ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিচারককে আইনজীবীর গালাগালের ভিডিও প্রকাশ্যে

আইনজীবী সমিতির সভাপতি বলেন, “এটা আমি বিচারককে বলিনি, বলেছি যে ভিডিও করছিল তাকে।”  

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Jan 2023, 03:08 PM
Updated : 5 Jan 2023, 03:08 PM

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন আইনজীবী নেতা দলবল নিয়ে গিয়ে এজলাসে বসা একজন বিচারককে অপদস্থ করা এবং তাকে গালাগালের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। 

এ ঘটনার পর বৃহস্পতিবার জেলা আইনজীবী সমিতির তিন সদস্যকে হাই কোর্ট সশরীরে তলব করেছে। এ নিয়ে এখন জেলাজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।  

১৭ জানুয়ারি হাই কোর্টে তলব পাওয়া তিন আইনজীবী হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. তানভীর ভূঁইয়া, সমিতির সম্পাদক (প্রশাসন) মো. আক্কাস আলী এবং আইনজীবী জুবায়ের ইসলাম। 

আইনজীবী ও আদালত কর্মচারীদের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতের বিচার কাজ বন্ধের মধ্যেই ১ জানুয়ারির এই ভিডিও ফাঁস হলো। এদিকে বুধবার সকাল থেকে বিচারকাজ বন্ধ থাকায় ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন হাজার হাজার বিচারপ্রার্থী।   

বিচারকের সঙ্গে আইনজীবীর অসৌজন্যমূলক আচরণ, বিচারিক কাজে হস্তক্ষেপ, কর্মচারীদের মারধরের অভিযোগ এনে বুধবার সকাল থেকে বিচার বিভাগীয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন কর্মবিরতি পালন শুরু করে। 

অপরদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা জজ বেগম শারমিন নিগার ও নাজির মোমিনুল ইসলামের অপসারণ দাবিতে আদালত বর্জনের কর্মসূচি পালন করছেন আইনজীবী সমিতির সদস্যরা।

এর ফলে বৃহস্পতিবারও আদালত চলেনি। সকালে আইনজীবীরা আদালত চত্বরে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন। তারা জানিয়েছেন, রোববার, সোমবারও চলবে আদালত বর্জন কর্মসূচি।

আদালত সংশ্লিষ্টরা জানান, আদালত সংশ্লিষ্টরা জানান, ঘটনার সূত্রপাত গত ১ ডিসেম্বর। এদিন ছিল জেলা জজ আদালতের বছরের শেষ কার্যদিবস। এদিন  একটি মামলা দায়েরকে কেন্দ্র করে আইনজীবী সমিতির নেতাসহ একাধিক আইনজীবীর সঙ্গে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের কথা কাটাকাটি হয়। এরই জের ধরে ঘটনার সূত্রপাত হয়।  

ছড়িয়ে পড়া তিন মিনিট ১৩ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুক এজলাসে ছিলেন। তিনি মামলা পরিচালনা করছিলেন। এ সময় কয়েকজন আইনজীবী এজলাসের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। তাদের মধ্যে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি তানভীর ভূঁইয়া, সম্পাদক (প্রশাসন) আক্কাস আলী, আইনজীবী জুবায়ের ইসলাম ছিলেন। তখন এজলাস ঘিরে পুলিশ সদস্যরাও ছিলেন। 

একজন আইনজীবী আদালত বর্জনের কথা বলে বিচারককে এজলাস থেকে নেমে যেতে বলেন। কথাবার্তার একপর্যায়ে আইনজীবীরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এ সময় তারা বিচারকের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং উচ্চস্বরে গলাগালি করেন। 

এ সময় জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি তানভীর ভূঁইয়াকে চড়া গলায়, আঙ্গুল উঁচিয়ে, ধমকের সুরে বিচারককে উদ্দেশ করে ‘নাম, নাম’ বলতেও শোনা যায়। তানভীর ভূঁইয়া বিজয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান।  

তবে সন্ধ্যায় তানভীর ভূঁইয়া বিচারকের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ অস্বীকার করেন।    

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম। এ সময় সেখানে একটি ছেলে মোবাইল দিয়ে এটি ভিডিও করছিল। আমি তাকে সেখান থেকে নেমে যাওয়ার কথা বলেছি। বিচারককে আমি এজলাস ছাড়তে বলেছি। কিন্তু ওইভাবে এটা আমি বিচারককে বলিনি, বলেছি যে ভিডিও করছিল তাকে।” 

এ সময় নিজেদের আদালত বর্জন কর্মসূচির ব্যাপারে আইনজীবী সমিতির সভাপতি বলেন, “এ ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে আইনজীবীরা মামলা দাখিল করতে গেলে বিচারক মোহাম্মদ ফারুক মামলা না নিয়ে আইনজীবীদের সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য এবং মিথ্যাচার করেছেন। এ ছাড়া প্রধান নাজির মোমিনুলের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন ধরে আদালতে জাল স্ট্যাম্প এবং কোর্ট ফি বাণিজ্য চলছে। জেলা ও দায়রা জজের ইন্ধনে এসব হচ্ছে।“ 

এই তিনজনের অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত আইনজীবীদের আদালত বর্জন কর্মসূচি চলতে থাকবে বলেও জানান তানভীর ভূঁইয়া। 

কর্মবিরতির ব্যাপারে জেলা বিচার বিভাগীয় অ্যাসোসিয়েশনের বক্তব্য হচ্ছে, একটি মামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিচারক এবং আদালতের কর্মচারীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছেন কিছু আইনজীবী। ফলে বাধ্য হয়ে কর্মবিরতির কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে।

আদালত ‍সূত্র জানায়, আইনজীবীরা এজলাসে এসে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন- সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের কাছে এমন অভিযোগ দেন জেলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুক। 

গত ২ জানুয়ারি “এজলাসে আদালতের বিচারক ও কর্মচারীদের অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ ও অশালীন আচরণের জন্য আদালত অবমাননার ব্যবস্থা গ্রহণের প্রার্থনা” বিষয়ক চিঠিটি সুপ্রিম কোর্টে দেন বিচারক ফারুক। 

এই চিঠি প্রধান বিচারপতির কাছে উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল। পরে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতি বিচারপতি জে বি এম হাসানের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে উপস্থাপনের নির্দেশ দেন। সেই অনুসারে এই বেঞ্চে নথিটি উপস্থাপন করা হয়। এরপর হাই কোর্ট রুল জারি করে আইনজীবীদের তলব করে।

রুলে তিন আইনজীবীর বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননার কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে তিন আইনজীবীকে ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্টে হাজির হতে বলা হয়েছে। 

আরও পড়ুন:

Also Read: ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতে ‘কর্মবিরতি ও বর্জনে’ বিচারকাজ বন্ধ, ভোগান্তি