যশোর জেনারেল হাসপাতালে গরমে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
Published : 20 Apr 2024, 08:31 PM
তাপপ্রবাহে পুড়ছে প্রায় সারা দেশ। ঘরে-বাইরে কোথাও এক মুহূর্ত স্বস্তি মিলছে না। চারপাশে কাঠফাটা রোদ আর তাপ উঠছে মাটি থেকে। এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ।
থার্মোমিটারের পারদ ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠলে আবহাওয়াবিদরা তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলে। উষ্ণতা বেড়ে ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তাকে বলা হয় মাঝারি তাপপ্রবাহ। আর তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেলে তাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়।
চুয়াডাঙ্গায় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে। শনিবার জেলায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে ৪২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিন সন্ধ্যা ৬টায় এই তাপমাত্রা রেকর্ড করে চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিস।
গত কয়েকদিন ধরে জেলায় সকাল থেকে থাকছে রোদের তাপ, ভ্যাপসা গরম। এতে জনজীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে। রোদের তীব্র তাপে মানুষ বাইরে বের হতে পারছেন না। সকাল ৯টার পর থেকে রোদের তাপ অসহনীয় হয়ে উঠছে; সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকছে একই পরিস্থিতি।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র পর্যবেক্ষক রাকিবুল হাসান বলেন, “গত মঙ্গলবার থেকে টানা শুক্রবার পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে চুয়াডাঙ্গায়। এই কয়দিন তাপমাত্রা থেকেছে ৪০ ডিগ্রির ওপরে।
“শনিবার সকাল ৯টায় তাপমাত্রা ছিল ৩৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বেলা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রাও বেড়েছে। গত কয়েকদিন ধরে সারাদিনই থাকছে রোদের প্রকোপ।
গত ১২ এপ্রিল থেকে চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে জানিয়ে আবহাওয়া অফিসের এ কর্মকর্তা বলছেন, “ওই সময় মৃদু, মাঝারি ও তীব্র তাপপ্রবাহ ছিল চুয়াডাঙ্গায়।
“শনিবার দুপুর ৩টায় তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রিতে উঠে যাওয়ায় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে। তারপর সন্ধ্যা ৬টায় তা ৪২ দশমিক ৪ ডিগ্রিতে পৌঁছায়।”
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার দৌলাতদিয়াড় গ্রামের মুদি ব্যবসায়ী মো. কবির হোসেন বলছিলেন, “৭-৮ দিন আগে থেকেই তীব্র গরম। সকাল থেকেই বাইরে যাওয়া যাচ্ছে না। রোদের তাপে সব বয়সী মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। বয়স্ক লোকজন জরুরি কাজে বেরিয়ে হাঁপিয়ে উঠছেন।
“দুপুরের দিকে কিছুটা বাতাস থাকছে, কিন্তু সেই বাতাসেও চোখ-মুখ জ্বলছে।”
তাপপ্রবাহ নিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তর যেসব সতর্কবার্তা প্রচার করছে, তা চুয়াডাঙ্গাবাসীকে জানানোর জন্য জেলা প্রশাসনের ফেইসবুকে পোস্ট করা হয়েছে।
মানুষকে সচেতন করার জন্য জেলা প্রশাসন এই উদ্যোগ নিয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারাও জেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করছেন।
চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক কিসিঞ্জার চাকমা বলেন, “আবহাওয়া অধিপ্তরের সতর্ক বার্তাগুলো জেলাবাসীকে জানানোর জন্য তা প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একইভাবে স্বাস্থ্য বিভাগের পরামর্শ নিয়ে সেগুলোও প্রচার করা হচ্ছে।
“তাতে বলা হচ্ছে, বেশি করে পানি পান করবেন। বাইরের খাবার খাবেন না। রোদ এড়িয়ে চলবেন। জরুরি কাজে বাইরে যেতে হলে ছাতা কিংবা মাথা ঢেকে বাইরে যেতে হবে। এছাড়া বেশিক্ষণ বাইরে না থাকার পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে।”
জেলা প্রশাসক বলেন, “পরিবেশের ভারসাম্য বজয় রাখতে হলে আমাদের বৃক্ষরোপন করতে হবে। জলাশয়গুলো যাতে ভরাট হয়ে না যায়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। আমরা নিজেরা আমাদের পরিবেশকে ভাল রাখলে আমরা নিজেরাও ভাল থাকব।”
সদর উপজেলার বঙ্গজপাড়ার শিক্ষার্থী ইমরান হোসেন বলছিলেন, তাদের বাড়িতে উপরে টিন। এ কারণে খাটে না শুয়ে তারা মেঝেতে বিছানা পেতে বিশ্রাম নিচ্ছেন। রোদের তাপের কারণে ঘরের টিন গরম হয়ে যাচ্ছে। ঘরে থাকাও যাচ্ছে না।
ইউনুস আলী নামের এক এনজিও কর্মী বলেন, “অন্য বছরের চেয়ে এ বছর কষ্ট বেশি হচ্ছে। রোদের তাপ সহ্য করা যাচ্ছে না। খুবই ঝাঁঝালো রোদ; তাকানোও যাচ্ছে না।
“এর ভেতরই আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। যতটুকু সতর্ক থাকা যায়, তার মধ্যে দিয়েই অফিসে এসে কাজ করছি।”
শনিবার জেলার চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এই মৌসুমে এত তাপমাত্রা এর আগে ওঠেনি বলে চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান জানান।
তিনি বলেন, “২০২৩ সালের ১৯ ও ২০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ বছর একই সময়ে ওই তাপমাত্রা অতিক্রম করেছে। গত বছর ছাড়া ২০১৩ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে জেলার তাপমাত্রা কখনও ৪২ ডিগ্রিতে আসেনি।”
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়া পর্যবেক্ষক রাকিবুল হাসান তীব্র রোদের তাপ ও গরমের কারণ প্রসঙ্গে বলেন, “ভৌগলিক কারণে চুয়াডাঙ্গা জেলায় শীতের সময় বেশি শীত এবং গরমের সময় বেশি গরম পড়ে। কর্কটকান্তি রেখা চুয়াডাঙ্গা জেলার ওপর দিয়ে চলে গেছে। তার প্রভাবে শীত ও গরম বেশি হয়।
“এছাড়াও পশ্চিমের ভারতীয় দিক থেকে শীতের হিমেল বাতাস এবং গরমের গরম আবহাওয়া সহজেই চুয়াডাঙ্গা জেলায় পৌঁছে যায়।”
মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল শনিবার যশোরে। বিমানবাহিনী নিয়ন্ত্রিত আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বলছে, এদিন জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আগের দিন শুক্রবারও একই তাপমাত্রা ছিল এ জেলায়।
প্রচণ্ড তাপদাহে বিপর্যস্ত জেলার সাধারণ মানুষ। দুপুরে জনশূন্য হয়ে পড়ছে সড়কগুলো। রিকশা-অটোরিকশা চালকরা ভাড়া না পেয়ে হা-হুতাশ করছেন। গরম থেকে রক্ষা পেতে কাজ রেখে ছায়ায় আশ্রয় নিতে হচ্ছে শ্রমিক-দিনমজুরদের।
যশোর জেনারেল হাসপাতালে গরমে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। তাদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যাই বেশি।
এ তথ্য জানিয়ে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক বিচিত্রা মল্লিক বলেন, “তীব্র দাবদাহে হার্ট হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেছে। যত রোগী ভর্তি হচ্ছে, তার বেশির ভাগই এসব রোগে আক্রান্ত। মৃত্যু হচ্ছে অনেকের।
“গত ১৭ এপ্রিল থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত জরুরি বিভাগে এ ধরনের আটজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে আনার সময় পথের মাঝে তাদের মৃত্যু হয়েছে।”
যশোর সরকারি এম এম কলেজের ভুগোল বিভাগের প্রধান ছোলজার রহমান বলেন, গত ১৭ এপ্রিল থেকে জেলায় শুরু হয়েছে তীব্র দাবদাহ। তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে গেছে। যা মানুষও প্রাণিদের জন্যে বিপদ সংকেত। বৈরী পরিস্থিতিতে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বারান্দিপাড়া কদমতলার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, “প্রায় এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন বাড়ছে যশোরের তাপমাত্রা। এতে বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষেরা। দুপুর থেকে যেন আগুনের হলকা ছাড়ছে প্রকৃতি। কোনো কাজ করাই সম্ভব হচ্ছে না এই গরমে ।”