“এতোদিন হয়ে গেল, কেউ আমার কোনো খোঁজও নেয়নি। আমার সবাই থাকতেও যেন কেউ নেই।”
Published : 11 Apr 2024, 05:08 PM
“পোলায় তো খোঁজ-খবর লয় না। ঈদের দিন দেহাও করতে আসে না। সেই পোলার ঘরে ফিরি কেমনে”- অভিমান ভরা গলায় কথাগুলো বলছিলেন ৬৫ বছর বয়সী ফিরোজা বেগম।
ফিরোজার এক সময়ের ঈদ-আনন্দে ভরপুর থাকা দিনগুলো ফুরিয়েছে। সন্তান নিতে পারেনি তার ভার; তাই এখন ঠাঁই হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে।
শুধু ফিরোজা বেগম নন, তার মত আরও শতাধিক মানুষের এখন ঠিকানা গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়ার বিকেবাড়ি গ্রামের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র।
ঈদ এলেই বিষাদ নেমে আসে এ মানুষগুলোর জীবনে, জল নেমে আসে দুই চোখ বেয়ে। হাতড়ে বেড়ান পুরনো স্মৃতি। তাদের ঈদ উৎসব কাটে পরিবারকে কাছে না পাওয়ার কষ্ট-অভিমান বুকে চেপে। বৃদ্ধাশ্রমে ঈদ মানে বিষাদ-কষ্ট, কান্না আর আহাজারির গল্প।
ফিরোজা বেগমের বাড়ি চাঁদপুরে। ২০১৮ সাল থেকে তিনি এই বৃদ্ধাশ্রমে আছেন। এখন এটাই তার বাড়ি; আর বৃদ্ধাশ্রমের সদস্যরাই তার পরিবার।
বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে কিনা জানতে চাইলে ফিরোজা বলেন, “করে না; আমি এইহানেই ভালো আছি। আশপাশে যারা আছে তাদের লইয়াই আমার আনন্দ।”
বৃদ্ধাশ্রমে অপরিচিতজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করলেও পরিচিত মুখ খুঁজে ফেরে বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দারা। তবে তাদের অসহায়ত্ব আর একাকীত্ব ঘুচিয়ে হাসি ফোটানোর জন্য নিরলস চেষ্টা করেন বৃদ্ধাশ্রমের কর্মকর্তারা।
এসব মানুষদের প্রয়োজনীয় সেবা ও চিকিৎসার পাশাপাশি বিনামূল্যে খাবার, ওষুধ ও পোশাক দেওয়া হয়। ঈদে তাদের জন্য বরাদ্দ থাকে নতুন কাপড়; ভালো খাবার।
বিকে বাড়ির বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে যারা আছেন, তাদের প্রত্যেকের জীবনের রয়েছে আলাদা গল্প। সন্তানরা কেউ মা, কেউ বাবাকে ফেলে গেছেন, রাস্তায়, মাজারে, হাসপাতালে। এরপর ভাগ্য তাদের সুঁতোয় গেঁথেছে; এনেছে এই বৃদ্ধাশ্রমে।
প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধায়ক হাবিবা খন্দকার বেলী বলেন, বর্তমানে ১৫০ বৃদ্ধ মা ও বাবা এখানে রয়েছেন। এখন পর্যন্ত অজ্ঞাত শতাধিক ব্যক্তির দাফন করেছেন তারা। দীর্ঘদিন ধরেই মানবসেবায় কাজ করে যাচ্ছেন এ বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুল।
১৯৮৭ সালে রাজধানীর উত্তরায় প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৫ সালে গাজীপুর সদরের বিকে বাড়ি এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। প্রায় ১০০বিঘা জমির ওপর গড়ে ওঠা এ কেন্দ্রে ফল-সবজি বাগান ছাড়াও নিজস্ব জমিতে খনন করা পুকুরে মাছ ও ধান চাষ করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটির পুরুষ ভবনের বাসিন্দা ৬৯ বছর বয়সী ইফতেখার আহমেদ শামীম ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক করেছেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টারে চাকরি করেছেন। এর আগে তিনি দুবাইয়ে একটি কোম্পানিতে দোভাষীর চাকরি করতেন।
দুই বছর চাকরির পরে তিনি আবার দেশে চলে আসেন। তার স্ত্রী ছিলেন সৌদি এয়ারলাইন্সের বিমানবালা। তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হলে ১৯৯১ সালে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পৃথক হয়ে যান স্ত্রী। ছেলে এখন বড় হয়েছে।
ইফতেখার বলেন, “ঢাকায় তার খালার বাড়ি মাঝেমধ্যে দেখা করতে আসলেও আমার সঙ্গে তাদের কেউ দেখা করে না বা আমার কোনো খবরও নেয় না। এখন আমার বয়স হয়েছে। আগের মতো কাজকর্ম করতে পারি না। তাই ২০২১ সালের ১৪ মে আমি এ বৃদ্ধাশ্রমে চলে আসি। ভালই আছি। তারপরও ছেলেটার জন্য মন কাঁদে।
“কিন্তু ঈদে একসঙ্গে সেমাই-পোলাও খাবো সেই কপাল তো আমার নেই। সে কোথায় থাকে, কী করে তাও আমি জানি না। সে যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক। ঈদ ভালোভাবে কাটুক এ দোয়াই করি।”
নিজের মনের কষ্ট উগড়ে দিয়ে ইফতেখার বলেন, “এক সময় কতো রোজগার করছি। তখন কি আর ভেবেছি, এই বৃদ্ধাশ্রমে জায়গা হবে? আজ পরিবার, সন্তান, স্ত্রীর কথা মনে হলেও ফেরার সুযোগ নেই। ফিরতে ইচ্ছে করে। সেটা তো আবেগ, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। তাই সব আবেগ, কষ্ট চাপা দিয়েই এখানে পড়ে থাকা।”
এক ছেলে ও পাঁচ মেয়েকে নিজ হাতে মানুষ করেছেন মো. নুরুজ্জামান। তিনি হাউজ বিল্ডিং ফিন্যান্স করপোরেশনে সহকারী প্রকৌশলী ছিলেন। তাদের গ্রামের বাড়ি জামালপুরের মদনের চরে। বহ্মপুত্র নদে তাদের বাড়ি-জমি বিলীন হলেও হাউজ বিল্ডিং থেকে ঋণ নিয়ে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় দুটি পাকা বাড়ি করেন। একটি বাড়ি মেয়ের জামাই ঋণ শোধ করে নিজেরাই নিয়ে গেছে।
আরেকটি কৌশল করে স্ত্রী নিয়ে নিয়ে গেছে।
বন্ধুর এ পথচলার গল্প শোনাতে শোনাতে নুরুজ্জামানের গলা ধরে আসে, চোয়াল কেঁপে ওঠে। তবু কথা ফুরায় না তার। বলেন, “অবসরে যাওয়ার পরে একটি ডেভেলপার কোম্পানিতে চাকরি নেই। ওই চাকরিকালে মাসে যে বেতন পেতাম, তার সিংহভাগই স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দিতাম।
“কিন্তু স্ত্রী ওই টাকায় নিজের নামে জমি কিনে ও বাড়ি ভাড়ার টাকাও সে আমাকে দেয় না। টাকা চাইলে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। সকলে মিলে আমাকে দৈহিক-মানসিক নির্যাতনও শুরু করে। শেষে অতিষ্ঠ হয়ে গত বছরের মার্চে এ বৃদ্ধাশ্রমে চলে আসি।”
স্ত্রী-সন্তানদের কথা মনে হলেও তাদের অপমান করার কথা মনে পড়লে মনটা বিষিয়ে উঠে জানিয়ে তিনি বলেন, “এতোদিন হয়ে গেল, কেউ আমার কোনো খোঁজও নেয়নি। আমিও নেইনি। আজ আমার সবাই থাকতেও যেন কেউ নেই।”
কথাগুলো বলতেই দুচোখ ছল ছল করে উঠে নুরুজ্জামানের। তারপরও স্ত্রী-সন্তানরা ভাল থাকুক এ প্রত্যাশা করেন তিনি।
অসহায় পরিবারহারা এ মানুষগুলোর সেবা করতে পেরে বেশ আনন্দ পান তত্ত্বাবধায়ক বেলী।
তিনি বলেন, “আমি তাদের ভেতর আমার বাবা-মাকে খুঁজে পাই। তাদের সেবা যত্ন করি। এখানে সকাল-সন্ধ্যা সবার জন্য আমি কাজ করি। আমার একটুও খারাপ লাগে না। সবাইকে নিয়ে আনন্দে থাকি। এই যে ঈদ এল, সবাই আমরা একটা পরিবারের মতো। সবাই এক সঙ্গে ঈদ করেছি।”
বৃদ্ধাশ্রমটি মালিক খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুল বলেন, এখানে যারা থাকেন, সর্বোচ্চটা দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করছেন তারা। বিনামূল্যে খাবার, ওষুধসহ পোশাকও দেওয়া হয়। ঈদেও নতুন কাপড় দেওয়া ছাড়াও তাদের জন্য রান্না করা হয় ভালো খাবার। এ ছাড়া এখানে তাদের নামাজ আদায়, বিভিন্ন ধর্মের মানুষের জন্য প্রার্থনার স্থান রয়েছে। টিভি, দাবাসহ বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে।
তিনি বলেন, “যেসব মানুষের ৬০ বছর হয়ে গেছে, পরিবার যদি তাদের খেয়াল রাখা, যত্ন নেওয়া, চিকিৎসা-স্বাস্থ্য, খাবার ও কথা বলার অবকাশ দিতে না পারে তার জন্য এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
“আমরা এখানে যে অবকাঠামোটি করেছি, তাতে ৮০ জনকে রাখতে পারব। এখনো আমাদের সমাজে এ মেসেজটি যায়নি যে, প্রবীণ নিবাসেও তারা ভালো থাকতে পারে।”
বর্তমানে এ বৃদ্ধাশ্রমে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পরিবারের ৮০ জন পরুষ এবং ৭০ জন নারী রয়েছেন বলে জানান তিনি।