'সংরক্ষিত বনাঞ্চল' বাস্তবায়িত হলে ১৩টি পাড়া সরাসরি এবং চারটি পাড়া পরোক্ষভাবে উচ্ছেদের শিকার হবে বলে এলাকাবাসীর ভাষ্য।
Published : 15 Jun 2023, 12:59 AM
বান্দরবানের লামার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের সাঙ্গু মৌজায় বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের জন্য সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বুধবার দুপুরে জেলা শহরে প্রেস ক্লাবের সামনে এই দাবিতে মানববন্ধন করেছেন এলাকাবাসী। মানববন্ধনে সাঙ্গু মৌজার ১৭টি পাড়ার তিন শতাধিক লোক অংশ নেন।
মানববন্ধনে বক্তারা অভিযোগ করেন, ২০১০ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের সাঙ্গু মৌজায় বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের জন্য ৫ হাজার ৭৬০ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এই বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ১৫ জুন কক্সবাজারের চকরিয়ায় একটি বেসরকারি হোটেলে উচ্চ পর্যায়ে সভা হওয়ার কথা রয়েছে।
এটি বাস্তবায়িত হলে এলাকার ১৩টি পাড়া সরাসরি এবং আরও চারটি পাড়া পরোক্ষভাবে উচ্ছেদের শিকার হবে বলে তাদের ভাষ্য।
মানববন্ধনে সাঙ্গু মৌজার হেডম্যান চম্পাত ম্রো বলেন, মৌজার অধিকাংশ পরিবার জুমচাষি। বংশ পরম্পরায় দীর্ঘদিন ধরে তারা জুমচাষ করে আসছেন। সংরক্ষিত বনাঞ্চল হলে প্রথাগতভাবে ভোগ করে আসা এসব ভূমি হারাবে তারা।
“১৩টি পাড়াবাসীকে উচ্ছেদ হতে হবে। আরও চারটি পাড়াবাসী পরোক্ষভাবে উচ্ছেদের ঝুঁকিতে পড়বে। বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষিত এলাকার ১৭টি পাড়ায় ম্রো, মারমা, ত্রিপুরার ও বাঙালি মিলে প্রায় ৩ হাজারের কাছাকাছি লোক বাস করে।”
তিনি সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা বাতিলের দাবি জানান।
মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে হেডম্যান-কারবারী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি হ্লাথোয়াইহ্রী মারমা বলেন, শত বছর ধরে বসবাস করে আসা মানুষদের উচ্ছেদ করে শুধু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য নামে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি কতটুকু যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করা উচিত।
“আইন হয় মানুষের জন্য, আইনের জন্য মানুষ নয়। মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য আইন হয়। যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে তা বাতিল করা হোক।”
তিনি আরও বলেন, ১৮৮০ সালে ২৫১ বর্গকিলোমিটার সাঙ্গু রিজার্ভ বন এবং ২৫১ বর্গমাইল নিয়ে মাতামুহুরী রিজার্ভ বন ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই দুই সংরক্ষিত বন রক্ষা করা যায়নি। এখন পানির জন্য হাহাকার। সংরক্ষিত বন এলাকায় ঝিরি ও খাল শুকিয়ে যাচ্ছে। সেই সংরক্ষিত বন এবং পর্যাপ্ত বন ও গাছ না থাকার কারণে প্রকৃতির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সেই বনভূমি যাদের রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল, তারা রক্ষা করতে পারেনি। ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যেখানে মানুষের বসবাস, যে বনকে ঘিরে যাদের জীবনজীবিকা সে জায়গায় বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য নাম দিয়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে এখানকার অধিবাসীদের উচ্ছেদ করার পাঁয়তার চলছে।
“আমারা এর প্রতিবাদ এবং নিন্দা জানাই।”
প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি
সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা বাতিলের দাবি জানিয়ে মানববন্ধন শেষে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, সাঙ্গু মৌজার মোট ভূমির পরিমাণ ১৬,১৯২ একর। তার মধ্যে অত্যধিক খাড়া, ঝিরি-ঝরনা এবং খালের দখলে দখলে থাকা এক তৃতীয়াংশ ভূমি কোনো ধরনের চাষাবাদের উপযোগী নয়। বর্তমানে ঘোষিত বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্যে ৫,৭৬০ একর ভূমিসহ প্রায় ১১,২৫০ একর ভূমিতে ৫৫০টি পাহাড়ি ও বাঙালি পরিবার বসবাস করে। আবার এই ১১,২৫০ একরের মধ্যে ১,৩০০.৬০ একর বন্দোবস্তি, রাবার হর্টিকালচার বাগানের জন্য ইজারা ২,৫৭৫ একর এবং পুনর্বাসিতদের বন্দোবস্তি ৬৯৮.৪০ একর মিলিয়ে মোট ৪,৫৭৪ একর মালিকানা ভূমি রয়েছে। এই মালিকানা ভূমির অধিকাংশ পরিবার ঘোষিত বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য চৌহদ্দিতে পড়েছে।
অধিবাসী পাহাড়িদের সবাই প্রথাগত সামষ্টিক ভূমি মালিকানার দরিদ্র জুমচাষি উল্লেখ করে স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, অভয়ারণ্য হলে অনগ্রসর ৯টি ম্রো পাড়া, ৩টি ত্রিপুরা পাড়া, একটি মারমা পাড়া এবং বেশ কিছু বাঙালি পরিবার সরাসরি উচ্ছেদ হবে। উচ্ছেদের ঝুঁকিতে পড়বে আরও ৩টি ম্রো পাড়া।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আরিফুল হক বেলাল বিডিনিউজ টোয়েন্টফোর ডটকমকে বলেন, বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষিত এলাকায় কোনো পরিবার নেই। তারা এর বাইরে রয়েছে। কেউ উচ্ছেদের মুখে পড়বে না। কাউকে উচ্ছেদ করে নয়, বরঞ্চ স্থানীয় সবাইকে সম্পৃক্ত করে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এলাকা গড়ে তোলা হবে।
মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ম্রো স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তনয়া ম্রো এবং মারমা স্টুডেন্ট কাউন্সিলের জেলা কমিটির অর্থ সম্পাদক উক্যমং মারমা।