও ২৭ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ২০ জন রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতাকে বাছাই করা হয়, যারা শুক্রবার রাখাইনে গেলেন।
প্রত্যাবাসন: এবার ‘পরিবেশ’ দেখতে মিয়ানমার যাচ্ছেন রোহিঙ্গারা
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা ঢলের শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট। এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে ওই এলাকার ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।
জাতিসংঘ সে সময় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর এই হত্যা ও নির্যাতনকে চিহ্নিত করেছিল ‘জাতিগত নিধনের ধ্রুপদী উদাহরণ’ হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার চলতি বছরের মার্চে রোহিঙ্গাদের উপর চালানো ওই হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেওয়ার পর থেকে কক্সবাজার ও উখিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বাঁশ আর প্লাস্টিকের খুপড়ি ঘরে বসবাস শুরু করে রোহিঙ্গারা। উখিয়ার কুতুপালং পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও সই করে।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলার এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতিতে রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে না পারায় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়।
এরপর আসে করোনাভাইরাস মহামারী, রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগে ঢিল পড়ে। বিশ্বজুড়ে সেই সঙ্কটের মধ্যেই গত বছর ফেব্রুয়ারিতে সু চির দ্বিতীয় দফার সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা জেনারেল মিন অং হ্লাইং।
সামরিক জান্তা মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলের কয়েক দিন আগে চীনের নেতৃত্ব প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসেছিল। তার চূড়ান্ত ফল আর পাওয়া যায়নি। ওই সময় বাংলাদেশ আশা করেছিল, ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে হয়ত প্রত্যাবাসন শুরু করা যাবে। সেই পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখেনি।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে অগ্রাধিকারে রাখা বাংলাদেশ সরকার বারবার অভিযোগ করে আসছে, আন্তর্জাতিক মহল প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের উপর যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের এক বছরের মাথায় গত বছরের ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে নবগঠিত ‘অ্যাড-হক টাস্কফোর্স ফর ভেরিফিকেশন অব দ্য ডিসপ্লেসড পার্সনস ফ্রম রাখাইন’ এর বৈঠক হয়।
এরপর গত বছরের ১৪ জুনে হয় দুদেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) সভা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব চ্যান আয়ে বৈঠকে নিজ দেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের যে তালিকা দেওয়া হয়েছিল, মিয়ানমারের তা যাচাই করে দেখার কথা। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এখনও ওই পর্যন্তই।