কড়া অর্থ মাটি খোঁড়া; এই নৃগোষ্ঠীর মানুষরা বলেন, একসময় তাদের পূর্বপুরুষরা দিঘি খননের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আর সেখান থেকেই এই নামের উৎপত্তি।
Published : 02 Jul 2023, 07:35 PM
নিজস্ব ভবনে যাত্রা শুরু করল ‘কড়া পাঠশালা’।
রোববার দিনাজপুরের বিরল উপজেলার হালজায় মৌজার ঝিনাইকুড়ি গ্রামে এই পাঠশালা ভবনের উদ্বোধন করা হয়।
বাংলাদেশের সবচেয়ে কম জনসংখ্যার আদিবাসী জনগোষ্ঠী ‘কড়া’র শিশুদের জন্য গড়ে তোলা এই পাঠশালা ভবনের উদ্বোধন করে আরেক শিশু অপার সর্বজয়া নূর।
পাঠশালাটির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে গৃহপ্রবেশের আগে কড়াদের ঐতিহ্যবাহী পূজা করেন গ্রামটির মাহাতো (প্রধান) জগেন কড়া।
ঝিনাইকুড়ি গ্রামে বাস করেন কড়া জনগোষ্ঠীর ৯৬ সদস্য, এ ছাড়া দিনাজপুর সদর উপজেলার ঘুঘুডাঙ্গায় থাকেন আরও ১২ জন।
গত বছর ১৬ মার্চ থেকে ঝিনাইকুড়িতে শুরু হয় কড়া পাঠশালার কার্যক্রম। এটি কোনো গতানুগতিক স্কুল নয়, মূলত স্কুলপড়ুয়া এবং স্কুলে যাওয়ার উপযোগী শিশুদের পাঠে সহযোগিতা দেওয়া হয় এখানে।
সেসময় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ভাবনার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত পাঠশালার উদ্বোধন করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ইউসুফ হাসান অর্ক।
শুরুতে ঝিনাইকুড়ি গ্রামের সোনিয়া কড়ার একটি ঘরে পাঠশালার কার্যক্রম চলত। পরে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সহায়তায় গড়ে তোলা হয় নতুন ভবনটি। তবে পাঠশালার দুই শিক্ষক তিথি ওঁরাও এবং বিচলি ওঁরাওয়ের বেতন দেওয়া হয় ভাবনার নিজস্ব তহবিল থেকে। পাশাপাশি নিয়মিত বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণের যোগানও দেয় সংস্থাটি।
বাংলাদেশ সরকারের ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনে' যে ৫০টি জনজাতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে পেছনে কড়াদের অবস্থান।
ঝিনাইকুড়ি গ্রামের প্রবীণরা জানান, কড়া অর্থ মাটি খোঁড়া। এই নৃগোষ্ঠীর মানুষরা বলেন, একসময় তাদের পূর্বপুরুষরা দিঘি খননের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন; সেখান থেকেই এই নামের উৎপত্তি।
অবশ্য এখন কড়া পুরুষদের প্রধান পেশা রাজমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করা। তবে ফসল বোনা এবং তোলার মৌসুমে গ্রামের নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে কৃষিশ্রমিকের কাজ করে। কৃষি তাদের মূল জীবিকা হলেও পরিবারগুলোর মধ্যে পাঁচটি পরিবারের নিজেদের কিছু জমি আছে। বাকিদের দিনমজুরির মতো কঠিন সংগ্রাম করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়।
কড়া জনগোষ্ঠীর মানুষদের ভাষ্য, ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় বসেছে রেললাইন। পাহাড় কেটে, মাটি খুঁড়ে সেই রেললাইন বসানোর কাজটা মূলত এই আদিবাসীরাই করেছে। রেললাইনের কাজের সূত্র ধরে ভারতের ঝাড়খণ্ড থেকে কড়াদের আগমন ঘটে দিনাজপুর অঞ্চলে।
শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে টিকে থাকতে পারবে কি-না, তা নিয়ে সংশয়ে আছে ঝিনাইকুড়ির কড়াদের। ঝিনাইকুড়িতেও অন্য আদিবাসীদের তুলনায় তাদের বেশি নির্যাতন-নিপীড়ন সইতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
একসময় এ গ্রামেই কড়াদের ২০০ পরিবারের বসবাস ছিল। মূলত ভূমি-সংক্রান্ত বিরোধ থেকে সৃষ্ট জটিলতায় পাশের দেশ ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন স্বতন্ত্র ধর্ম ও ভাষাভাষী এ সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষ।
বিলুপ্ত হতে চলা এই জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে তাদের শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে নেওয়ার চিন্তা থেকেই বছর পাঁচের ধরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছে বেসরকারি সংস্থা ভাবনা।
বর্তমানে কড়া পাঠশালায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৯। এর মধ্যে স্কুলগামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১ এবং স্কুলে যাওয়ার উপযোগী হয়ে উঠছে আটজন।
এরই মধ্যে লাপোল কড়া নামে এক তরুণ এবার একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেছেন। তাকে বিরল থেকে দিনাজপুরে নিয়ে থাকা-খাওয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিংয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ভাবনা।
কড়া পাঠশালাটি লাপোল কড়াদের জমিতেই স্থাপন করা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লাপোল বললেন, “আমাকে একটুখানি পড়া বুঝে নেওয়ার জন্য যে কষ্ট করতে হয়েছে, তা আমার ছোটদের আর করতে হচ্ছে না, এটা অত্যন্ত আনন্দের। প্রাইভেট টিউটরের বেতন জোগানোর জন্য আমাকে রীতিমত দিনমজুরি করতে হয়েছে। কিছু ভালো মানুষ এগিয়ে না এলে আমি এতদূর আসতে পারতাম না। তারা এখন আমাদের গ্রামের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান সহজ করে দিতে এসেছেন।”
ভাবনার প্রধান নির্বাহী মুস্তাফিজুর রহমান রূপম বলেন, “এটি তো শুধু একটি ইট-কাঠ আর টিনের ঘর নয়। কড়া পাঠশালা একটি স্বপ্নের নাম। শিক্ষায় এগিয়ে নিতে না পারলে সংখ্যালঘুদের মধ্যেও সংখ্যালঘু কড়াদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। নিত্যদিনের ক্ষুধার অন্ন সংস্থান করাই এখানে কঠিন লড়াইয়ের বিষয়। তবু অভিভাবকরা তাদের শিশুদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন, এটাই আশার কথা।”
মূলধারার বিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে প্রথমেই ভাষার সংকটে পড়ে কড়া শিশুরা। বাংলা ভাষার সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে কেউ কেউ। বাকিরা এক সময় বাংলায় কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে পড়লেও বাড়িতে পড়াশোনায় সহযোগিতা করার মতো কেউ না থাকায় মানসম্পন্ন শিক্ষা পায় না।
এ পরিস্থিতিতে ভাবনা কড়াদের গ্রামে এই বিকল্প পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখানে দুজন শিক্ষকের একজন প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে পাঠাবার উপযোগী করে তোলার কাজ করছেন এবং অন্যজন এরই মধ্যে যারা বিদ্যালয়ে যাচ্ছে, গৃহশিক্ষকের মতো তাদের শিক্ষাগ্রহণকে সহজ করে দেওয়ার কাজটি করছেন।